ভোটার, তুমি আগ্রহ হারাইয়াছ?

রাজধানীর বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ কেন্দ্রে ভোটারদের অপেক্ষায় কর্মকর্তারা। ছবি: আবদুস সালাম
রাজধানীর বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ কেন্দ্রে ভোটারদের অপেক্ষায় কর্মকর্তারা। ছবি: আবদুস সালাম

নির্বাচন কমিশন থেকে সংবাদমাধ্যমকর্মীদের যে পরিচয়পত্র দেওয়া হয়েছে, তা সময়মতো ল্যামিনেট করতে পারিনি। হাতে করে কার্ড নিয়ে নির্বাচন কেন্দ্রে ঢুকতে গিয়ে ঝামেলায় পড়তে হলো। মগবাজারের নজরুল শিক্ষালয় থেকে চলে এলাম কারওয়ান বাজারে। উদ্দেশ্য, কার্ডটি লেমিনেট করা। তখন সময় সকাল ১০.১০। দোকানদার কার্ডটি হাতে নিয়ে মিটমিট করে হাসেন। বললেন, ‘কার্ড দিয়া কী করবেন? ভোট তো হইয়া গেছে।’

আমি বলি, ভোট হয়ে গেছে মানে? মাত্র তো দুই ঘণ্টা গেছে। তাঁর কাছ থেকে কোনো উত্তর পাই না। আবার প্রশ্ন করি, আপনি গিয়েছিলেন ভোট দিতে?

 ‘ঢাকায় আমার ভোট নাই।’

তাহলে কী করে বুঝলেন?

তিনি শুধু হাসেন, কোনো জবাব দেন না। ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনের পরিস্থিতি কী, সকাল ১০টায় নিশ্চয়ই তা টের পাওয়ার সময় হয়নি। কিন্তু নির্বাচন নিয়ে লোকজন কী ভাবে বা নির্বাচনকে এখন কীভাবে দেখে, তা অন্তত বোঝা গেল।

‘বিএনপি কেন যে নির্বাচন করে!’

ঢাকা দক্ষিণের ১ নম্বর ওয়ার্ডের একটি কেন্দ্র খিলগাঁও সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে যখন পৌঁছেছি, তখন ১১টা বেজে গেছে। কেন্দ্রের সামনের জায়গাটি বেশ জমজমাট। রাস্তার দুপাশে টেবিল-চেয়ার পেতে প্রার্থীদের পক্ষের লোকজন বসে আছেন। কোনোটিতে ভোটারদের তথ্য দিয়ে সহায়তা করা হচ্ছে, কোনোটিতে ব্যাজ লাগিয়ে কর্মী-সমর্থকেরা বসে আছেন। পুরো এলাকাটি পোস্টারে ছাওয়া। তবে সেখানে সরব ও সবল উপস্থিতি শুধুই সরকারি দলের লোকজনের।

ঢাকা উত্তরের ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের দুটি কেন্দ্র, ঢাকা আইডিয়াল স্কুল ও কলেজ এবং পার্ক ইন্টারন্যাশনাল স্কুল কেন্দ্রের সামনেও একই অবস্থা। সরকারি দলের বাইরে আর কিছুই নেই।

নৌকার মেয়র প্রার্থী, আওয়ামী লীগ–সমর্থিত কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত আসনের নারী প্রার্থী এমনকি আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থীদের দাপটও এসব কেন্দ্রের সামনে চোখে পড়েছে। কিন্তু ধানের শীষের পোস্টার খুঁজে বের করাও কঠিন। এই প্রতীকের ব্যাজ গলায় ঝোলানো কাউকে চোখে পড়েনি। তাদের কোনো ক্যাম্পও নেই। তবে ভোটের যে বুথগুলোতে গিয়েছি, সেখানে বিএনপির পোলিং এজেন্ট আছে কি না, জানতে চেয়েছি। একটি ছাড়া সব কটিতেই ছিল। ভোট কেমন হচ্ছে, জানতে চাইলে তাঁরা সবাই মাথা নেড়ে যা বলেছেন তার অর্থ; ভালো।

আওয়ামী লীগের প্রবল উপস্থিতি বিএনপিকে সরিয়ে রেখেছে, তাদের আসতে দেওয়া হয়নি, নাকি দলটির সাংগঠনিক শক্তি বলে কিছু নেই—এমন প্রশ্নের কোনো জবাব বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেও মিলল না। একজন বললেন, বিএনপি কেন যে নির্বাচনে আসে! পরিহাস করে তিনি তা বললেন কি না, সেটা বোঝা গেল না।

ভোটার, তুমি আগ্রহ হারাইয়াছ?

ভোটকেন্দ্রের বাইরে যত ভিড়, বুথে ঢুকে দেখা গেল ততই ফাঁকা। খিলগাঁও সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের কেন্দ্রটি বেশ বড়। নারী ও পুরুষের ভোট বুথ রয়েছে একই কেন্দ্রে। নারীদের একটি বুথের সামনে দাঁড়িয়ে জানতে চাইলাম কত ভোট পড়েছে। পুলিশের এক সদস্য এগিয়ে এলেন। বললেন, ঢুকতে পারবেন না, প্রিসাইডিং কর্মকর্তা বলেছেন, ওনার সঙ্গে কথা বলতে হবে। বললাম, নির্বাচন দেখতে এসেছি, প্রিসাইডিং কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলার তো কোনো প্রয়োজন নেই। তর্ক করে সেই পুলিশ সদস্যকে কোনোভাবে নিরস্ত করা গেল। শেষে বললেন, স্যার আমাকে বলেছেন,
তাই বললাম।

পরপর তিনটি বুথ থেকে ভোট পড়ার তথ্য নিলাম; ২৩টি, ১৮টি ও ২৯টি। এই বুথগুলোতে গড়ে ভোটের সংখ্যা ৩৮০ থেকে ৪০০। বলা যায় তিন ঘণ্টায় ৭ থেকে ৮ ভাগ ভোট পড়েছে। পুরুষ বুথে ভোটের সংখ্যা একটু বেশি। সেখানকার দুটি বুথে ভোট পড়েছে ৪১ ও ৩৮টি।

ঢাকা উত্তরের ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের দুটি কেন্দ্র ঢাকা আইডিয়াল স্কুল ও কলেজ (নারী) ও পার্ক ইন্টারন্যাশনাল স্কুল কেন্দ্রেও (পুরুষ) একই অবস্থা। কেন্দ্রের বাইরে ভিড়, ভেতরে ফাঁকা। দুপুর সোয়া ১২টা থেকে সাড়ে ১২টার দিকে যখন এই দুটি কেন্দ্রে যাই, তখন কোনো কোনো বুথে একজন ভোটারও ছিল না। নারীদের কেন্দ্রে একটি বুথে ৩৮০ ভোটের মধ্যে পড়েছে ৪১টি ভোট। আর পুরুষদের কেন্দ্রে এক বুথে ৩৫৮ ভোটের মধ্যে পড়েছে ৫২টি।

শেষে সিইসির কাছ থেকে শোনা গেল, ভোট ৩০ শতাংশের বেশি পড়েনি। ভোট নিয়ে উৎসব করা এই জনগণের হলো কী! ভোটাররা কি ভোট নিয়ে আগ্রহ এতটাই হারিয়ে ফেলল?

যত সংশয় আর প্রশ্ন

খিলগাঁও সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের সামনে একজনের সঙ্গে কথা হলো। পেশায় ব্যবসায়ী। তিনি ভোট দেননি। বললেন, দেবেনও না। তাঁকে জিজ্ঞেস করি, তাহলে ভোটকেন্দ্রের কাছে এসেছেন কেন? তিনি বললেন, ‘প্রতিটি নির্বাচনেই আমরা নতুন নতুন কিছু কৌশল দেখতে পাচ্ছি। এই নির্বাচনটি কোন কায়দায় হয়, তা নিয়ে আগ্রহ আছে।’ জানতে চাইলাম, টের পাচ্ছেন কিছু? ‘এখনো বুঝে উঠতে পারছি না’—তাঁর উত্তর।

ইভিএমে ভোট কীভাবে দিতে হয়, কারচুপি সম্ভব কি না অথবা তিনি যাঁকে ভোট দিচ্ছেন, তা গোপন থাকছে কি না—এ নিয়ে ভোটারদের মধ্যে ছিল নানা প্রশ্ন ও সংশয়। কয়েকটি বুথে ভোটারদের সহায়তার জন্য অনেককে ভোট দেওয়ার গোপন স্থানে যেতে দেখেছি। সেখানে তাঁরা কী ভূমিকা পালন করেছেন, তা দূর থেকে টের পাওয়া যায়নি। তবে তাঁরা সহায়তার নামে ভোটারদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছেন, এমন অভিযোগ করলেন একজন ভোটার। আর বুথগুলোতে এসব স্থান যথেষ্ট গোপনীয় নয় বলেও বিরক্তি প্রকাশ করছিলেন অনেক ভোটার।

একটি বেসরকারি ব্যাংকের আইটি বিভাগে কাজ করেন, তিনি ভোট দিয়ে বের হয়েছেন। বললেন, ইভিএমে ভোট কীভাবে দিতে হয়, সেটা বোঝার আগ্রহ থেকেই মূলত ভোট দিতে আসা। একই সঙ্গে বললেন, এখানে ভোটারের গোপনীয়তা কতটুকু থাকবে, তা নিয়ে তাঁর সংশয় রয়েছে। কারণ, নাগরিক পরিচয়পত্র যাচাই এবং সেই পরিচয়পত্রের তথ্যের সঙ্গে যুক্ত থাকা অবস্থায় তিনি ভোট দিয়েছেন। ফলে তিনি কোথায় ভোট দিয়েছেন, সেই তথ্য সংরক্ষিত হওয়ার ঝুঁকি আছে। আর ভোট দেওয়ার পর প্রায় ৩০ সেকেন্ড ‘আপনি...মার্কায় ভোট দিয়েছেন’ এমন লেখা স্ক্রিনে থাকে। এরই মধ্যে ভোটারকে স্থান ত্যাগ করতে বলা হয়। গোপনীয়তা নিয়ে ঝুঁকি আছে বলে তিনি মনে করেন।

ভোটের নয়, ছুটির দিনের উৎসব

ভোটের দিন মানে ছুটির দিনও। ভোটের সময় ঘণ্টা চারেক ঘোরাঘুরি করে মনে হলো, ভোটের উৎসবে শরিক হওয়া নিয়ে মানুষের খুব আগ্রহ না থাকলেও ছুটির দিনটিকে কেউ হেলায় হারাতে চায়নি। আবহাওয়া ছিল চমৎকার। শীত কমেছে, আবার গরমও নেই। গাড়ি বন্ধ থাকায় ঢাকার বাতাসে দূষণও কম থাকার কথা। বড় দূরত্বে না হলেও পাড়ায়-মহল্লায় ঘোরাঘুরি করে, চায়ের আড্ডা বা পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করে ভোটের দিনটি অনেকের ভালোই গেছে। ভোটের উৎসব না হলেও ছুটির দিনের উৎসবটি অন্তত জমেছে।

কেএমজাকারিয়া:প্রথমআলোর উপসম্পাদক