ট্রাম্পের ভাঁওতাবাজির শান্তি পরিকল্পনা

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: রয়টার্স
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: রয়টার্স

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হুট করে মধ্যপ্রাচ্য শান্তি পরিকল্পনা নামের একটি পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করেছেন। তাঁর প্রশাসনের দাবি, এই পরিকল্পনায় দুই পক্ষকেই ছাড় দিতে বলা হয়েছে এবং পরিকল্পনাটি বাস্তবায়ন করা হলে কয়েক দশক ধরে চলা ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের স্থায়ী অবসান হবে।

ইসরায়েলের ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর পাশে দাঁড়িয়ে ট্রাম্প যখন এই ঘোষণা দিচ্ছিলেন, তখন তাঁদের ধারেকাছে একজন ফিলিস্তিনিকেও দেখা যাচ্ছিল না। এই ঘোষণাটি যে কত বড় ভাঁওতাবাজির, তা ঘোষণার মধ্যেই স্পষ্ট হয়েছে। 

যেকোনো শান্তি প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করতে গেলে দুই পক্ষের আলোচনা দরকার হয়। কিন্তু ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনায় দেখা গেল এসবের কিছুই নেই। শুধু এই ঘোষণা অনুষ্ঠানেই যে ফিলিস্তিনের কাউকে দেখা যায়নি, তা নয়। বরং ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর থেকে এ পর্যন্ত ফিলিস্তিনের কাউকেই হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। 

ইতিহাসের সবচেয়ে কট্টর ইসরায়েলপন্থী এই ট্রাম্প প্রশাসন ২০১৮ সালে জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী ঘোষণা করে নিজেদের দূতাবাস তেল আবিব থেকে জেরুজালেমে স্থানান্তর করেছে। ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর থেকে এ পর্যন্ত নেতানিয়াহু পাঁচবার যুক্তরাষ্ট্র সফর করেছেন। যে লোকগুলোর সঙ্গে নেতানিয়াহু শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চান বলে দাবি করে থাকেন, হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে সেই লোকদের চূড়ান্ত অবমাননা করার জন্য একটিবারের জন্যও তিনি ‘ফিলিস্তিনি’ কথাটি উচ্চারণ করেননি। 

এই একতরফা শান্তি পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে নেতানিয়াহুকে বেশি কিছু করতে হয়নি। এই ‘শান্তি প্রক্রিয়া’ পরিচালিত হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেওর মতো মার্কিন প্রশাসনে থাকা খ্রিষ্টান ইহুদিবাদী এবং ট্রাম্পের জামাতা জ্যারেড কুশনারের মতো ইহুদি বংশোদ্ভূত ইহুদিবাদী লোকের দ্বারা। এসব লোকের পাশাপাশি ইসরায়েলে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেভিড ফ্রিডম্যান অধিকৃত পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের বসতি স্থাপন এবং ফিলিস্তিনিদের মানবাধিকার লঙ্ঘনকে প্রকাশ্যে সমর্থন দিয়েছেন। 

ট্রাম্পের এই তথাকথিত শান্তি প্রক্রিয়া এতটাই একপেশে যে তা না দেখেই ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস নাকচ করে দিয়েছেন। তাঁর এই নাকচ করে দেওয়াটা একদম ঠিক আছে। কারণ, এই পরিকল্পনার বিষয়বস্তু নির্লজ্জভাবে ইসরায়েলের জবরদখল ও ফিলিস্তিনিদের অধিকতর বঞ্চনাকে অনুসমর্থন দিয়েছে। 

ট্রাম্প যে শান্তি পরিকল্পনা উপস্থাপন করেছেন, তা বাস্তবায়িত হলে ফিলিস্তিন ভূখণ্ড ইসরায়েল পরিবেষ্টিত টুকরো টুকরো খণ্ড রাষ্ট্রে পরিণত হবে এবং ১৯৬৭ সালে ইসরায়েলের দখল করে নেওয়া এলাকাসহ পুরো জর্ডান উপত্যকায় ইসরায়েল পাকাপোক্ত বসতি নির্মাণ করবে। এ ছাড়া জেরুজালেম হবে ইসরায়েলের অবিভক্ত রাজধানী। মূলত এই নীলনকশা বাস্তবায়ন করতেই ট্রাম্প এই পরিকল্পনা করেছেন। 

এই প্রস্তাবিত চুক্তিকে ট্রাম্প বলছেন, ‘শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ চুক্তি’, যেটি মাহমুদ আব্বাসের ভাষায় ‘শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ চপেটাঘাত’। কয়েক দশক ধরে জর্ডান ও মিসরের মতো প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে আলাপ–আলোচনা করে যে সিদ্ধান্তের দিকে এগোনো হচ্ছিল, এই চুক্তি তার সবকিছুকেই ছুড়ে ফেলে দিয়েছে। 

ইসরায়েলের সঙ্গে ট্রাম্পের এই গাঁটছড়ায় ফিলিস্তিন একা বঞ্চিত হয়েছে, তা নয়। এটি থেকে খোদ যুক্তরাষ্ট্রের কী লাভ হচ্ছে, তা এখনো পরিষ্কার নয়। ট্রাম্প প্রশাসন তেল আবিব থেকে জেরুজালেমে দূতাবাস স্থানান্তর করা, ওয়াশিংটনে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের অফিস বন্ধ করা এবং পশ্চিম তীরে ইহুদি বসতি স্থাপন করে ইসরায়েল আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করেনি মর্মে ঘোষণা দেওয়াসহ একের পর এক রাজনৈতিক উপহার ইসরায়েলের হাতে তুলে দিচ্ছে। ফিলিস্তিনের সহায়তায় জাতিসংঘের গঠিত সহায়তা তহবিলে চাঁদা দেওয়াও বন্ধ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। 

এর বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র কী পেয়েছে? নিউইয়র্ক টাইমস–এর কলামিস্ট টমাস ফ্রিডম্যান মনে করেন, এতে যুক্তরাষ্ট্রের লাভ না হলেও ট্রাম্পের লাভ হয়েছে। সন্দেহ নেই, যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী খ্রিষ্টান ইহুদিবাদীদের খুশি করতেই ট্রাম্প এসব উদ্যোগ নিচ্ছেন। আগামী নির্বাচনে তাদের নিরঙ্কুশ সমর্থন পেতে এটি ভূমিকা রাখবে বলে মনে করা হচ্ছে। 

এই শান্তি পরিকল্পনা স্বল্প মেয়াদে ট্রাম্প ও নেতানিয়াহু উভয়কেই লাভবান করলেও দীর্ঘ মেয়াদে তা ফলপ্রসূ হবে না। কারণ, ফিলিস্তিনিরা এই পরিকল্পনা কখনোই গ্রহণ করবে না। 

ট্রাম্পের এই পরিকল্পনাকে ফিলিস্তিনিরা প্রত্যাখ্যান করার পর সেটিকে ট্রাম্পের সমর্থকেরা ফিলিস্তিনিদের শান্তি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানকারী হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা চালাবে। কিন্তু সেটি হতে দেওয়া যাবে না। আরব দেশগুলোসহ ফিলিস্তিনিরাও ১৯৫৭ সালের আগের সীমানা অনুযায়ী দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের প্রতি প্রতিশ্রুতিশীল রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের আগের প্রশাসনগুলো এই সমাধানের প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু সেটি উড়িয়ে দিয়ে ট্রাম্প এখন একটি ভাঁওতাবাজির পরিকল্পনা প্রকাশ করলেন। 

ইংরেজি থেকে অনূদিত। স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট


দাউদ কাত্তাব ফিলিস্তিনি সাংবাদিক ও প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক শিক্ষক