ভোটারদের উপস্থিতি খুবই নৈরাশ্যজনক

এম সাখাওয়াত হোসেন।
এম সাখাওয়াত হোসেন।

দুই সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে বিচ্ছিন্ন দু-একটি ঘটনা বাদ দিলে দৃশ্যত তেমন কোনো গন্ডগোল হয়নি। বলতে গেলে ভোট শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হয়েছে। তবে যেসব ভোটকেন্দ্রে গিয়েছি, তার বাইরে লোকজনের জটলা চোখে পড়েছে। জটলা করে থাকা এসব লোকজনের সবার বুকে ছিল সরকারি দল–সমর্থিত প্রার্থীর ব্যাজ। এসব লোক ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আসতে বাধা দিয়েছেন কি না, জানি না। তবে ব্যাজ পরিহিত এসব লোকের উপস্থিতিতে ভোটারদের মধ্যে ভয়ভীতি সৃষ্টির ইঙ্গিত পাওয়া যায়।

ভোটকেন্দ্রের বাইরে ব্যাজ পরা লোকজনের উপস্থিতির মধ্য দিয়ে নির্বাচনী আইনের ব্যত্যয় ঘটেছে। এদের কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দেখিনি। প্রধান নির্বাচন কমিশনার ভোট দিতে গিয়ে এজেন্টদের ক্ষমতা প্রয়োগের কথা বলেছেন। অথচ বিরোধী দলের এজেন্টদের বের করে দেওয়ার অভিযোগ এসেছে। এজেন্টদের সুরক্ষা দেওয়া এবং তাঁদের দায়িত্ব পালনের সুযোগ নিশ্চিত করার দায়িত্বটা নির্বাচন কমিশনের। কাজেই যেসব অভিযোগ এসেছে, সেগুলো কমিশনের খতিয়ে দেখা উচিত। সারা দিন ভোটকেন্দ্র এবং তার আশপাশে যেসব কর্মকাণ্ড হয়ে থাকে, ভোটের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রতিটি ঘটনা ডায়েরিতে টুকে রাখা উচিত। যাতে করে ওই ডায়েরির বর্ণনা ধরে পরে ভোটের পুরো চিত্র পাওয়া যায়।

ভোট কেমন হয়েছে—তা নিয়ে নির্বাচন কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনের আগে সামগ্রিক বিশ্লেষণ করতে চাই না। তবে সারা দিন ভোটারদের যে উপস্থিতি দেখেছি, তা খুবই নৈরাশ্যজনক। ভোটকেন্দ্রে যে উপস্থিতি দেখেছি, তাতে ভোটারের হার শেষ পর্যন্ত ২৫ শতাংশের বেশি হবে না। ভোটের এই হার তো ৭৫ শতাংশ হতে পারত। তাহলে প্রায় ৫০ শতাংশ ভোটার কোথায় গেলেন? তাঁরা কেন ভোট দিতে এলেন না? গত আট বছরে বাংলাদেশে ভোটার যে হারে বাড়ছে, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে যেতে নিরুৎসাহিত হওয়ার কারণগুলো খুঁজে বের করার সময় এসেছে।

একটা পর্যায়ে এসে দেখলাম যে নির্বাচনী আচরণবিধি ব্যাপক লঙ্ঘন হচ্ছে। তখন যদি নির্বাচন কমিশন কথা বলতে পারত, একটা নিয়মতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারত, তাহলে হয়তো পরবর্তী সময়ে এসব কাণ্ড হতো না। উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র প্রার্থী তাবিথ আউয়ালকে নিয়ে একটি গুরুতর ঘটনা ঘটল। শেষ পর্যন্ত কী হয়েছে, আমি জানি না। কাজেই এই যে একটা ঘটনা ঘটল, যেটা শুধু আচরণবিধিরই লঙ্ঘন নয়, নির্বাচন আইনেরও লঙ্ঘন। নির্বাচন আইনের ৯১ ধারায় ওই আইনের ব্যত্যয় ঘটালে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার কথা সুস্পষ্টভাবে বলা আছে। অথচ কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি। এসব ঘটনা কিন্তু ভোটারদের ওপর প্রভাব ফেলে। ভোটাররা ভাবতে শুরু করেন, নির্বাচন কমিশন তো কোনো কাজ করছে না। সব কাজে যে সব সময় নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা থাকবে, তা কিন্তু নয়। কিন্তু কমিশন যে ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করছে, সেটা অন্তত লোকজনের চোখে পড়তে হবে। দেখা থেকেই কিন্তু বিশ্বাসের জন্ম। নির্বাচন কমিশনের একটা হুংকারও শুনলাম না।

এরপর তো রয়েছে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য। ৩০ জানুয়ারি নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করে দিল। লোকজন গিয়ে তাদের তারিখ পুনর্নির্ধারণের অনুরোধ জানালেন। তারা শুনল না। ১৫ তারিখ পর্যন্ত সেই সিদ্ধান্তেই থাকল। একদিকে পূজা করেন অন্যদিকে ভোট করেন—এ ধরনের কথাবার্তা ভোটারদের বিভ্রান্তিতে ফেলে দেয়। একেবারে শেষের দিকে এসে তারিখ বদল করা হলো।

আমাদের দেশে নির্বাচন কমিশন কার্যকর প্রতিষ্ঠান হিসেবে সেভাবে গড়ে ওঠেনি। কাজেই প্রতিষ্ঠানে আপনি যাকেই বসিয়ে দিন, প্রতিষ্ঠান চলবে। প্রতিষ্ঠান এখন তাকিয়ে থাকে, আচ্ছা উনি এসেছেন। দেখে নিই উনি কী করেন। তারপর আমি তাঁর মতো চলব। এই করে যদি হয়, তাহলে কখনোই প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে না।

আমরা সব সময় ভারতের নির্বাচনের কথা বলি। এবার ভারতে যে নির্বাচন হয়েছে, তা পরিচালনা করেছে একটি অন্যতম দুর্বলতম নির্বাচন কমিশন। কিন্তু ব্যবস্থার পরিবর্তন হয়নি।

আমাদের এখানে নির্বাচন কমিশন পরিচালনায় ঘাটতি দেখি। কমিশনে নিজেদের মধ্যে কোনো মিল দেখি না। একজন কমিশনার বলছেন, তিনি কথা বলতে পারছেন না। সেটা ভুল, শুদ্ধ যেটাই হোক না কেন, পুরো পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে দেখুন—একটা পর্যায়ে এসে সবাই কিন্তু বলছেন, তাঁদের মতামতের গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দূতাবাসকে চিঠি দিয়ে বলেছে, আপনি পর্যবেক্ষক হিসেবে বাংলাদেশি কর্মকর্তাকে পাঠাতে পারবেন না। কিন্তু এটা তো পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাজ নয়। নির্বাচন কমিশন যখন বলেছে, আইন অনুযায়ী তারা অনুমতি দিয়েছে। তারপর আবার একটা চিঠি দিয়ে কমিশন শেষের দিকে একটা বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে।

নির্বাচন কমিশনে আমরা পাঁচ বছর দায়িত্ব পালন করেছি। এ সময়ে সারা দেশে আমরা প্রায় পাঁচ হাজার নির্বাচন পরিচালনা করেছি। ওই সময়কালে খুব বেশি ভালো না হলেও ভোটারদের হার একেবারে খারাপ ছিল না। জাতীয় নির্বাচনের পর উপজেলা নির্বাচনে ভোটারের উপস্থিতি ছিল ৬৩ শতাংশ। একটি বড় নির্বাচনের ২৯ দিন পর স্থানীয় পর্যায়ের একটি নির্বাচনে ওই হার বেশ ভালো বলা যায়। পরবর্তী সময়ে নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মতো নির্বাচনগুলোতে ভোটার উপস্থিতি ৬০ শতাংশের বেশি ছিল। এই প্রেক্ষাপটে এবার ভোটারের উপস্থিতি কেন এত কম হলো, সেটা খুঁজে বের করা জরুরি।

এম সাখাওয়াত হোসেন: সাবেক নির্বাচন কমিশনার