বই বিক্রি কমলেও পাঠক বাড়ে

২০১৮ সালে বিখ্যাত পিউ রিসার্চ সেন্টার ‘আমেরিকায় সাধারণ জনগণের সময় ব্যবহারের ধরন’ বিষয়ক একটি গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করে। ফলাফলগুলোর একটি ছিল এই যে আমেরিকায় বইয়ের বিক্রি কমছে এবং বইয়ের পাঠকও কমে যাচ্ছে। দুনিয়াজুড়ে গবেষণাগুলোর একটি সমস্যা এই যে মার্কিন গবেষণার ফলাফল অন্যান্য দেশের গবেষণাকে প্রভাবিত করে। বিশ্বের অন্যান্য কিছু দেশেও বইয়ের পাঠক বাড়া-কমা নিয়ে বেশ কিছু গবেষণা হয়। পিউর ছায়া পড়ে এই সব গবেষণায়। ফলে ফলাফলও মেলে পিউর গবেষণার অনুরূপ।

পিউ রিসার্চ সেন্টারের দেওয়া তথ্য যে অগ্রহণযোগ্য, তা এক বছর পর ফেব্রুয়ারির ৭ তারিখের ‘টাইমস’ ম্যাগাজিনের একটি প্রতিবেদনে স্পষ্ট ফুটে ওঠে। প্রতিবেদনটির শিরোনাম ছিল ‘স্টপ সেয়িং বুকস আর ডেড! দে আর মোর অ্যালাইভ দ্যান এভার’ [‘বইয়ের দিন শেষ বলা বন্ধ করো। আগের যেকোনো সময়ের চাইতে বইয়ের পাঠক এখন অনেক বেশি’]। ‘টাইমস’-এর প্রতিবেদনটিও গবেষণারই ফল। খোদ ন্যাশনাল বুক ফাউন্ডেশনই গবেষণাটি করেছিল। ‘টাইমস’-এর প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে ৬৮তম জাতীয় গ্রন্থ পুরস্কার দেওয়ার সময় পিউর তথ্যের অসংগতি ধরা পড়ে। জানা যায়, সব বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও কাগজে ছাপা বই এক বছর থেকে অন্য বছরে কমপক্ষে ১.৩ শতাংশ হারে বাড়ছে।

ন্যাশনাল বুক ফাউন্ডেশনের তথ্যই সবচেয়ে বেশি নির্ভরযোগ্য হওয়ার কথা। কারণ এটি শুধুই বইবিষয়ক ভাবাভাবি ও গবেষণার প্রতিষ্ঠান। অনেকটা আমাদের বাংলা একাডেমির মতো। পিউ রিসার্চ সেন্টার যুক্তরাষ্ট্রের সব বিষয় নিয়েই পরিসংখ্যানভিত্তিক গবেষণা চালায়। সেই অর্থে পিউ ‘জ্যাক অব অল ট্রেইডস’। তা ছাড়া পরিসংখ্যান নিয়ে তো কথাই আছে যে মিথ্যা তিন প্রকার—মিথ্যা, ডাহা মিথ্যা আর পরিসংখ্যান।

পিউর গবেষণাটি অনেক কারণেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। তার একটি যেমন ‘২০১৭ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে কাগজের বই বিক্রি তো কমেছেই, ই-বুক বিক্রিও ১০ শতাংশ কমেছে।’ তথ্যটিকে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। বই এবং ই-বুক বিক্রি কমে যাওয়া মানে ‘পাঠক কমে যাওয়া’ কি আদৌ সঠিক সিদ্ধান্ত? তা ছাড়া সিদ্ধান্তটি ছিল ‘সময় ব্যবহার’ গবেষণা হতে পাওয়া। জরিপে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিরা ‘কোন কাজে কে কতটা সময় ব্যয় করেছেন’ প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন। এ রকম প্রশ্নে উত্তরদাতারা স্বাভাবিকভাবেই অর্থ উপার্জনের পেছনে সময় আর পরিবারকে দেওয়া সময়—মোটাদাগে এই দুইটির পেছনে সময় ভাগ করে বলে থাকেন; বই পড়াকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বা নির্দিষ্ট করে বলেন না।

দুনিয়াজুড়ে ‘পাঠক কমে যাবে’ অনুমানটির শুরু ২০১০-এর দিকে। ভীতিটি টিকে ছিল ২০১৫ সাল পর্যন্ত। বইপ্রেমিক ও বই ব্যবসা-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা শঙ্কিত ছিলেন যে ই-বুক, ইন্টারনেট, সামাজিক মাধ্যমের প্রসার, এবং ফাইল শেয়ারিং সুবিধার কারণে প্রকাশনা শিল্প ধ্বংস হয়ে পড়বে। ধনী দেশগুলোতেই অনেক নামকরা বইয়ের দোকানও ঝটপট ব্যবসা গুটিয়ে ফেলে। এই আতঙ্কের সত্যতা কতটুকু বিষয়ে বিচার-বিশ্লেষণ শোনার একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হয়েছিল এই লেখকের। সেই অভিজ্ঞতা বর্ণনা করা দরকার, কারণ বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও একই রকমের একটি আক্ষেপের ছড়াছড়ি দেখা যাচ্ছে সম্প্রতি। এই আক্ষেপেও রয়েছে ‘বই পড়া কমে যাচ্ছে’ অভিযোগ। অভিজ্ঞতাটির আলোকে এই অভিযোগগুলোর যথার্থতা কতটুকু, নিরূপণ করার চেষ্টাই এই লেখার উদ্দেশ্য।

বাংলাদেশের লিখিয়েরা তাঁদের হতাশার কথা জানাচ্ছেন এভাবে, ‘কই, বই তো বিক্রি হতে দেখি না।’ এই দলে অনেক প্রতিষ্ঠিত ও জনপ্রিয় কবি-সাহিত্যিকও আছেন। তাঁদের কেউ কেউ পরিসংখ্যান দিয়ে জানান দিচ্ছেন, অমুক বছর তাঁর একটি বইয়ের অত কপি ছাপা হয়েছিল, বিক্রি হয়েছে হাতে গোনা কয়েকটি মাত্র। একই অবস্থা তার পরের বছর এবং গত বছরও। অনেকেই অভিমানী। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বোদ্ধা পাঠকেরা জোর দিয়েই বলছেন, বই বিকিকিনি নেই মানেই পাঠক কমে যাচ্ছে। নানা রকম তির্যক মন্তব্যও চলছে। কারও মতে, পাঠক মোটেই তৈরি হচ্ছে না, বইমেলার ভিড়ভাট্টা আসলে বিনোদনকামী মানুষের সমাবেশ ও আখড়া ছাড়া বিশেষ কিছুতে পরিণত হচ্ছে না। অনেকে বই প্রকাশ করে কটুকথা শুনছেন, ‘এখন বই কেউ পড়ে?’ বা ‘তোমার বই কে পড়বে, কেন পড়বে’ ইত্যাদি। মুরুব্বি স্থানীয় অনেকেরই আক্ষেপ, এই যুগের ছেলেমেয়েরা মোবাইল আর কম্পিউটার নিয়ে পড়ে থাকে, তাই বই পড়ার প্রতি আগ্রহ কম এবং সেটি দিন দিন কমেই যাচ্ছে। বাংলাদেশের প্রকাশকেরাও মনে করছেন প্রকাশনা ব্যবসায় ঝুঁকি বাড়ছে।

লেখক-সাহিত্যিকদের অভিমানের সংগত কারণ আছে বুঝি। প্রকাশনা শিল্প বেশ খরচে জায়গা। তথ্যপ্রযুক্তির অসাধারণ উন্নয়নের পরও প্রকাশনা এখনো একটি নিবিড় শ্রমঘন শিল্প। আবার দৈহিক শ্রমের চেয়েও বেশি লাগে মানসিক শ্রমের জোগান। শিল্প-সাহিত্য সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষ দখল ও দক্ষতা লাগে। এত সব বিশেষত্বের পরও এটি একটি ব্যবসাকর্ম এবং প্রকাশকদের রুটি-রুজির মূল উৎস। বই বিক্রি না হলে প্রকাশকেরা যেমন আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ও বিপন্ন হন, নতুন ও সম্ভাবনাময় লিখিয়েরাও ক্ষতিগ্রস্ত হন। নতুনদের লেখা প্রকাশে তাঁদের অনীহা তৈরি হলে লেখালেখি, গবেষণা ও সাহিত্যচর্চা মারাত্মক ব্যাহত হয়।

এবার অভিজ্ঞতাটিতে ফিরি। বছর পাঁচেক আগে একদিন হাতে কিছু সময় থাকায় ম্যানিটোবা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে একটি সেমিনারে গিয়ে বসেছিলাম। সেমিনারের বিষয় বিশ্বে বই পাঠ ও প্রকাশনা শিল্পের হাল-হকিকত। বক্তা লাইব্রেরি সায়েন্সে সদ্য স্নাতকোত্তর। তাঁর গবেষণা অভিসন্দর্ভের বাইরে নতুন কিছু তথ্য পেয়েছেন, সেগুলো নিয়েই আলোকপাত করতে এসেছেন। তিনি অনেক সাম্প্রতিক গবেষণার পরিসংখ্যান দিয়ে জানালেন যে সারা বিশ্বেই বইয়ের পাঠক বাড়ছে। শুধু যে বাড়ছে তা-ই নয়, বেশ তাড়াতাড়িই বাড়ছে। কিন্তু ব্যক্তি-পাঠকদের বই কেনা কমছে এবং বেশ ভালোভাবেই কমছে। সোজা কথা, পাঠক বই কেনা আগের তুলনায় অনেক কমিয়ে দিয়েছেন। তিনি শুধু উন্নত দেশের উদাহরণই দেননি, উন্নয়নশীল দেশের উদাহরণও দিয়েছিলেন। তাঁর মতে, বই বিক্রি কমছে মানেই পাঠক কমছে, ধারণাটি সম্ভবত অমূলক ও অযথার্থ। প্রকৃত সত্য এই যে, বই বিক্রি কমলেও পাঠক ফি-বছর বেড়েই চলেছে।

তাঁর বক্তব্যের সঙ্গে বাংলাদেশি আক্ষেপকারীদের বক্তব্যের মিল-অমিল দুটিই আছে। মিলটি হচ্ছে ‘বই বিক্রি কমছে’। অমিল ‘বইয়ের পাঠক কমছে’ অনুসিদ্ধান্তটি।

আপাতশ্রুতিতে বক্তার বক্তব্য স্ববিরোধী মনে হচ্ছিল। বইয়ের বিক্রি কমলে পাঠক বাড়ে কীভাবে? সেমিনারের পর তাঁর কাছে ব্যাখ্যা চাইতে গেলেও সময়াভাবে ব্যাখ্যা দিয়ে যেতে পারেননি। আমার চিন্তা থেকে প্রশ্নটি অবশ্য নেমে যায়নি। অন্য একদিন ম্যানিটোবার কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরিতে কন্যাকে নামিয়ে দিতে গিয়ে প্রধান লাইব্রেরিয়ানের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ এল। তাঁকে প্রশ্ন করায় সন্তোষজনক উত্তরই পেয়েছি বলতে হবে। তিনি আঙুলে গুনে ১০টি কারণ বিশ্লেষণ করে বোঝালেন কীভাবে ব্যক্তি পাঠক বই কেনা কমিয়ে দিলেও বইয়ের পাঠক বেড়েছে। তিনি শুরু করলেন আগের বক্তার পরামর্শ দিয়ে। পরামর্শটি ছিল পাঠকের বই না কেনার সমাধান হচ্ছে পাবলিক লাইব্রেরি আন্দোলন। লাইব্রেরিতে এখন আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি পাঠক আসেন। তাই পাড়ায়-পাড়ায় লাইব্রেরি থাকতে হবে। লাইব্রেরিগুলো ভালো বই একটির জায়গায় ১০টি কিনে নেবে যাতে প্রকাশনা শিল্পের গায়ে আঁচড়ই না লাগে।

লাইব্রেরিয়ান ভদ্রলোক জানালেন, কানাডা সেই পদ্ধতিতেই থিতু হয়েছে। পরীক্ষিত মানসম্পন্ন বই হলে পাবলিক লাইব্রেরিগুলো প্রকাশকদের কাছ থেকে প্রতিটি বইয়ের ১০-১৫টি কপি কিনে নেয়। আগে কিনত ২-৩টি কপি। এ জন্য বিনা প্রশ্নে রাষ্ট্রীয় সহায়তা মিলছে। লাইব্রেরি সংখ্যা অনেক বেড়েছে। লাইব্রেরির আয়তন ও কলেবর বেড়েছে। বেড়েছে সেবার গণ্ডি—কম্পিউটার, ফটোকপি, ফ্রি ইন্টারনেট, ওয়্যারলেস চার্জিং স্টেশন, মিটিং ও কনফারেন্স রুম। এমনকি নিদ্রা পেলে ঘুমিয়ে নেওয়ার জন্য আরাম কেদারার ব্যবস্থাও থাকছে। বেড়েছে সংগ্রহের সংখ্যা। পাঠক ৫০টি বই ও ডিভিডি ব্লু-রে সিনেমা একবারে ধার নিতে পারছেন। সময় পেরিয়ে গেলে ঘরে ঘরে বসেই ধার নবায়ন করতে পারছেন।

তাঁর পরের ব্যাখ্যাগুলোকে বাংলাদেশের বেলায় প্রয়োগ করলে কী হয় দেখি? এক. ধার করে বই পাঠ বহুগুণ বেড়েছে। একজন ছাত্র হয়তো একটি বই কিনলেন। ১০-২০ এমনকি আরও বেশি বন্ধুর হাতে হাতে ঘুরে পঠিত হয়ে চলেছে বইটি। দুই. আগে বইয়ের মালিক ধারই দিতে চাইতেন না আর ফিরে না পাওয়ার ভয়ে। এখন ধার দেওয়া বহুগুণ বেড়েছে। কারণ কেউই বই খোয়া যাওয়াকে আগেকার দিনের মতো মহা সম্পদ খোয়া যাওয়া ভাবেন না। মূল বই না পাওয়া গেলে (এবং বইটি খুব দরকারি হলে) মূল মালিক অনায়াসে ই-বুক, ফটোকপি-বই, রেপ্লিকা বই বানিয়ে নিতে পারছেন। তিন. বই উপহার দেওয়ার রেওয়াজ প্রায় উঠেই গেছে। আগে অনেক অপাঠকের ঘরেও উপহার পাওয়া বই জমা থাকত, যেগুলো তাঁরা হয়তো কখনো খুলেও দেখেননি। সময় বদলেছে, অ-বই উপহার বেড়েছে। চার. আয়-উপার্জনের সমস্যা তো বটেই, অনেকেই অন্যান্য নানা কারণে সপরিবার খুপরির মতো বাসাবাড়িতে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। একটি বুক শেলফ বসানোর মতো অতিরিক্ত জায়গাই নেই। সে জন্য অনেক সিরিয়াস পাঠকও সংরক্ষণের স্থানাভাবে বই কেনেন না। পাঁচ. আগে মধ্যবিত্ত পরিবারে বুকশেলফ ও বইয়ের সংগ্রহকে সাহিত্য-সংস্কৃতিমনস্কতার চিহ্ন ধরা হতো। পড়ুক না-পড়ুক মধ্যবিত্তরা বই কিনতেন। এখন সেই অবস্থাটি টিকে নেই।

পাঠাগার আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য আমাদের প্রকাশক-কবি-সাহিত্যিকদের কিছুই বলতে শুনিনি। অথচ পাঠাগার আন্দোলন হলে পাঠাগারগুলোই বই কিনে নেবে। দরকারি ও ভালো লেখা হলে, শিল্পসৌকর্যে ভালো প্রকাশনা হলে লাইব্রেরিগুলো তো কিনবেই, আমপাঠকও কিনবে। মনে রাখতে হবে আসলেই পাঠক বাড়ছে।

‘পাঠক বই কেনে না’, ‘পাঠক বই পড়ে না’ অভিযোগগুলো অপ্রীতিকর ও অস্বস্তিকর। বই ও জ্ঞানচর্চা-সম্পর্কিত যেকোনো সারবত্তাহীন ঢালাও অভিযোগের প্রবণতা চিরতরে বন্ধ হোক!

হেলাল মহিউদ্দীন: অধ্যাপক, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়