মনজুর পাশতিন বনাম পাকিস্তান

পাকিস্তানের নির্যাতিত পশতুন জাতির নেতা তরুণ মনজুরকে আটক করেছে সেদেশের সরকার। ছবি: এএফপি
পাকিস্তানের নির্যাতিত পশতুন জাতির নেতা তরুণ মনজুরকে আটক করেছে সেদেশের সরকার। ছবি: এএফপি

মনজুর পাশতিনকে শেষ পর্যন্ত গ্রেপ্তারই করলো পাকিস্তান সরকার। পশতুন তাহফুজ মুভমেন্টের (পিটিএম) নেতা তিনি। ২৭ জানুয়ারি পেশোয়ার থেকে আটক হলেন। এর প্রতিবাদ করতে গিয়ে ইসলামাবাদ থেকে গ্রেপ্তার হন একই আন্দোলনের আরেক সংগঠক মহসিন ধর। তিনি দেশটির পার্লামেন্টেরও সদস্য। পরে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হলেও মনজুরের জামিন আবেদন প্রত্যাখ্যান হয়েছে। ‘বিচার’-এর তোড়জোড় চলছে তাঁর।

মনজুরের সংগঠন পিটিএম মূলত পাকিস্তানের পশতুভাষীদের নাগরিক অধিকার আন্দোলন। আফগানিস্তান সীমান্ত-সংলগ্ন পশতু জনপদে সক্রিয় এরা। তাদের সমাবেশ ও ‘লং মার্চ’গুলোতে বিপুল জনসমাবেশ ঘটছে। নিজেদের এলাকায় সশস্ত্রবাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়েই তাদের যত ক্ষোভ।

জাতীয় রাজনীতিতে ইমরান খানের জন্য এই সংগঠন মোটেই কোনো চ্যালেঞ্জ নয়। ইমরানও একই জাতিসত্তার মানুষ। তাতে অবশ্য পশতু তরুণদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় অসহিষ্ণুতা কমছে না। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী পিটিএমের ওপর ক্ষুব্ধ বলেই এমনটি ঘটছে।

মনজুরের ‘বিচার’ চায় ‘স্ট্যাবলিশমেন্টন’
পাকিস্তানে নাগরিক অধিকার সংগঠক মনজুর পাশতিনের উত্থান সম্পর্কে প্রথম আলোতে আগেও লেখা হয়েছে। রাজনীতির প্রথাগত ছকের বাইরে থেকে তাঁর আবির্ভাব। পাকিস্তানের মূলধারার প্রচারমাধ্যমে ২৬ বছর বয়সী এই সাদাসিধা তরুণের কাজের বিবরণ কমই মেলে।

৩-৪ বছর আগে ডেরা ইসমাইল খান এলাকায় কয়েকজন বন্ধু মিলে পিটিএম গঠন করেছিলেন মনজুর। প্রধানত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে ব্যবহার করে দক্ষিণ ওয়াজিরিস্থানে কাজ করে পিটিএম। ১৮ মাস হলো এই অঞ্চল পেশোয়ারকেন্দ্রিক খাইবার পাখতুনওয়ার অন্তর্ভুক্ত। আফগান সীমান্তবর্তী এলাকাটিতে পশতুভাষীরাই প্রধান। তারা আকারে পাকিস্তানের দ্বিতীয় প্রধান জাতিসত্তা হলেও নাগরিক অধিকারে চরম বিপন্ন।

পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও স্থানীয় তালিবানদের দ্বিমুখী সশস্ত্রতায় এ অঞ্চলে স্বাভাবিক রাজনীতি বিলুপ্ত এবং পুরোনো রাজনীতিবিদেরা অনেকে নির্বাসিত, অনেকে নিহত। এই শূন্যতার মাঝেই পিটিএমের জন্ম। দূরবর্তী ও দুর্গম এ এলাকার তরুণদের সংগঠিত করার মাধ্যমে মনজুর এখন পাকিস্তান-আফগানিস্তান অঞ্চলে সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতা। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অন্যতম প্রধান বেসামরিক প্রতিপক্ষ বিবেচনা করা হয় তাঁকে। তুমুল জনপ্রিয় হলেও তিনি কখনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন না এবং কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতিও পক্ষপাত নেই। এই গুণ মনজুরকে সব মতাদর্শের মানুষের কাছে বিশেষভাবে গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে। তবে পাকিস্তান সেনাবাহিনী মনে করে, তিনি মুখ্যত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদেশিদের হয়ে কাজ করছেন। আফগান ও ভারতীয় গোয়েন্দাদের তরফ থেকে মনজুর সহায়তা পান বলেও অভিযোগ করে সেনাবাহিনী। এখন আটকাবস্থায় তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনা হবে বলে মনে হচ্ছে।

বেসামরিক পশতুরা ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ’-এর নিরীহ শিকার
পশতুরা আছে পাকিস্তান-আফগানিস্তানের দুদিকেই। পেশোয়ার, কাবুল, গজনী, কান্দাহার মিলে বিশাল এলাকা তাদের। এর পাকিস্তানভুক্ত অংশে প্রধান সমস্যা সেনা নিয়ন্ত্রণ ও জঙ্গিবাদী সশস্ত্রতা। ‘টিটিপি’ নামে পরিচিত ‘তেহেরিক-ই-তালিবান-পাকিস্তানে’র সশস্ত্রতা মোকাবিলা করতে গিয়ে সেনাবাহিনী পশতু এলাকাগুলোতে ব্যাপক অভিযান চালিয়েছে কয়েক বছর। এই দুই পক্ষের সংঘর্ষে এক দশকে কয়েক হাজার মানুষ মারা গেছে। এ সময় নিরাপত্তা বাহিনী স্থানীয় লোকজনের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করে। অনেক বাড়িঘর ধ্বংস হয়। কয়েক লাখ মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে আছে। ক্রসফায়ারের শিকার হয়েছে বহু তরুণ। গুমের সংখ্যাও অনেক। পশতুদের নিখোঁজ হয়ে যাওয়া কেবল খাইবার অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ নেই, দেশটির অন্যান্য প্রধান শহরেও তা ঘটেছে।

পিটিএম এই অবস্থার অবসান চায়। এ রকম অনাচারের জন্য সেনাবাহিনীর জবাবদিহি চাইছে তারা। এই আন্দোলনে মনজুরের প্রধান দুই সহযোগী মহসিন ধর ও আলী ওয়াজির। এঁরা তাঁদের সমাজের সেই বয়সীদের প্রতিনিধিত্ব করছেন, যাঁরা দুই দশকে তালিবানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে পশতুদের নিঃস্ব হওয়ার জ্বলন্ত সাক্ষী। বিশ্বজুড়ে জঙ্গিবাদ দমনের নামে পশতুভাষী মাত্রই অন্যায় এক সামরিক ঘৃণার শিকার। টিটিপির বিরুদ্ধে অভিযানের জন্য বিশ্বজুড়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রশংসা হয়। কিন্তু নিরীহ পশতু পল্লিগুলো কীভাবে ছারখার হয়েছে, সে খোঁজ রাখেনি কেউ।

পাকিস্তান-আফগানিস্তানকে মুখোমুখি করেছে পিটিএম
আফগানিস্তান বরাবরই পাকিস্তানের পশতুভাষীদের আবেগে গভীরভাবে যুক্ত। তারা পশতু জনপদে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিপীড়নের বিরুদ্ধে। কূটনীতিকভাবে এটা অশোভন। তবে জাতিগত সংহতির বিবেচনায় অস্বাভাবিক নয়।

পশতু জনগোষ্ঠী বিভক্ত হয়ে রয়েছে পাকিস্তান-আফগানিস্তান জুড়ে। ঠিক যেভাবে বাংলা ও পাঞ্জাব ভাগ হয়ে আছে। আফগানিস্তানের প্রধান জাতিসত্তাই পশতুভাষী। মনজুর পাশতিন আটক হওয়ামাত্র আফগানিস্তানে ঝড় বইছে। কয়েক ডজন প্রতিবাদ সমাবেশ হয়েছে দেশটিতে। প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি একাধিক টুইট করেছেন মনজুরের মুক্তি চেয়ে। এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর সাহায্য চেয়েছেন তিনি।

আফগানিস্তানের সমাজজীবনে পাকিস্তান-বৈরিতার পেছনে পিটিএমের প্রতি আফগানদের সহানুভূতি বড় কারণ। সীমান্তের অপর অংশের পশতুদের বিপন্নতাকে আফগান পশতুরা তাদের ওপর নিপীড়ন হিসেবে দেখছে।

গভীর এক স্ববিরোধিতায় পাকিস্তান রাষ্ট্র
খাইবার, করাচিসহ সব এলাকায় পশতুভাষীদের মাঝে পিটিএম, মনজুর পাশতিন, মহসিন ধর বিপুলভাবে জনপ্রিয়। শান্তিপূর্ণ জমায়েতনির্ভর কৌশলে কাজ করে এই সংগঠন। এটা গতানুগতিক কোনো রাজনৈতিক দল নয়। সেটা হতেও চায় না। ক্ষমতার হিস্যা পাওয়ার তাগিদ নেই তাদের। সে কারণে দেশটির ‘এস্টাবলিশমেন্ট’-এর চোখে চোখ রেখে কথা বলতে ভয় পাচ্ছে না তারা।

ইতিমধ্যে পাকিস্তানের অনেক সংকট সামনে এনেছে পিটিএম। মনজুরদের প্রতি পশতু তরুণদের আগ্রহ প্রমাণ করছে পাকিস্তান রাষ্ট্রকে আপন করে নেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের অনেক বেদনা রয়েছে। তাদের প্রতি সেনাবাহিনী যে আচরণ করছে, সেটা ১৯৭১ পূর্ববর্তী বাংলাদেশের মতো অসন্তোষের জন্ম দিচ্ছে। ধর্মের ঐক্য এ ক্ষেত্রে রক্ষাকবচ হয়ে উঠতে পারছে না। যখনই পশতু বা বালুচদের কোনো অসন্তোষ দেখা যাচ্ছে, ইসলামাবাদের রাজনীতিবিদ ও আমলারা তা দেখার ভার দিচ্ছেন সশস্ত্র বাহিনীকে। এতে পরিস্থিতির উন্নতির চেয়ে অবনতিই বেশি হচ্ছে। অথচ এই রাজনীতিবিদ ও আমলারা নানান বিষয়ে ভারতের সঙ্গে সংলাপে আগ্রহী। চিরবৈরী অপর দেশের সঙ্গে সংলাপ হতে পারলে নিজ দেশের একটা জনগোষ্ঠীর নেতৃত্বকে সংলাপের বদলে কারাগারে পুরতে হবে কেন, সেটা অবোধগম্য।

সেনাবাহিনী ক্ষুব্ধ হতে পারে এই বিবেচনায় ক্ষুদ্র শক্তির বামপন্থীরা ছাড়া মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলো পিটিএমের দাবি-দাওয়ায় সমর্থন দেয় না। এই পরিস্থিতি দীর্ঘ মেয়াদে পাকিস্তানের ঐক্যকে দুর্বল করছে। দেশটির রাজনীতি জাতিগত বিষয়গুলোর এখনো যথাযথ মীমাংসা করতে পারেনি; তারই সাক্ষ্য পিটিএমের ক্ষোভ ও জনপ্রিয়তা।

আফগানিস্তানের পশতুপ্রধান এলাকায় পিটিএমের সমর্থক বেড়ে যাওয়াও পাকিস্তানের কৌশলগত স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর। এটা তার আঞ্চলিক অখণ্ডতার জন্য হুমকি এবং আন্তর্জাতিকভাবেও বিব্রতকর। পাকিস্তানের কূটনীতিবিদরা যখন জাতিসংঘসহ বিভিন্ন ফোরামে কাশ্মীরিদের অধিকারের জন্য বলেন, তখন পশতু ও বালুচ অঞ্চলে মানবাধিকার দলনের ঘটনা তাদের কাশ্মীরনীতির ন্যায্যতাকে ম্লান করে। ভারত কাশ্মীরের রক্তপাতকে ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়’ হিসেবে দেখাতে গিয়ে আন্তর্জাতিক ফোরামে যা করে, ইসলামাবাদকেও তা-ই করতে হচ্ছে পশতু অঞ্চলের ঘটনাবলিতে। এটা এক স্ববিরোধিতা।

তবে আন্তর্জাতিকভাবে পিটিএমের প্রতি সমর্থন সামান্যই। আফগানিস্তানের পাশাপাশি ভারত কেবল তাদের বিষয়ে আগ্রহী। আফগান পশতুদের সমর্থন মনজুর পাশতিনদের জন্য যতটা দরকার, ভারতের সমর্থন ততটাই ক্ষতিকর। ভারত মূলত কাশ্মীর পরিস্থিতিতে ইসলামাবাদের নাক গলানো থামাতে পশতুদের বিষয়গুলোতে প্রচারকের ভূমিকা নেয়, যা ইসলামাবাদকে সুযোগ করে দেয় পশতুদের ‘ভারতঘেঁষা’ প্রমাণ করতে।

পিটিএম এখন কী করবে
পিটিএম এত দিন অহিংস পথে ক্ষোভ ও হতাশার কথা বলেছে। ক্রমে দুরূহ হয়ে উঠেছে সেটা। প্রচারমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেন্সরশিপের শিকার তারা। সমাবেশ ও মিছিলে রয়েছে প্রতিবন্ধকতা। প্রধান নেতা আটক হয়ে যাওয়ায় সংগঠনের কর্মীদের কাছে অহিংস রাজনীতির কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। তবে পিটিএমের কর্মীরা সশস্ত্র পথ বেছে নিলে সেনাবাহিনীর জন্য সুবিধাজনক হয়। সে কারণেই মনজুর ও মহসিন ধর কর্মীদের অহিংস পথে থাকতে নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছেন। তবে পশতু জনপদ অপ্রজ্বলিত বারুদের মতো হয়ে উঠছে। পাকিস্তান সরকার মনজুর পাশতিনকে আটকাবস্থায় কীভাবে ‘বিচার’ করতে চলেছে, তার ওপর ‘পাশতুনিস্তান’ ধারণার উত্থান-পতন নির্ভর করছে।

আলতাফ পারভেজ: গবেষক