স্কুলে দুপুরে গরম খাবার দিন

বাংলাদেশে চরম দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ২ কোটি ৪১ লাখ। দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ৩ কোটি ৮৫ লাখ। আমাদের অনেক শিশু ভুগছে পুষ্টিহীনতায়। আমাদের বহু ছেলেমেয়ে স্কুলে যায় খালি পেটে। এখন আমরা যদি স্কুলে দুপুরবেলা গরম খাবার দিতে পারি, তাহলে তা হবে এক বিশাল ঘটনা, এটার সুফল হবে অনেক। এক. আমাদের গরিব এবং অতি গরিব শিশুদের পুষ্টি সমস্যার বেশ খানিকটা সমাধান হবে। সে কারণেই আমাদের দাবি হলো, সব স্কুলে যদি না-ও পারা যায়, গরিব জেলাগুলোয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দুপুরে গরম খিচুড়ি–ডিম দেওয়া হোক। দুই. এর ফলে স্কুলে শিশুদের উপস্থিতির হার বাড়বে; তা আমাদের প্রাথমিক পর্যায় থেকে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া কমাবে।

আমরা জানি, কাজটা ঝামেলাপূর্ণ এবং এই কাজে নামলে অনিয়মের অভিযোগ উঠবে, দুর্নীতির সমস্যা দেখা দিতে পারে। তবে ভয় পেয়ে ভালো কাজ থেকে দূরে থাকা উচিত হবে না। ঠিকঠাকভাবে তত্ত্বাবধান করা গেলে, এই কাজেও আমরা সফলতা দেখাব, দুর্নীতিমুক্ত এবং অব্যবস্থাপনামুক্ত মিড–ডে মিল চালু করে আমরা দেখিয়ে দিতে পারব, আমরাও পারি। আমাদের পাশের দেশ ভারতে এই কর্মসূচি চালু আছে। তারা পারলে আমরা পারব না কেন?

এরপর আমাদের চাওয়া হবে শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি। কোয়ালিটি এডুকেশন। আমাদের শিক্ষার িবস্তার বেড়েছে, কিন্তু মান কমে গেছে। একটা গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, তৃতীয় শ্রেণির অর্ধেকের বেশি ছেলেমেয়ে ভালোভাবে পড়তেই জানে না। ২০১৫ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, প্রাথমিক স্কুল পাস করা ১০ জনের ৯ জনই ক্লাস ফাইভের উপযোগী গণিত করতে পারে না। আরও চার বছর আগে ১০ জনে অন্তত ৪ জন এই অঙ্ক পারত।

শিক্ষার মান ভালো করার জন্য ১ নম্বর দরকার, শিক্ষকদের ক্লাসে যাওয়া এবং পাঠদান। ২ নম্বর, যোগ্য মানুষকে শিক্ষক পদে নিয়োগ দেওয়া। ৩ নম্বর, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং এসব কাজে নজরদারি দরকার হবে, দরকার হবে জবাবদিহির।

আশার কথা হলো, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন বলেছেন, ‘মিড–ডে মিল নীতিমালা মন্ত্রিসভায় পাস হয়েছে। আমরা মুজিব বর্ষে দেশের সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মিড–ডে মিল দেওয়ার চিন্তা করছি। চর-হাওরসহ দুর্গম এলাকাগুলোতে নতুন করে আরও স্কুল করতে চাচ্ছি। এসব এলাকায় স্থানীয় শিক্ষক দেওয়ার চেষ্টা করছি।’ (প্রথম আলো অনলাইনের খবর, ৩০ জানুয়ারি ২০২০) প্রতিমন্ত্রীর এই কথা শুনে আমরা খুবই প্রাণিত, উৎসাহিত বোধ করছি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে অর্থপূর্ণ কী করা যায়, যাতে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নের একটা চেষ্টা থাকবে? বই পড়া, রচনা লেখা, নাটক, সিনেমা, আতশবাজি, বক্তৃতা, ব্যানার, স্থাপনা—এসবেরও নিশ্চয়ই উপযোগিতা আছে, কিন্তু আরও অর্থপূর্ণ কিছু করা যায় কি? বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু যখন সারা জীবন স্বপ্ন দেখেছেন, বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর! দুঃখী মানুষদের জন্য কী করা যায়?

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দেশের মানুষ কী করে আমাদের স্বাধীনতা এনে দিলেন, সেই কাহিনি আমি লিখে যাচ্ছি উপন্যাস আকারে, বঙ্গবন্ধুর শৈশব থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত সময়পর্বের ছবি আঁকতে আমি এ পর্যন্ত ৫ খণ্ড বই লিখেছি, যারা ভোর এনেছিল, উষার দুয়ারে, আলো-আঁধারের যাত্রী, এই পথে আলো জ্বেলে এবং গতকাল প্রকাশিত হয়েছে এখানে থেমো না (প্রকাশক: প্রথমা)। রেহমান সোবহান গত বুধবার এক ভাষণে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ১৯৭০ সালের একটা স্মৃতির কথা উল্লেখ করেছেন। আমার বইয়ে সেই দৃশ্যটা এইভাবে আঁকা হয়েছে:

‘রেহমান সোবহান লঞ্চে উঠেছেন। বঙ্গবন্ধু যাচ্ছেন কালিগঞ্জ। তাজউদ্দীনের নির্বাচনী এলাকা। নদীর দুই ধারে মানুষ আর মানুষ। আদমজীনগরে শ্রমিকেরা এসেছে দল বেঁধে। তারা বঙ্গবন্ধুকে তাদের মধ্যে ডেকে নিল। তারা সমর্থন জানাল শেখ সাহেবকে। রেহমান সোবহান চোখ বড় বড় করে তাকান নদীর দুদিকে। লঞ্চ যাচ্ছে আর হাজার হাজার মানুষ নদীর দুই ধারে জড়ো হয়েছে। লঞ্চের পাশাপাশি মানুষগুলো ছুটে ছুটে যাচ্ছে নদীতীর ধরে। শেখ মুজিবের এ কী আকর্ষণ?

‘নদীতীরে একটা জায়গায় মঞ্চ বানানো হয়েছে। মাইকের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। হাজার হাজার মানুষ হাত তুলে শেখ মুজিবকে ডাকছে। শেখ মুজিবের সময় নাই। এমনিতেই আদমজীর শ্রমিকদের জমায়েতে অনির্ধারিত ভাষণ দিতে গিয়ে তাঁরা পিছিয়ে পড়েছেন। এখন কীভাবে নদীতীরের এই স্বতঃস্ফূর্ত সমাবেশে তিনি যোগ দেবেন। হ্যান্ডমাইকে জানিয়ে দেওয়া হলো, “আজ আমার সময় নাই, আরেক দিন আসা যাবে।”
‘জনতা কথা শুনল না। তারা নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। শত শত মানুষ সাঁতার কেটে আসছে মুজিবের লঞ্চের দিকে। তারা মুজিবকে চায়।
‘শেখ মুজিব এই ভালোবাসার দাবির কাছে নতিস্বীকার করলেন। তিনি আবেগাপ্লুত চোখে তাকালেন সেই মানুষগুলোর দিকে আর ধরা গলায় বললেন, “লঞ্চ ভেড়াও। মানুষগুলো তো না হলে পানিতে ডুবেই মারা যাবে।”
‘রেহমান সোবহানের মনে প্রশ্ন, শেখ মুজিব না বুর্জোয়াদের প্রতিনিধি! বামরা না শ্রমিক শ্রেণির প্রতিনিধি! তাহলে শ্রমিকেরা কেন জীবন দিতে প্রস্তুত এই মানুষটার জন্য? আমাদের বাম বন্ধুদের এটা জিজ্ঞেস করতে হবে।
‘রেহমান সোবহান বলেনও বঙ্গবন্ধুকে সেই কথা। আপনার পেছনে আছে গরিব মানুষ। গরিব কৃষক, গরিব শ্রমিক। এই গরিব মানুষদের জন্য আপনাকে কাজ করতে হবে। আমাদের সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির অঙ্গীকার থেকে নড়া চলবে না!
‘“আমি সেটা জানি ডক্টর সাহেব।” শেখ মুজিব আর্দ্র চোখে তাকান। নদীর ওপরে আকাশ, আকাশে সূর্য আর মেঘের খেলা, শেখ মুজিবের চোখের চশমার কাচে সেই মেঘ-রোদ্দুরের প্রতিবিম্ব। শোনেন, “সেই ’৫৪-এর ভোটের সময় গ্রামের বৃদ্ধা আমাকে তঁার পর্ণকুটিরে ডেকে নিয়ে গিয়েছিলেন। ত্রিকুলে তাঁর কেউ ছিল না। আমাকে গুড় আর মুড়ি খেতে দিয়ে আমাকে একটা সিকি দিয়ে বলেছিলেন, “আমার যে আর কিছু নাই বাবা, এই পয়সাটা রাখো!” আমি এই মানুষরে ভুলে যাব কীভাবে?
‘লঞ্চ ভটভট করে এগিয়ে যায়। সারেং সিটি বাজায়। দুই পাশ থেকে রব আসে, জয় বাংলা।’ (এখানে থেমো না)

ড. রেহমান সোবহান, আনিসুর রহমান, নুরুল ইসলাম প্রমুখ প্রগতিশীল পণ্ডিত আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ম্যানিফেস্টোতে বৈষম্যমুক্তির অঙ্গীকার যুক্ত করেছিলেন। সেটা বঙ্গবন্ধু জেনেশুনে বুঝে অন্তরে ধারণ করেছিলেন।

আরেকটা উদ্যোগ নিতে পারে বড় ক্লাসের ছাত্ররা। তারা আফটার স্কুল কোচিং ক্লাসের ব্যবস্থা করে দিতে পারে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে। হাসান ফেরদৌস ৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০ প্রকাশিত প্রথম আলোর কলামে সুন্দর একটা প্রস্তাব দিয়েছেন, বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন হোক জাতীয় সেবা দিবস। তিনি পৃথিবীর অন্যান্য দেশের বড় নেতাদের জন্মদিন উদ্যাপন থেকে শিক্ষা নিয়ে একটা দিন ভালো কাজে, সেবামূলক কাজে অংশ নিতে আহ্বান জানিয়েছেন। এটা খুব ভালো একটা আইডিয়া, সন্দেহ নেই। কিন্তু আমার সবচেয়ে বেশি পছন্দ হয়েছে সরকারের ইতিমধ্যে গৃহীত এই সিদ্ধান্ত যে, মুজিব বর্ষে বাংলাদেশের সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মিড–ডে মিল কর্মসূচি চালু করা। হাসান ফেরদৌসের পরামর্শমতো স্বেচ্ছায় সেবামূলক ভালো কাজ করতে পারে ছাত্ররা। মুজিব বর্ষে ছাত্রসংগঠনগুলো যদি নিজ নিজ এলাকার গরিব শিশুদের লেখাপড়ার কাজে সাহায্য করে এবং তা করে বিনা পয়সায়, স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে, তা হবে একটা চমৎকার ব্যাপার।

বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে আমরা কতক্ষণ আতশবাজি করলাম, কতটা বেলুন ওড়ালাম, কত বড় ব্যানার টাঙালাম, তাতে আসলে কিছুই যায় আসে না। কিন্তু আমরা যদি গাছ লাগাই আর গাছের যত্ন নিই, আমরা যদি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মিড–ডে মিল দিই, আর স্কুলগুলোর যত্ন নিই, শিক্ষার মানের দিকে নজর দিই, তা হবে সত্যিকার অর্থে একটা কিছু করা।

আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক