এক শ বছর পরেও পরিবর্তন নেই

সর্বশেষ নির্বাচনটি হয়ে গেল গত শনিবার। দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলে দেওয়া হয়েছে, বাংলার মাটিতে গত ১০০ বছরেও এমন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হয়নি। প্রাচীন মোগল নগর ঢাকা পৌরসভার প্রথম নির্বাচনটি হয়েছিল ১৩৬ বছর আগে ১৮৮৪ খ্রিষ্টাব্দে। সেটি সুষ্ঠু হয়েছিল, শান্তিপূর্ণও হয়েছিল, কিন্তু শনিবারের নির্বাচনের মতো অবাধ হয়নি অন্য কারণে। তখন নারীর ভোটাধিকার ছিল না। নগরের সব পুরুষও ভোট দিতে পারতেন না। যেসব নাগরিক অন্তত ১ টাকা ৫০ পয়সা পৌর ট্যাক্স দিতেন, তাঁদেরই শুধু ভোটাধিকার ছিল। প্রথম নির্বাচনে ভোটার ছিলেন ৭ হাজার ২০২ জন। সে তুলনায় ১ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে ভোট পড়েছে যথেষ্ট বেশি, ১৪ লাখের মতো। ১৮৮৪ সালে ঢাকার মোট লোকসংখ্যা ছিল ৮২ হাজার ২১০ জন।

১৮৮৪ সালের পৌর আইন (৩)-এ বিধান ছিল ১৪ জন কমিশনার ভোটে নির্বাচিত হতেন। সরকার মনোনীত করত ৭ জনকে। তাঁরা ভোট দিয়ে চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচন করতেন। প্রথমবার যাঁরা নির্বাচিত হয়েছিলেন, তাঁদের অনেকের নামে পুরোনো ঢাকায় সড়ক রয়েছে, যেমন রূপলাল দাস, খাজা আমিরুল্লাহ, পূর্ণচন্দ্র ব্যানার্জি, খাজা মোহাম্মদ ইউসুফ, সৈয়দ গোলাম মোস্তফা, রাধিকা মোহন বসাক, রমাকান্ত নন্দী, রেজা করিম, হাজি আবদুর রশিদ, শেখ হায়দার বক্স, কৈলাসচন্দ্র দাস প্রমুখ। সরকার যাঁদের মনোনীত করে, তাঁদের মধ্যে মোহিনী মোহন দাস, জিয়াউদ্দিন আহমদ, ড. প্রসন্নকুমার রায়সহ কয়েকজন ছিলেন ইউরোপীয়। কমিশনারদের প্রায় সবাই ছিলেন এখনকার মতোই অত্যন্ত বিত্তবান, জমিদার, ব্যাংকের মালিক, আইনজীবী এবং কেউ উচ্চশিক্ষিত। প্রসন্ন রায় ছিলেন জগন্নাথ কলেজের মনোবিজ্ঞানের খ্যাতিমান অধ্যাপক।

প্রথমে নাম ছিল ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটি বা ঢাকা পৌরসভা। ১৯৭৮ সালে ঢাকাকে ৫০টি ওয়ার্ডে বিভক্ত করা হয়। নামকরণ হয় ঢাকা মিউনিসিপ্যাল করপোরেশন। ১৯৮২ সালে মিরপুর ও গুলশান পৌরসভা বিলুপ্ত করে ঢাকার সঙ্গে যুক্ত করা হলে ওয়ার্ডের সংখ্যা দাঁড়ায় ৫৬। জনসংখ্যা ও আয়তন বাড়ায় ওয়ার্ডও হয় ৭৫ টি। ১৯৯০তে নামকরণ হয় ঢাকা সিটি করপোরেশন। প্রত্যক্ষ ভোটে মেয়র নির্বাচনের বিধান করে আইন পাস হয়।

২০০৯-এ আওয়ামী লীগ নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার ঢাকা সিটি করপোরেশনকে দুই ভাগ করে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন গঠন করে। বাংলাদেশের সংবিধানে বলা হয়েছে বাংলাদেশের রাজধানী হবে ঢাকা। ঢাকা একটি অখণ্ড সত্তা। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা উত্তর বা ঢাকা দক্ষিণে নয়।

মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের সময় বাংলার শাসক ইসলাম খাঁ ঢাকায় তাঁর রাজধানী করেন ১৬০৮ সালে। যদিও তার প্রায় ৩০০ বছর আগে ঢাকা শহরের পত্তন। মোগলদেরও হাজার বছর আগে ঢাকা ছিল প্রাচ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ নৌবন্দর এবং এখানকার পণ্য উপমহাদেশের বাইরেও রপ্তানি হতো। যাহোক, মোগলরা চলে যাওয়ার পর ঢাকা তার গৌরব হারায়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কলকাতাকে তাদের রাজধানী করে তাকে গড়ে তুলতে থাকলে ঢাকা গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। ব্রিটিশপূর্ব সময়ে ঢাকার শাসক ছিলেন নায়েবে নিজাম। ইংরেজ আমলে ঢাকার ডেপুটি কালেক্টর ও ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন ঢাকা নগরেরও প্রশাসক। ইংরেজরাই প্রথম পৌরসভা গঠন করে ১৮৬৪ সালে। পৌরসভা হলো পুরবাসী বা শহরের নাগরিকদের স্বশাসিত সংঘ।

ঢাকা নগর অভিভাবকহীন ৩০০ বছর যাবৎ। এই নগর সমগ্র বঙ্গের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগর। তবে বৃহৎ নগর আর রাজধানী নগর দুই জিনিস। একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের রাজধানী নগরকে কীভাবে গড়ে তুলতে হয় এবং তাকে পরিচালনা করতে হয়, সে সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণা ছিল না এবং নির্দ্বিধায় বলা যায়, এখনো নেই। সে কারণেই ঢাকা ক্রমাগত সম্প্রসারিত হয়েছে, মানুষ বেড়েছে, কিন্তু রাজধানী নগরের বৈশিষ্ট্যে গড়ে ওঠেনি।

ঢাকার উন্নয়নে প্রথম ১০০ বছর বাধা ছিল অর্থ। তার পরের বাধা ইচ্ছা ও যোগ্যতা। উনিশ শতকের আশির দশকে যখন পৌরসভার প্রথম নির্বাচন হয় এবং নির্বাচিত কমিশনারদের প্রথম বৈঠক বসে, সেদিনের আলোচ্য বিষয় ছিল পৌরসভার বাজেট। তখন ঢাকা থেকে মাত্র দুটি পত্রিকা প্রকাশিত হতো। দুটিই সাপ্তাহিক, বাংলাটি ঢাকা প্রকাশ এবং ইংরেজিটি দ্য ইস্ট বেঙ্গল টাইমস।

ঢাকা প্রকাশ, দ্য ইস্ট বেঙ্গল টাইমস এবং সরকারের বেঙ্গল মিউনিসিপ্যাল প্রসিডিংস থেকে জানা যায়, নগরের যে কর আদায় হয় তা থেকে কয়েকজন কর্মচারীর বেতন দেওয়ার পর আর অবশিষ্ট কিছুই থাকে না। উল্লেখ্য, কমিশনারদের কোনো বেতন-ভাতা ছিল না, কারণ তাঁরা জনসেবক। বেতনভুক লোকেরা সেবক হতে পারেন না। তাঁরা কর্মচারী। প্রথম দিনের সভার আলোচ্য বিষয় ছিল পৌরসভার বাজেট। আলোচনার পরে একটি ফিন্যান্স সাব-কমিটি গঠন করা হয়। মেথর বা পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের বেতন এবং দুজন স্যানিটারি ইন্সপেক্টরের বেতন দু-চার টাকা বাড়ানো যায় কি না, তা নিয়ে আলোচনা হয়।

আড়াই বছর পর ১৮৮৭তে ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার পৌরসভাকে এক চিঠি দিয়ে বলেন, কর্মচারীদের বেতন বাড়াতে হলে হোল্ডিং ট্যাক্স বাড়াতে হবে। কর বাড়ানোর কথা শোনামাত্র নগরবাসীর মাথা গরম হয়ে যায়। কমিশনাররাও গরম আলোচনা করে টেবিল চাপড়ান। অধিকাংশের মত, ট্যাক্স বাড়ালে পরেরবার নির্বাচনে তাঁরা ভোট পাবেন না। নগরের উন্নয়নের চেয়ে ভোটে নির্বাচিত হওয়া গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

ট্যাক্স বাড়ানো হবে কি হবে না—এই প্রশ্নে কমিশনাররা নবাব আবদুল গণির শরণাপন্ন হন। তিনি এবং তাঁর পুত্র পরবর্তী নবাব আহসান উল্লাহ সব শুনে বলেন, ট্যাক্স বাড়ানোর দরকার নেই। তাতে মধ্যবিত্ত নগরবাসী অসন্তুষ্ট হবেন। আট হাজার নগরবাসীর পক্ষ থেকে তাদের বর্ধিত করের টাকা নবাব বাহাদুরই দিয়ে দেবেন। আপাতত সমস্যার সমাধান হলেও দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা থেকেই যায়।

ঢাকা সমগ্র উপমহাদেশের একমাত্র নগর, যার উন্নয়ন হয়েছে ব্যক্তির অনুদানে, সরকারি সাহায্যে নয়। উনিশ শতকের শেষ দশক পর্যন্ত ঢাকাবাসী কূপ ও বুড়িগঙ্গার পানি ব্যবহার করত। নবাব আবদুল গণি দুই লাখ টাকা ব্যয়ে পানির কল স্থাপন করেন। তাঁর পুত্র দ্বিতীয় নবাব বাহাদুর আহসান উল্লাহ দুই লাখ টাকার বেশি ব্যয়ে ঢাকায় বৈদ্যুতিক আলোর ব্যবস্থা করেন। কুড়ি শতকের প্রথম দশকে ‘পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশ’ গঠনের পরবর্তী ছয় বছরে ঢাকার যে উন্নয়ন হয়, তা পূর্ববর্তী ২০০ বছরে হয়নি। কার্জন হল, বর্তমান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভবনসহ ব্যাপক উন্নয়ন হয়। ওই সময় ঢাকার কর্তৃত্ব ছিল নবাব সলিমুল্লাহর হাতে। ১৯১১ সালের ডিসেম্বর থেকে ঢাকাবাসীর ভাগ্য বিপর্যয় ঘটে।

পুরোনো কাসুন্দি ঘাঁটার কারণ হলো এই যে ঢাকা বিশ্বের পুরোনো নগর হওয়া সত্ত্বেও এবং রাজধানী নগর হওয়া সত্ত্বেও বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠেছে এবং সে জন্য তার নাম আন্তর্জাতিক জরিপকারীদের খাতায় উঠে গেছে, তার কারণ অনেক গভীরে। পাকিস্তানি আমলে ঢাকার যেটুকু আধুনিকায়ন হয়েছে তার কৃতিত্ব অনেকটাই মাদানী সাহেবদের মতো করিতকর্মা কর্মকর্তাদের। স্বাধীন দেশের রাজধানী হওয়ার পর যা হতে পারত, হয়েছে তার বিপরীত: নষ্ট থেকে নষ্টতর।

আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে যেকোনো নির্বাচনের সময় দেশ প্লাবিত হয় পোস্টার ও প্রতিশ্রুতিতে। সদ্য শেষ হওয়া দুই সিটি করপোরেশনের নির্বাচনও তার ব্যতিক্রম ছিল না। প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন সময়সাপেক্ষ। প্লাস্টিক পোস্টার অপসারণ সম্ভব ছিল ১০ ঘণ্টার মধ্যে। ৪০ ঘণ্টার মধ্যেও তা যথাস্থানে ঝুলছে। এরপর কিছু যাবে করপোরেশনের ভাগাড়ে, অধিকাংশই ড্রেনে। এসব সরানোর দায়িত্ব কার? যারা ঝুলিয়েছে, তাদের না করপোরেশনের?

ঔপনিবেশিক সরকার মনে করেছিল, একদিন তারা চলে গেলে উপমহাদেশের মানুষ ব্রিটেনের মতো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় দেশ চালাবেন। সে জন্য তারা দেশবাসীকে গণতন্ত্র শেখাতে স্বশাসিত স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করে। ইউনিয়ন বোর্ড ও মিউনিসিপ্যালিটিতে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের ব্যবস্থা করে। কিন্তু দেখেন তাদের সে আশার গুড়ে বালি। কোনো অগ্রগতি নেই।

১৯১৬ সালের ১৮ ডিসেম্বর বাংলার গভর্নর তাঁর প্রতিবেদনে বলেন, ‘পৌরসভাগুলোতে ৩০ বছর পরীক্ষা-নিরীক্ষা (এক্সপেরিমেন্ট) করে এখন আমরা হতাশাগ্রস্ত (ডিসঅ্যাপয়েন্টমেন্ট) হয়ে পড়েছি। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া স্বশাসিত স্থানীয় সরকারব্যবস্থায় নাগরিকেরা কোনো সুবিধা (অ্যাডভানটেজ) পাচ্ছেন না। নির্বাচিত কমিটির সদস্যরা ব্যক্তিস্বার্থের (সেলফ-ইন্টারেস্ট) ঊর্ধ্বে উঠতে ব্যর্থ হয়েছেন।’ এখন তাঁর আত্মা এসে দেখে যাক অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে কি না।

সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক