অর্থ পাচার নিয়ে জাতীয় সংসদে আলোচনা হোক

বিশ্বায়নের যুগে মানুষ এক দেশ থেকে আরেক দেশে গিয়ে কাজ করবেন, এটা অস্বাভাবিক নয়। বিভিন্ন সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে এক কোটির বেশি বাংলাদেশি বিদেশে কাজ করেন। তাঁরা শুধু কষ্টার্জিত অর্থ দেশে পাঠিয়ে পরিবার-পরিজনকেই বাঁচিয়ে রাখছেন না, বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডারও স্ফীত করছেন। 

বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশি শ্রমিকেরা ২০১৮ সালে ১ হাজার ৫৫০ কোটি মার্কিন ডলার (প্রতি ডলার বাংলাদেশি ৮৬ টাকার সমান) পাঠিয়েছেন, যা আগের বছরের চেয়ে ১৫ শতাংশ বেশি। ২০১৯ সালের হিসাব এখনো পাওয়া যায়নি। প্রবাসী আয়ে বিশ্বে ১ নম্বরে আছে ভারত, ২০১৮ সালে তারা আয় করেছে ৭ হাজার ৮৬০ কোটি ডলার। এরপর যথাক্রমে চীন, মেক্সিকো, ফিলিপাইন, মিসর, ফ্রান্স, নাইজেরিয়া, পাকিস্তান, জার্মানি ও ভিয়েতনাম। বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ১১তম এবং দক্ষিণ এশিয়ায় তৃতীয়। 

বাংলাদেশের কর্মীরা যেসব দেশে কাজ করেন, সেখানকার আইনকানুন তাঁদের মেনে চলতে হয়। না মানলে বিচারের মুখোমুখি হতে হয়। সংশ্লিষ্ট দেশের আইনানুযায়ী তাঁদের আয়কর পরিশোধ করতে হয়। অনেক দেশে বেতন পরিশোধের সময়ই আয়কর কেটে নেওয়া হয়। ফলে কর ফাঁকির সুযোগ কম। কর্মোপযোগী ভিসা না নিয়ে বিদেশে কেউ কাজ করতে পারেন না। ধরা পড়লে পত্রপাঠ ফেরত পাঠানোর বহু নজির আছে। 

কিন্তু বাংলাদেশে যেসব বিদেশি নাগরিক কাজ করেন অথবা যাঁরা বিদেশি কর্মীদের নিয়োগ দেন, তাঁরা আইনকানুনের তোয়াক্কা করেন না। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, বিদেশি কর্মীদের ভিসা পাওয়া থেকে শুরু করে তাঁদের নিয়োগ, বেতন-ভাতা পরিশোধ এবং দেশে অর্থ পাঠানোর ক্ষেত্রে ভয়াবহ অনিয়ম ও দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়া হচ্ছে। যেসব তদারক সংস্থার এসব দেখার কথা, তারাও অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশ। 

টিআইবির তথ্য–উপাত্ত বলছে, ২০১৮ সালে কর্মরত বিদেশি কর্মীরা বাংলাদেশ থেকে ২৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা পাচার করে নিয়ে গেছেন।
আর তাঁদের কর ফাঁকির পরিমাণ ১২ হাজার কোটি টাকা। 

বাংলাদেশে কত বিদেশ কর্মী আছেন, এই খাতে কত টাকা বিদেশে যাচ্ছে, সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না। একেক প্রতিষ্ঠান একেক তথ্য দিচ্ছে। 

বিদেশি কর্মীদের কর ফাঁকির বড় সুযোগ হলো পর্যটন ভিসায় এসে কাজ করা। আইনানুযায়ী পর্যটন ভিসায় এসে এখানে কেউ কাজ করতে পারেন না। পৃথিবীর কোনো দেশেই সেই সুযোগ দেওয়া হয় না। উন্নত দেশগুলোতে ছাত্রদের নির্দিষ্ট মেয়াদে কাজ করার সুযোগ দেওয়া হয়। পর্যটন করপোরেশনের তথ্যানুযায়ী, ২০১৮ সালে ৮ লাখ বিদেশি নাগরিক পর্যটক ভিসায় বাংলাদেশে এসেছেন। তাঁদের অন্তত ৫০ শতাংশ বা ৪ লাখ ভিসায় কাজের উদ্দেশ্যে এই ভিসা ব্যবহার করছে বলে টিআইবির গবেষণায় উঠে এসেছে। 

এসব ভিসার সর্বোচ্চ মেয়াদ তিন মাস হওয়ায় তাঁরা তিন মাস পরপর দেশে গিয়ে আবার ভিসা নিয়ে ফিরে এসেছেন। অর্থাৎ একজনকে বছরে গড়ে আড়াইবার ভিসা নিতে হয়। সে হিসাবে পর্যটন ভিসায় প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার বিদেশি কাজ করেছেন। এর সঙ্গে বৈধ বিদেশি কর্মী প্রায় ৯০ হাজার যোগ করলে মোট বিদেশি কর্মীর সংখ্যা ন্যূনপক্ষে আড়াই লাখ বলে ধারণা করা যাচ্ছে। জনপ্রতি ন্যূনপক্ষে গড় মাসিক বেতন দেড় হাজার ডলার ধরলে বিদেশি কর্মীদের মোট বার্ষিক আয় দাঁড়ায় ৪৫০ কোটি ডলার। ৩০ ভাগ স্থানীয় ব্যয় বাদ দিলে মোট পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ হবে ৩১৫ কোটি ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ২৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। আর এতে ন্যূনতম রাজস্ব ক্ষতি ১৩৫ কোটি ডলার বা প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা। 

গবেষণায় আরও বলা হয়, বাংলাদেশে কর্মরত বৈধ বিদেশির হিসাব নিয়ে সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে গরমিল রয়েছে। দেশে ৮৫ হাজার ৪৮৬ জন বিদেশি কর্মী কাজ করছেন বলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সংসদে জানিয়েছেন। অথচ ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের হিসাবে কর্মোপযোগী ভিসার সংখ্যা ৩৩ হাজার ৪০৫। আর বিডা, বেপজা ও এনজিও ব্যুরো—তিন সংস্থার দেওয়া কর্মানুমতির সংখ্যা ১১ হাজার ১৮০। 

টিআইবির তথ্যমতে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে কর অঞ্চল-১১-তে আয়কর রিটার্ন জমা দিয়েছেন সাড়ে ৯ হাজার বিদেশি, যাঁদের বার্ষিক আয় ৬০৩ কোটি টাকা। এ থেকে মোট কর পাওয়া গেছে ১৮১ কোটি টাকা। পোশাক খাতে একটি প্রতিষ্ঠানের বিদেশি প্রধান নির্বাহীর মাসিক বেতন গড়ে ১০ থেকে ১২ হাজার মার্কিন ডলার। দেখানো হয়েছে ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজার ডলার। আর শিল্পকারখানায় কাজ করেন এ রকম প্রকৌশলীর মাসিক বেতন ৩ থেকে ৬ হাজার ডলার হলেও দেখানো হয় ১ থেকে ২ হাজার ডলার। এভাবে বেতন-ভাতা কম দেখিয়ে রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া হয়।

বাংলাদেশে বৈধ প্রক্রিয়ায় বিদেশি কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম পেয়েছে টিআইবি। প্রথমত, সংশ্লিষ্ট পদে যোগ্য দেশি কর্মী খোঁজা হয় না। দ্বিতীয়ত, বিদেশি কর্মী নিয়োগপ্রক্রিয়া হয় অনেকটা লোকদেখানো। কাকে নেওয়া হবে, সেটা আগেই ঠিক করে রাখা হয়। এসব কর্মী নিয়োগে ভিসার সুপারিশপত্রের জন্য ৫-৭ হাজার টাকা, বিদেশে বাংলাদেশ মিশন থেকে ভিসা নিতে ৪ থেকে সাড়ে ৮ হাজার, কাজের অনুমতি নিতে ৫-৭ হাজার, পুলিশের বিশেষ শাখার ছাড়পত্র পেতে ৫-৭ হাজার, জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) ছাড়পত্রের জন্য ৩-৫ হাজার, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ছাড়ের জন্য ২-৩ হাজার ও ভিসার মেয়াদ বাড়ানোর জন্য ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা নিয়মবহির্ভূতভাবে দিতে হয়। 

৪৪টি দেশ থেকে আসা বিদেশিরা বাংলাদেশে বিভিন্ন খাতে কর্মরত। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কাজ করেন ভারতীয় নাগরিকেরা। এরপর আছে যথাক্রমে চীন, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, তাইওয়ান, থাইল্যান্ড, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, তুরস্ক, নরওয়ে ও নাইজেরিয়া। সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের অনেকেই ওয়ার্ক পারমিট ছাড়া কাজ করছেন। 

এ বিষয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামানের সঙ্গে কথা হয় গতকাল। তিনি বলেছেন, এখানে বিদেশি কর্মীদের কাজ বন্ধ করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। তাদের প্রয়োজন আছে, তবে আইন ও নীতিমালা মেনে চলতে হবে। টিআইবির প্রতিবেদন পেলে তদন্ত করে দেখা হবে বলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী  যে মন্তব্য করেছেন, সে সম্পর্কে তিনি বলেন, সংশ্লিষ্ট বিভাগে প্রতিবেদনটি দেওয়া হয়েছে। এই প্রতিবেদনে কিছু সুপারিশও করা হয়েছে। সরকার চাইলে কারিগরি সহযোগিতা করতেও আমরা প্রস্তুত। 

মানুষের শরীরের কোথাও ক্ষত সৃষ্টি হলে অস্ত্রোপচার করে তা ভালো করতে হয়। কিন্তু পুরো শরীরে ক্ষত ছড়িয়ে পড়লে তা সারানোর কোনো উপায় থাকে না। বিদেশি কর্মী নিয়োগপ্রক্রিয়ার ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে। বিদেশি কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে যেসব আইন ও নীতিমালা আছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বিদেশি নাগরিক–সম্পর্কিত আইন ১৯৪৬, বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনা আইন (সংশোধিত) ২০১৫, বাংলাদেশ ভিসা নীতিমালা (সংশোধিত) ২০০৭, বিদেশি নাগরিক নিবন্ধন বিধিমালা, ১৯৬৬, আয়কর অধ্যাদেশ–১৯৮৪ ও বিনিয়োগ বোর্ড নির্দেশনা, ২০১১। এগুলো ঠিকঠাক অনুসরণ ও পালন করলে কোনো বিদেশি কর্মী দেশ থেকে অর্থ পাচার বা কর ফাঁকি দিতে পারতেন না। কিন্তু এসব আইন তদারকির দায়িত্বে যাঁরা নিয়োজিত, তাঁরা তাঁদের দায়িত্ব পালন করছেন না বলেই দেশ এভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। 

কোনো সরকারি সংস্থা বা সেবা প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি নিয়ে টিআইবি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করলেই সরকারের নীতিনির্ধারকেরা হইচই করে ওঠেন। তাঁদের দাবি, উন্নয়ন ব্যাহত ও সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করতেই সংস্থাটি এসব করছে। অতীতে জাতীয় সংসদেও টিআইবি কার্যক্রম নিয়ে সরগরম আলোচনা হয়েছে। কিন্তু সরকার একটু তলিয়ে দেখলে বুঝতে পারত,  িআইবি এই গবেষণার মাধ্যমে দেশের উপকারই করেছে। বিদেশি কর্মীরা দেশ থেকে অর্থ পাচার করছে, এই তথ্য দিয়ে টিআইবি আর যা-ই হোক বিদেশিদের স্বার্থ হাসিল করছে না। দেশের স্বার্থ সুরক্ষা করছে। 

বর্তমানে জাতীয় সংসদের অধিবেশন চলছে। সরকারের উচিত হবে রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর নিয়মমাফিক আলোচনা স্থগিত রেখে হলেও টিআইবির রিপোর্টটি নিয়ে আলোচনা করা। বিদেশি কর্মী নিয়োগের নামে কারা অর্থ পাচার ও কর ফাঁকিতে সহায়তা করছে, তাদের খুঁজে বের করা হোক। 

টিআইবি এই হিসাব দিয়েছে ২০১৮ সালের। এখন ২০২০ সাল। এই সময়ে কর ফাঁকি ও অর্থ পাচারের পরিমাণ নিশ্চয়ই আরও বেড়েছে। 

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি