লাখো ভর্তিযোদ্ধা এবার রেহাই চান

অভিন্ন ভর্তি পরীক্ষায় সময় ও অর্থ বাঁচবে সব পরীক্ষার্থীর
অভিন্ন ভর্তি পরীক্ষায় সময় ও অর্থ বাঁচবে সব পরীক্ষার্থীর

বিতর্কটি পুরোনো। নতুন সিদ্ধান্ত দরকার দ্রুত। বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিন্ন ভর্তি পরীক্ষার চেষ্টা চলছে বহুদিন। অথচ তাতে জয়ী হয়ে আছে বিরোধীরাই। বিস্ময়কর যে এ বিষয়ে লাখ লাখ শিক্ষার্থীর বিপরীতে সংখ্যালঘিষ্ঠের মতই বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। শিক্ষা খাতে সংস্কারের বড় এক বাধা অপসারণে বিলম্বিত হচ্ছে এভাবে। এমনকি মহামান্য রাষ্ট্রপতির চাওয়ার পরও।

শিক্ষার্থীদের কথা ভাবুন

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সমন্বয় ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা মঞ্জুরি কমিশন। তাদের সিদ্ধান্ত—আগামী পরীক্ষা হবে সবাই মিলে। সংখ্যাগরিষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সম্মতি আছে এতে। তবে কয়েকজনের মনোভাব বিপরীত। মঞ্জুরি কমিশন চাইছে, সব বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অভিন্ন পদ্ধতিতে মানবিক, ব্যবসায় ও বিজ্ঞানে আলাদা পরীক্ষা হোক। কমিশন এ-ও চাইছে, উপাচার্যদের সংগঠন ‘বিশ্ববিদ্যালয় পরিষদ’ বসে আলোচনার মাধ্যমে এ রকম পরীক্ষা নেওয়ার কারিগরি দিক ঠিক করুক। কিন্তু কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অসম্মতিতে এগোচ্ছে না সমন্বিত পদ্ধতির কারিগরি কাজ। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষক যে বিরুদ্ধে, তা-ও নয়। কেবল অল্পসংখ্যক শিক্ষক উদ্যোগটি থামাতে বিরূপ প্রচারণা চালাচ্ছেন। এসব প্রচার ও বক্তব্য দেখে মনে হচ্ছে, ভর্তি পরীক্ষা যেন কেবল বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষকদের বিষয়। এটায় যে শিক্ষার্থীদের স্বার্থই মুখ্য, সেটা অগ্রাহ্য হচ্ছে। লাখ লাখ শিক্ষার্থীর কথা বলার জায়গা নেই। তাঁদের কোনো মুখপাত্র নেই। অথচ তাঁদের জন্যই শিক্ষা খাতে সংস্কার দরকার।

বিপুল অপচয় থেকে ভর্তিযোদ্ধারা রেহাই চান

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এখন প্রায় ৫০টি। শিক্ষার্থী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়ছে। প্রতিযোগিতাও তীব্র। ভর্তি নিশ্চিত করতে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরাও মরিয়া। একাধিক প্রতিষ্ঠানে ভর্তিযুদ্ধে লিপ্ত হতে হচ্ছে সদ্য কলেজ পেরোনো তরুণ-তরুণীদের। যানজটের দেশে এই অবস্থা লাখ লাখ পরিবারের জন্য অমানবিক। অল্প সময়ে ৫৫ হাজার বর্গমাইলজুড়ে আসা-যাওয়া দুরূহ। সচরাচর অভিভাবকদেরও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সফরে যেতে হয়। লাখ লাখ মানুষ একই সময়ে এক স্থানে গিয়ে থাকা-খাওয়ার মুশকিলে পড়ে। পড়ে দুর্ঘটনায়ও। ভর্তি মৌসুমে এক তারিখে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়েও পরীক্ষা থাকে। এতে শিক্ষার্থীরা অনেক পছন্দের জায়গায় পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ পান না।

অভিন্ন ব্যবস্থা হলে সময় ও অর্থ বাঁচত সব পরীক্ষার্থীর। সবাই নিজ জেলায় পরীক্ষা দিতে পারতেন। দূরদূরান্তে যাওয়ার মানসিক চাপ ও হয়রানি থেকেও রেহাই মিলবে। অভিভাবকেরাও পরিত্রাণ পাবেন দৌড়াদৌড়ির দুর্ভোগ থেকে। অনেক বিদ্যাপীঠও আয়োজনের কোলাহল থেকে মুক্তি পেত।

অনুষদ ভাঙা–গড়ায় ফি-বাণিজ্যের প্রভাব

স্বতন্ত্র ভর্তি পরীক্ষায় লাভ কেবল গুটিকয়েক শিক্ষক ও কোচিং সেন্টারের। সঙ্গে আছেন গাইড লেখক, পরিবহন ব্যবসায়ী এবং টাকা লেনদেনের মোবাইল অপারেটররা।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আলাদা পরীক্ষার ন্যায্যতা হিসেবে মৃদু কিছু স্বাতন্ত্র্য জারি রেখেছে। এই ভিন্নতাকে ব্যবহার করে গড়ে উঠেছে জেলা পর্যন্ত শত শত কোচিং ঘর। বের হচ্ছে হরেক গাইড। শিক্ষার্থীরা ভর্তি নিশ্চিত করতে প্রায় সবাই একাধিক কোচিংয়ে যান, গাইড বই কেনেন। কোচিং ব্যবসায়ীরাও আয় নিশ্চিত করতে তিন মাসের পুরো কোচিং ফি শুরুতেই নিয়ে নেন। এ রকম ফি ১০ থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত। যদি ৩ লাখ শিক্ষার্থী ২০ হাজার করেও কোচিংয়ে ব্যয় করেন, তাহলে কেবল এ থেকে কোচিং সেন্টারগুলোর আয় ৬০০ কোটি টাকা।

পরীক্ষা পদ্ধতি অভিন্ন হলেও কোচিং উঠে যাবে না। কিন্তু এর দাপট কিছুটা কমবে। বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে ভর্তিতে একটা জাতীয় শৃঙ্খলাও আসবে। বর্তমানে যেভাবে ভর্তি মৌসুম শুরু হয়, তা নৈরাজ্যময়। কয়েক ডজন বিশ্ববিদ্যালয় পৃথক দিনে বিজ্ঞাপন দিচ্ছে, পৃথকভাবে আবেদন চাইছে। গ্রামগঞ্জের শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞাপন দেখা, আবেদন করা সহজ নয়। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় আবার অনেকগুলো অনুষদ করে পৃথকভাবে আবেদন চায়। পুরো প্রক্রিয়ায় গণব্যবসায়ের আলামত। নিম্নবিত্ত শিক্ষার্থীদের জন্য যা বিড়ম্বনাস্বরূপ।

 ৩ লাখ শিক্ষার্থী যদি ৫০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাত্র ৫টিতে ২টি করে অনুষদে আবেদন করেন, তাতেই খরচ ৩০০ কোটি। অনুষদপ্রতি গড়ে এক হাজার টাকা করে এই হিসাব করা হলেও অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে খরচ আরও বেশি। আছে ‘বিকাশ’, ‘রকেট’ আর কম্পিউটার সেন্টরগুলোর খরচও। অনেক শিক্ষার্থী ১০-১৫ জায়গায়ও আবেদন করছেন। গাড়ি ভাড়া, হোটেল ভাড়া, খাবার খরচ মিলে ৩ লাখ অভিভাবকের ব্যয়ের অঙ্কটি অনেক বড়।

 এ রকম প্রক্রিয়া শেষে আবার দেখা যায়, শত শত আসন খালি থাকছে। অনেক শিক্ষার্থী এক স্থানে বাছাই হয়েও অপর বিশ্ববিদ্যালয়ে চেষ্টা করেন। আরেক দল এভাবে সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। নীরব একজাতীয় অপচয় এটা।

অর্থের লোভ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এত প্রবল হয়েছে, অনেক বিশ্ববিদ্যালয় এক অনুষদ ভেঙে কয়েকটি বিভাগ নিয়ে আরেক অনুষদ বানাচ্ছে। এসব অনুষদে আলাদা ফি দিয়ে আলাদা পরীক্ষা হয়। ঢাকার নিকটবর্তী একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞানের কেবল একটি বিষয়ের ১৫০টি আসনের জন্য পৃথক অনুষদ তৈরি করা হয়েছে। সেখানেও লাখো শিক্ষার্থীকে পৃথকভাবে বড় অঙ্কের টাকা দিয়ে আবেদন করতে হচ্ছে। একটি বিষয়ের জন্য ১০ শিফটে পরীক্ষা হচ্ছে ১০ রকমের প্রশ্ন দিয়ে। ১০ রকমের পরীক্ষায় একই পদের জন্য মান যাচাই বিস্ময়কর। হয়তো টাকার ক্ষুধার জন্যই এমন কিছু।

ভর্তি ফি নির্ধারণেও আছে অযৌক্তিক নৈরাজ্য। কর্তাব্যক্তিরা ইচ্ছেমতো সেটা ঠিক করছেন। অনেক স্থানে ফি নেওয়ার পরও প্রাথমিক বাছাই পরীক্ষার আগেই অনেককে বাদ দেওয়া হয়। যাঁকে পরীক্ষা দিতে দেওয়া হচ্ছে না, তাঁর ফি নেওয়ার কোনো ব্যাখ্যাও মিলছে না। এসব অনাচার চলছে স্বায়ত্তশাসনের নামে। প্রশ্নপত্র তৈরিতেও আছে বিপুল খামখেয়ালি। শিক্ষার্থীদের এই গিনিপিগ অবস্থায় মঞ্জুরি কমিশন দর্শকের ভূমিকায়। বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভর্তিপ্রক্রিয়া থেকে গড়ে ১০-১২ কোটি টাকা আয় করলেও কী প্রক্রিয়ায় তা বিলিবণ্টন হচ্ছে, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিজস্ব কোষাগারে তার কতখানি জমা পড়ছে, সে বিষয়ে মঞ্জুরি কমিশনই ভালো বলতে পারবে।

জনস্বার্থে ‘ঐতিহ্য’ পাল্টানো যায়

অনেকের মত, বর্তমান ভর্তিব্যবস্থা টিকে আছে আর্থিক কারণে। ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে যে বিপুল অর্থ আদায় হয়, তা হাতছাড়া হওয়ার শঙ্কা থেকেই অভিন্ন ধাঁচের বিরোধিতা। বিরোধীরা অবশ্য প্রকাশ্যে বলছে ভিন্ন কথা। তাদের মতে, সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের মান পড়ে যাবে। দুর্নীতির সুযোগ বাড়বে। তাদের দাবি, বুয়েট, ঢাবি, জাবিতে পৃথকভাবে ভর্তি পরীক্ষার ‘ঐতিহ্য’ রয়েছে।

এত দিন অবশ্য পরীক্ষার দুর্নীতিতে নামীদামি প্রতিষ্ঠানকেই এগিয়ে থাকতে দেখা গেছে। এর সবচেয়ে বড়টিতে গত দুবছরই সমস্যা ঘটেছে। কোনো কোনো ইউনিটে দুবার পরীক্ষা হয়েছে। নিরপরাধ বহু শিক্ষার্থী একবার বাছাই হয়ে পরে অ–বাছাই হয়ে গেছেন। ভুলভাবে ফলাফল ঘোষণারও উদাহরণ আছে। গতবারই এটা হলো।

তা ছাড়া দুর্নীতির সুযোগ এবং প্রশাসনকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা একক প্রতিষ্ঠানে যতটা সহজ, সমন্বিত ব্যবস্থায় তার চেয়ে কমই থাকে।

সবচেয়ে হাস্যকর ‘ঐতিহ্য’-এর পবিত্রতার প্রসঙ্গ। জনগণের স্বার্থে সব ‘ঐতিহ্য’ পাল্টানো যায়। ঐতিহ্য ভালো কাজ না করলে প্রশাসন ও সরকারের হস্তক্ষেপ না করার কারণ থাকতে পারে না। ‘স্বায়ত্তশাসন’ জনস্বার্থের ঊর্ধ্বে, ধরাছোঁয়ার বাইরের বিষয় নয়। শিক্ষার্থীদের স্বার্থকে অবজ্ঞা করে বিদ্যাপীঠের স্বায়ত্তশাসন অশোভন।

স্বতন্ত্র ভর্তি পরীক্ষায় ‘মান’ পড়ে যাওয়ার দাবিও অস্পষ্ট। স্বতন্ত্র পরীক্ষায় যদি ‘মানসম্মত’ শিক্ষার্থীই মেলে, তাহলে বুয়েট, ঢাবি, রাবি, জাবি আন্তর্জাতিক র‍্যাঙ্কিংয়ে কেন নাম লেখাতে পারছে না, সে প্রশ্নও থেকে যায়।

ভর্তি পরীক্ষা বিতর্কের সবচেয়ে অগণতান্ত্রিক দিক, এতে মূল পক্ষকে অনুপস্থিত রাখা। শিক্ষার্থীদের কথা কেউ ভাবছে না। তঁাদের কথা কেউ শুনছে না। ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে মতামত রেখে চলেছেন কেবল শিক্ষক ও শিক্ষা কর্মকর্তারা। দেশের ছাত্রসংগঠনগুলোও এ বিষয়ে নীরব। তবে তারা উদাসীন হলেও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নবীন শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশার মূল্য দেবে বলে আশা করা যায়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় জনগণের অর্থে পরিচালিত। জনস্বার্থই সেখানে প্রাধান্য পেতে হবে। গুটিকয়েক শিক্ষকের অর্থ-স্বার্থ দেখার চেয়ে লাখ লাখ শিক্ষার্থীর শিক্ষা-স্বার্থ দেখা সরকারের জন্য জরুরি। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন নিশ্চল কোনো বিষয় নয়। জনস্বার্থেই এর ব্যাখ্যা ও প্রয়োগ করতে হবে।

কোনো দেশেই পুরোনো প্রথা সংস্কারে সবাই একমত থাকে না। সমাজের বৃহত্তর স্বার্থ এবং তরুণ-তরুণীদের প্রয়োজনকেই অগ্রাধিকার দিতে হয়। শিক্ষকেরা নয়, তরুণেরাই দেশের ভবিষ্যৎ। জনস্বার্থের বিপরীতে শক্তিমত্তা প্রদর্শন অনাকাঙ্ক্ষিত।

আলতাফ পারভেজ: দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ের গবেষক