এবারের ভোটে ইভিএমের যে অভিজ্ঞতা মিলল

এবারের সিটি করপোরেশন নির্বাচন ঢাকার ইতিহাসে প্রথম নির্বাচন, যেখানে বহুল আলোচিত ও সমালোচিত ইভিএমে ভোট দেওয়া হয়েছে। তবে বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম নয়, দ্বিতীয় ঢাকা সিটি করপোরেশন, যার সম্পূর্ণ ভোটটি ইভিএমে গৃহীত হয়। প্রথম ছিল কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন, যদিও সেটি ছিল ওই সময়ে দেশের ছোট সিটি করপোরেশনের একটি। ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনে নিবন্ধিত ভোটারের সংখ্যা ছিল ৫৮ লাখ, যাদের মধ্যে কয়েক লাখ তরুণ।

প্রবর্তন হওয়ার পর থেকে বর্তমানে ব্যবহৃত ইভিএমের গুণগত মানে পরিবর্তন আনা হয়েছে এবং উচ্চমান নিশ্চিতের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বর্তমান ইভিএমে তিনটি পদ্ধতিতে একজন ভোটারকে ভোট প্রদানের যোগ্য কি না তা শনাক্ত করা যায়। এই শনাক্তকরণ ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তি বা ভোটারের জন্য ব্যালট ইউনিট উন্মুক্ত করা যায় না। তবে ভোট প্রদানের জন্য প্রস্তুত করার পর ব্যালট ইউনিটে যে কেউ চাপ দিয়ে ভোট সম্পন্ন করতে পারবেন। তার মানে, এই উচ্চমানের প্রযুক্তি কোনোভাবে ভিন্নতর বুথ দখল বা কেন্দ্র নিয়ন্ত্রণ ঠেকায় না। বিষয়টি নিয়ে আগেও বলা হয়েছে, এমনকি একজন নির্বাচন কমিশনারও বলেছেন, ইভিএমে বুথ দখল হলে ভোট চুরি করা যায়, যা এই নির্বাচনসহ হালের চট্টগ্রাম-৮-এর উপনির্বাচনে, পত্রপত্রিকা ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় ফলাও করে প্রকাশিত, বুথ দখল বা প্রভাবিত করে বহু ক্ষেত্রে সরকারি দলের প্রার্থীর পক্ষে ভোট প্রদান করা হয়েছে। (প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, নিউ এজ, ইত্তেফাক ০২.০২.২০২০)। 

ইভিএমে যেহেতু ভোটারের হিসাব ডিজিটালি রেকর্ড করাও পাওয়া যায়, তাই ভোটারের উপস্থিতি বা প্রদত্ত হার নিয়ে কারচুপির আশঙ্কা নেই বললেই চলে, শুধু যদি সনাতন পদ্ধতিতে যোগফলে কোনো হেরফের করা হয়। তবে সব পক্ষের এজেন্ট উপস্থিত থাকলে কেন্দ্রের ফলাফলে তা করা কঠিন। কাজেই বর্তমান ইভিএম পদ্ধতির ভোট কোনোভাবেই প্রার্থীর এজেন্টের গুরুত্ব কমায়নি, বরং বেড়েছে। তবে এজেন্টদের ইভিএম সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান থাকতে হবে। 

ইভিএম নিয়ে এই সংক্ষিপ্ত আলোচনার কারণ, এই নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতির বিষয়টির গুরুত্ব আলোচনার সূত্রপাতের জন্য। ইভিএম ব্যবহারে ভোটের যে হার প্রকাশিত হয়েছে, তাতে দেখা যায় যে মাত্র ২৯.০০২ শতাংশ ভোটার ভোট দিয়েছেন, তার মানে যে ৫৮ লাখ ভোটারের ৭০.৯৯৮ শতাংশ ভোটার ভোটকেন্দ্রেই যাননি (ডেইলি স্টার ০২.০২.২০২০)। যদিও এখনো নির্বাচন কমিশন থেকে সঠিক অঙ্ক প্রকাশিত হয়নি। এত কম ভোটার উপস্থিতি নিয়ে সব মেয়র প্রার্থী যেমন হতাশ, তেমনি হতাশ সরকারি দল, বিরোধী দল ও বিশ্লেষকেরা। এ হার ঢাকার ইতিহাসে সবচেয়ে কম। ভোটার উপস্থিতি এত কম হওয়ার বিষয়ের সত্যতা নিয়ে কেউ দ্বিমত করতে পারছেন না। কারণ, ইভিএম প্রায় নির্ভুল ভোটার উপস্থিতির রেকর্ড নিশ্চিত করে। ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার কারণ অনেকেই নিজের মতো করে দিয়েছেন বা বলেছেন, সরকারি দলের এক প্রকার ব্যাখ্যা এবং নির্বাচন কমিশন থেকে বিভিন্ন ধরনের ব্যাখ্যাতেও কারণসমূহ সঠিকভাবে চিহ্নিত হয়নি। এসব ব্যাখ্যার মধ্যে নির্বাচন কমিশন সচিবের ব্যাখ্যাটি যথেষ্ট কৌতুকের খোরাক জুগিয়েছে। তিনি বলেছেন, যেহেতু ভোটাররা ফেসবুক নিয়ে বেশি ব্যস্ত ছিলেন, তাই ভোটার উপস্থিতি কম হয়েছে (মানবজমিন ০৩.০২.২০২০)। এগুলো অত্যন্ত ঠুনকো এবং হালকা বক্তব্য। আসল কারণ খতিয়ে দেখার দরকার ছিল এবং কারণ রয়েছে। কেন ভোটারদের ভোট প্রদানে অনীহা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে, যেখানে প্রচারণার সময়ের চিত্র ছিল ভিন্নরূপ।

যাহোক, ক্রমান্বয়ে বিভিন্ন নির্বাচন বিভিন্ন দেশে, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশে কথিত উদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ভোটারের ভোট প্রদানে অনীহার কারণগুলো নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। এসব গবেষণায় যেসব কারণ চিহ্নিত হয়েছে (Pippa Norris, Why Election Fails এবং Why Electoral Integraty Matters দ্রষ্টব্য), যার প্রায় সব উপাদানই হালে বাংলাদেশের নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় দৃশ্যমান।

এসব উপাদানের অন্যতম, ক্রমান্বয়ে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের প্রক্রিয়া সংকুচিত হওয়া, যা বাংলাদেশে ২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে ধারাবাহিকভাবে দৃশ্যমান। ২০১৪ সালে বিএনপির নির্বাচন বর্জন ও সহিংসতা এবং এর ফলে সংসদের অর্ধেকের বেশি আসনে বিনা ভোটে নির্বাচিত হওয়া। ক্রমাগত ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে নির্বাচন কমিশনের ও নির্বাচনপ্রক্রিয়ার ওপর ভোটারদের ক্রমাগত আস্থা হারানো বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থার অন্যতম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ বলে মনে করি। ‘কেন ভোট দেব, ভোট দিয়ে আমার কী লাভ?’ এমন প্রশ্নের উত্তর যখন ভোটাররা নির্ধারণ করতে না পারেন অথবা ‘যাঁর জিতবার তিনিই জিতবেন’, এমন ধারণা জন্মালে ভোটাররা ভোট প্রদান থেকে বিরত থাকেন, যা বিগত বছরগুলোর বেশির ভাগ নির্বাচনে দেখা ও উপলব্ধি করা গেছে, বিশেষ করে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ক্ষেত্রে। ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর এ ধরনের প্রশ্ন ও ধারণা আরও প্রকট হয়েছে বলে ধারণা করেছেন আমাদের দেশের নির্বাচন বিশ্লেষক ও সাধারণ ভোটাররা।

আরেকটি বড় চিহ্নিত কারণ ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে স্বচ্ছন্দে যেতে না দেওয়া এবং নানা ধরনের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ আতঙ্ক ছড়ানো অথবা ভয়ভীতি দেখানো। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ঢাকা সিটি নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন তথ্য প্রকাশে বিষয়টি সন্দেহাতীতভাবে উঠে এসেছে। এই নির্বাচনে বুথ দখল নয়, বুথের ভেতরে স্থিতদের প্রভাব ছড়ানো এবং বহু কেন্দ্রে ভোটারদের ব্যালট ইউনিট ব্যবহারে প্রভাবিত করার চিত্র প্রকাশিত হয়েছে। এ বিষয়ে অগণিত ভোটারের অভিজ্ঞতাও তেমনই ছিল। 

এবার বুথ জ্যাম তেমনভাবে আলোচিত হয়নি। ভোটারের উপস্থিতি এমনিতেই কম ছিল, তদুপরি কাগজের ব্যালটের পরিবর্তে ইলেকট্রনিক ব্যালট ও ভোটার শনাক্তকরণ প্রক্রিয়ায় বুথ জ্যাম বা একাধিক অবাঞ্ছিত ব্যক্তি কর্তৃক পেপার ছিনতাইয়ের সুযোগ না থাকা অন্যতম কারণ হতে পারে। তার পরিবর্তে যেকোনো একজন ভোটারের পরিবর্তে নিজে ভোট দিয়েছেন অথবা ভোটারকে অন্য কোনো প্রতীকে ভোট দিতে বাধ্য করেছেন। এবার যা দৃশ্যমান ছিল তা ছিল ‘ভোটকেন্দ্র লক’ বা ‘ভোটকেন্দ্র নিয়ন্ত্রণ করা’। সিংহভাগ কেন্দ্রের বাইরে নিয়ন্ত্রণ করার মতো ঘটনা ছিল চোখে পড়ার মতো। এ নিয়ে কোনো রাখঢাক ছিল না। সরকারি দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের মুখে বুথ নিয়ন্ত্রণের কথা প্রকাশ্যে উচ্চারিত হয়েছে। অবশ্য বিরোধীরাও এ ধরনের পাল্টা বক্তব্য দিতে পিছপা হয়নি। এ ধরনের বক্তব্য ও নির্দেশনার মাধ্যমে সাধারণ ভোটারদের আতঙ্কিত করা হয়েছে। 

এবারের ঢাকা নির্বাচনে উভয় পক্ষ থেকে নেতিবাচক প্রচারণাও কম হয়নি। একপর্যায়ে আচরণবিধির তোয়াক্কা না করেই উচ্চপর্যায় থেকে প্রকাশ্যে নানা ধরনের বক্তব্য, যা আতঙ্ক ছড়ায়, দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রেও নির্বাচন প্রশাসন একেধারেই নিষ্ক্রিয় ছিল। সর্বশেষ ছিল ভোট গ্রহণের প্রায় কয়েক ঘণ্টা আগে একটি গবেষণার ফলাফল প্রকাশ এবং এর সপক্ষে যুক্তি তুলে ধরা। এ ধরনের গবেষণা প্রচারে যদিও আমাদের দেশে বিদ্যমান আইনে বাধা নেই, তবে ভোটারদের প্রভাবিত করতে যথেষ্ট। ভারতে নির্বাচনের ঠিক আগে এ ধরনের গবেষণার ফলাফল প্রকাশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

এবারের নির্বাচনে যে হারে ভোট পড়েছে, তার পরিসংখ্যান নিলে দেখা যায় যে উত্তরের নির্বাচিত মেয়র ভোট পেয়েছেন প্রায় ১৪ শতাংশ এবং তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী পেয়েছেন ৮ শতাংশ। উত্তরে ভোটার সংখ্যা ছিল প্রাপ্ত তথ্যমতে, ৩০ লাখ ১০ হাজার ২৭৩। দক্ষিণে নির্বাচিত মেয়র, কমবেশি পেয়েছেন ১৭ শতাংশ এবং নিটকতম প্রতিদ্বন্দ্বী পেয়েছেন প্রায় ১০ শতাংশ (সামান্য কমবেশি হতে পারে)। ঢাকার নির্বাচিত দুই মেয়র আওয়ামী লীগের প্রার্থী হলেও ১৪ দল এর প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। অন্যদিকে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির দুই প্রার্থীর প্রতি সমর্থন ছিল ২০ দলের। 

ওপরের অঙ্কের বিশ্লেষণে অবশ্য প্রশ্ন ওঠে যে সরকারি দলের দাবি অনুযায়ী সমর্থন ও ভোট আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা পাননি। এবং নিজ দলের জন্য ভোট দিতে তাদের সমর্থকেরা উপস্থিত হয়নি। উল্লেখ্য, ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভোট ছিল ৪৪ (৪৪.০৪) শতাংশ, অবশ্য ২০১৮ সালে প্রকাশিত ছিল আরও বেশি (৭৬.৮৮)। অপর দিকে ওই নির্বাচনে বিএনপির হার ছিল ৩২.৫০ এবং ২০১৮ সালে ছিল ১২.৩৩ (সূত্র: নির্বাচন কমিশন, পার্লামেন্ট, ডেইলি স্টার ও প্রথম আলো)। কাজেই যৌক্তিক প্রশ্ন হলো, স্বীয় দলের ভোটাররাও কেন ভোট প্রদান থেকে বিরত ছিলেন। এর তাত্ত্বিক উত্তর হলো যে সিংহভাগ সমর্থক ভোটার, বিশেষ করে সরকারি দলের ভোটারদের দলীয় প্রার্থীদের প্রতি সমর্থনের অভাব অথবা ভাটা কিংবা অন্যান্য কারণ।

যাহোক, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের এমন ভোটার খরার কারণ নির্ণয় করতে গবেষণার প্রয়োজন। প্রয়োজন নির্মোহ গবেষণার। কারণ, গণতন্ত্রের ভবিষ্যতের এবং শক্ত ভিতে দাঁড় করানোর জন্য। প্রয়োজন নির্বাচনী ব্যবস্থাপনার ওপর ক্রমাগত অনাস্থার জায়গাটির পরিবর্তন। অথচ এবারের মেয়র প্রার্থীরা, বিশেষ করে দুই বড় দলের প্রায় সব দিক থেকে যোগ্য এবং তরুণ প্রজন্মের প্রার্থী। আমাদের দেশের টেকসই উন্নতির জন্য গবেষণা এবং এ ধরনের অনীহা রোধের প্রয়োজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। 

ড. এম সাখাওয়াত হোসেন নির্বাচন বিশ্লেষক, 

সাবেক সামরিক কর্মকর্তা এবং এসআইপিজির সিনিয়র ফেলো (এনএসইউ)