প্রতিষ্ঠানগুলোর নাম অর্থবোধক হওয়া উচিত

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

নামের বড়াই করা ভালো নয় এবং কিছু জিনিসের নামের সঙ্গে কাজের মিলও থাকে না। কিন্তু তাই বলে কি নামকে আমরা কোনো গুরুত্বই দেব না? অর্থবোধক ও সঠিকভাবে বিভিন্ন জিনিসের নাম দেওয়া তো রীতিমতো বিদ্যার একটি শাখা (নমেনক্ল্যাচার) হিসেবে স্বীকৃত! কোনো জীব এবং মানবসৃষ্ট প্রতিষ্ঠানের নাম হতে হয় অর্থবোধক, সহজবোধ্য শব্দ দিয়ে গঠিত, যথাসম্ভব শ্রুতিমধুর ও সংক্ষিপ্ত। কিন্তু বাংলাদেশের শিক্ষাবিষয়ক বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের নাম যথেষ্ট অর্থবোধক নয় বা প্রতিষ্ঠানের কাজের সঙ্গে নামের অসংগতি রয়েছে। এই ভাষার মাস ফেব্রুয়ারিতে এসব প্রতিষ্ঠানের নাম যৌক্তিক করার উদ্যোগ নেওয়া যায়।

প্রথমেই আলোচনা করা যাক দেশের পরীক্ষা পরিচালনা ও সনদ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ে। এগুলো ‘শিক্ষা বোর্ড’ নামে পরিচিত। বোর্ডগুলো শিক্ষাক্রমের নির্দেশনা মোতাবেক প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করে, লিখিত (এবং কিছু ক্ষেত্রে ব্যবহারিক) পরীক্ষা গ্রহণ করে, ফলাফল প্রকাশ ও সনদ প্রদান করে। এই পরীক্ষা শিক্ষার সব ধরনের উদ্দেশ্যের অর্ধেকও মাপতে পারে না। শিক্ষা-সম্পর্কিত সব কাজের মোটামুটি আট ভাগের এক ভাগের দায়িত্ব পালনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে আমরা ‘শিক্ষা বোর্ড’ নাম দিয়ে রেখেছি। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী ও জুনিয়র স্কুল (ও দাখিল) সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষা প্রবর্তনের পর অনেকে বলছেন আমরা পরীক্ষার ওপর অতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষার্থীদের ‘পরীক্ষার্থী’ বানিয়ে ফেলেছি। 

পরীক্ষা পরিচালনা ও সনদ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানকে অন্যান্য দেশ কী নামে ডাকে? মালয়েশিয়া তার পরীক্ষা পরিচালনা ও সনদ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের নাম রেখেছে ‘বোর্ড অব এক্সামিনেশন্স’। সিঙ্গাপুরে এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের নাম ‘এক্সামিনেশন্স অ্যান্ড অ্যাসেসমেন্ট বোর্ড’। থাইল্যান্ডে ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব এডুকেশনাল টেস্টিং সার্ভিস’। নেপালে ‘ন্যাশনাল এক্সামিনেশন বোর্ড’। যুক্তরাজ্যে পরীক্ষা পরিচালনা ও সনদ প্রদানকারী বোর্ডগুলোর সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে ‘অ্যাসেসমেন্ট অ্যান্ড কোয়ালিফিকেশন্স অ্যালায়েন্স’। যুক্তরাষ্ট্রে ‘এডুকেশনাল টেস্টিং সার্ভিস’ এবং ‘কলেজ এন্ট্রান্স এক্সামিনেশন বোর্ড’। 

আমরা পরীক্ষা পরিচালনাকারী বোর্ডগুলোর নামে, বিশেষত ইংরেজিতে আরও একটি ভুল করে রেখেছি। ঢাকা ও রাজশাহী ‘শিক্ষা বোর্ড’ (১৯৬১) এবং কুমিল্লা বোর্ড (১৯৬২) যখন প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন শিক্ষার মাধ্যমিক স্তর (দশম শ্রেণিতে শেষ) এবং উচ্চশিক্ষা স্তর (ত্রয়োদশ শ্রেণিতে শুরু)-এর মাঝখানে ‘ইন্টারমিডিয়েট’ নামে দুই বছরের (একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি) একটি শিক্ষাস্তর ছিল। তখন সেকেন্ডারি ও ইন্টারমিডিয়েট নামে মাত্র দু-দুটি পাবলিক পরীক্ষা গ্রহণ করা হতো। সুতরাং বোর্ডগুলোর নামে ইংরেজিতে ‘বোর্ড অব ইন্টারমিডিয়েট অ্যান্ড সেকেন্ডারি’ পর্যন্ত ঠিক ছিল, ভুল ছিল শুধু ‘এডুকেশন’ শব্দের ব্যবহারে। কিন্তু ১৯৬৩ সালে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষা ‘উচ্চমাধ্যমিক’ নামে মাধ্যমিক স্তরের সর্বোচ্চ উপস্তর হিসেবে মাধ্যমিক স্তরের অংশে পরিণত হয়। বর্তমানে বিশ্বের সব দেশের শিক্ষা প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ—এই তিন স্তরে বিন্যস্ত; প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বা মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার মাঝখানে কোনো ‘ইন্টারমিডিয়েট’ স্তর নেই। অথচ ১৯৬৩ সালে প্রতিষ্ঠিত যশোর বোর্ড এবং সবশেষে ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত ময়মনসিংহ বোর্ডসহ সব কটিরই আমরা নাম দিয়েছি ‘বোর্ড অব ইন্টারমিডিয়েট অ্যান্ড সেকেন্ডারি এডুকেশন’। 

মনে হচ্ছে ১৯৬৩ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ৫৫ বছরেও আমরা ‘ইন্টারমিডিয়েট’কে ভুলতে পারিনি! পরের তিন বছরেও কি পেরেছি? সম্প্রতি প্রবর্তিত জেএসসি পরীক্ষাটি মাধ্যমিক শিক্ষাস্তরের প্রথম পাবলিক পরীক্ষা; তাই এই পরীক্ষাটিও ওই বোর্ডগুলোই নিয়ে থাকে। সুতরাং মাধ্যমিক স্তরের তিনটি উপস্তরের পাবলিক পরীক্ষা গ্রহণ ও সনদ প্রদানকারী বোর্ডগুলোর যুক্তিসংগত নাম হতে পারে বাংলায় ‘মাধ্যমিক পরীক্ষা বোর্ড’; ইংরেজিতে বোর্ড অব সেকেন্ডারি এক্সামিনেশন্স (বিএসই) বা সেকেন্ডারি এক্সামিনেশন্স বোর্ড (এসইবি)। 

বাংলাদেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাস্তরের মূল পরিকল্পনা করে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। ন্যাশনাল কারিকুলাম ডেভেলপমেন্ট সেন্টার এবং টেক্সট বুক বোর্ড একীভূত হয়ে ১৯৮৪ সালে যখন এ প্রতিষ্ঠানটি জন্মলাভ করে, তখন শিক্ষাক্রম প্রস্তুতি ও পরিমার্জনের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছিল একক ‘শিক্ষাক্রম উইং’। ২০০৪ সালে প্রাথমিক শিক্ষাক্রমের জন্য পৃথক উইং সৃষ্টি করা হয়; সে বছর থেকে প্রথম সৃষ্ট ‘শিক্ষাক্রম উইং’ শুধু মাধ্যমিক শিক্ষাক্রমের কাজ করে আসছে। মন্ত্রণালয়ের নবনিযুক্ত সম্মানিত সচিব মো. মাহবুব হোসেন ১৯ জানুয়ারি প্রথমবারের মতো এনসিটিবিতে এলে তাঁকে জানানো হয় যে এই বোর্ডের চারটি উইংয়ের মধ্যে দুটি শিক্ষাক্রম নিয়ে কাজ করে: একটি ‘প্রাথমিক শিক্ষাক্রম উইং’, অন্যটি ‘শিক্ষাক্রম উইং’। তিনি প্রশ্ন তুললেন—একটির নাম ‘প্রাথমিক শিক্ষাক্রম উইং’ হলে অন্যটি ‘মাধ্যমিক শিক্ষাক্রম উইং’ নয় কেন? 

সচিব মহোদয়ের পর্যবেক্ষণ অত্যন্ত যৌক্তিক। একটি জিনিস ভেঙে দুই অংশে বিভক্ত হলে কোনোটাকেই আর ‘আস্ত’ বলে দাবি করা যায় না। ২০০৪ সাল থেকে এনসিটিবিতে একক শিক্ষাক্রম উইংয়ের কোনো বাস্তব অস্তিত্ব নেই। কিন্তু প্রথমে সৃষ্ট ‘শিক্ষাক্রম উইং’-এর নামে মাঝেমধ্যে ব্র্যাকেটে ‘মাধ্যমিক’ লেখা হলেও এখনো আইন ও বিধানের মাধ্যমে এর সঙ্গে ‘মাধ্যমিক’ শব্দটি যোগ করা হয়নি। তবে ২০১৮ সালে এনসিটিবির জন্য একটি নতুন আইন তৈরি হয়েছে। এই আইনে এনসিটিবিতে চারটি নতুন উইং সৃষ্টি করার কথা বলা হয়েছে। আর বর্তমান ‘শিক্ষাক্রম উইং’-এর নাম দেওয়া হয়েছে ‘মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাক্রম উইং’। বোঝা যাচ্ছে, যাঁরা এই আইনের খসড়া করেছিলেন, তাঁরা বুঝতে পারেননি যে উচ্চমাধ্যমিক আসলে মাধ্যমিক স্তরেরই অংশ। এই উইংটি নিম্নমাধ্যমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক মোট তিনটি উপস্তরের শিক্ষাক্রম নিয়ে কাজ করে। তাহলে কি এর নাম নিম্নমাধ্যমিক, (মধ্য) মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক রাখা হবে? এর ‘সংক্ষিপ্ত’, অথচ পূর্ণ ‘অর্থবোধক’ নাম হবে ‘মাধ্যমিক শিক্ষাক্রম উইং’। কিন্তু ভুলভাবে তৈরি খসড়া জাতীয় সংসদে পাস হয়ে গেজেট হয়ে যাওয়ায় এখন এর সংশোধন কঠিন হয়ে পড়েছে। 

এবার দেখা যাক খোদ মন্ত্রণালয় এবং এর বিভাগগুলোর নাম কাজের আওতার সঙ্গে কতটা সংগতিপূর্ণ। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথমে শিক্ষার সঙ্গে ধর্ম, ক্রীড়া ও সংস্কৃতি মিলে একটি মন্ত্রণালয় ছিল। তিনবার শাখা কর্তন করে শুধু শিক্ষা বিষয়ে মন্ত্রণালয় গঠিত হয় ১৯৯৩ সালে। ২০০৩ সালে প্রাথমিক ও গণশিক্ষার জন্য পৃথক মন্ত্রণালয় সৃষ্টি হয়। সুতরাং সে বছর থেকে একক শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বাস্তব অস্তিত্ব নেই। শিক্ষাস্তরের ভিত্তিতে বিভক্ত দুটি মন্ত্রণালয়ের একটি, এর দায়িত্বের আওতা মোতাবেক ‘প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়’ নাম নিয়েছে। কিন্তু মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত বৃহত্তর অংশটি আজও এর যৌক্তিক নাম ‘মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা মন্ত্রণালয়’ পায়নি। বৃহত্তর মন্ত্রণালয়টিতে শিক্ষার ধারা বা উপব্যবস্থার ভিত্তিতে দুটি বিভাগ খোলা হয়েছে। একটি কাজ করে কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা নিয়ে; এর নামও ‘কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ’। কিন্তু প্রধানত সাধারণ শিক্ষাধারার দায়িত্বে নিয়োজিত বিভাগটির নাম রাখা হয়েছে ‘মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ’ (যা পূর্ণ মন্ত্রণালয়ের আওতা বোঝায়। বিশেষায়িত ‘প্রকৌশল’ (‘কারিগরি’ শিক্ষার উচ্চতর রূপ) ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব বিশ্ববিদ্যালয় এবং মাধ্যমিক স্তরের সাধারণ শিক্ষার ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত আলোচ্য বিভাগটির যুক্তিসংগত নাম হতে পারে ‘সাধারণ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা বিভাগ’। 

ড. আবদুস সাত্তার মোল্লা শিক্ষাক্রম গবেষক এবং বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডার সদস্য