সহি উনিশনামা: আকবর দ্য গ্রেট

কী অদ্ভুত সংকল্প আকবরের। বোনের মৃত্যুর বারো দিনের মাথায় বিশ্বকাপ জয়! ছবি: আইসিসি
কী অদ্ভুত সংকল্প আকবরের। বোনের মৃত্যুর বারো দিনের মাথায় বিশ্বকাপ জয়! ছবি: আইসিসি

বাঙালিরা একে অহংকারী, দুইয়ে বন্ধু, তিনে তিড়িংবিড়িং, চারে চৌচির, পাঁচে প্যাঁচ, ছয়ে ছত্রখান, সাতে সম্ভাবনা...এমন করে করে ‘ওরা এগারোজন’ মানে জয়। জয়ের জন্য ক্ষুধার্ত কয়লাখনির গর্তের মতো হাঁ হয়ে থাকে ক্রিকেটভক্তদের মন। জয়ের ঢলে সেই গর্তের পেট ভরে টইটুম্বুর থাকবে কয়েক দিন। সেই ভরা পেটে টোকা দিলে তো বাজবেই। বাজুক বাজুক। বহুদিন পর বড় কোনো জয় বাংলাদেশের। তাজা জয় তাজা তাজা উপভোগ করাই ভালো। বাকি কথা পরে। শাবাশ উনিশ, শাবাশ তোমাদের ইনোসেন্স।

আমাদের এখন বহু দিকে হতাশা। রাজনীতির কথায় মজলিশ নীরব থাকাই ভালো মনে করে। কিন্তু খোঁচা দিচ্ছে অর্থনৈতিক গ্রাফের পতনমুখী তির। হতাশার এতসব রেকর্ড খেলার জয় দিয়ে খামোশ করে দেওয়া গেলে মন্দ হয় না। আগামীকাল থেকে পরিস্থিতি তো যেই কি সেই। আজকের আনন্দে তাই বলে কঞ্জুস হওয়া কভু নয় কভু নয়। ওটা আমাদের ধাতই না।

আগের জয়গুলোর মতো এবারের জয়ও পুরোনো শিক্ষাটাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে। অনূর্ধ্ব–১৯ দলের নেতা আকবর আলীও দেখালেন। ধীরস্থির, চৌকস ও দল-অন্তঃপ্রাণ নেতা পেলেই বাংলাদেশিরা অসাধ্য সাধন করতে পারে। যত দিন মাশরাফি দুনিয়াবি বিষয়ের বাইরে থেকে দলের তেমন নেতা ছিলেন, তত দিন তিনিও আমাদের জয় দিয়েছেন, পরাজয়ের কার্নিশ থেকে লাফ দিয়ে জয়ের আকাশে উড়িয়েছেন। কী অদ্ভুত সংকল্প আকবরের। বোনের মৃত্যুর বারো দিনের মাথায় বিশ্বকাপ জয়!

আকবর, শরীফুল, নতুন সাকিব, নতুন তামিমদের আমরা চিনি। ঢাকা শহরের বাইরে যান, যেখানে গ্রাম-মফস্বল কি জেলাশহর, সেখানকার ছেলেমেয়েদের দেখুন। সেখানে এখনো মাঠ আছে, নগরায়ণ তাঁদের আত্মা ও দেহকে খেয়ে ফেলতে পারেনি। অধ্যবসায়ের নির্জনতা আর সময়-সুযোগ এখনো সেখানে আছে। যখন নগর থেকে কেবল দুঃসংবাদ আসে, তখন এসব জেলাশহর, নিমশহরের ছেলেমেয়েরা রিজার্ভ ফোর্সের মতো তৈরি হতে থাকে, জাতীয় জীবনে ‘হিরো’র জোগান দিতে থাকে। অনূর্ধ্ব–১৯ দলের খেলোয়াড়দের অধিকাংশই ঢাকার বাইরের সন্তান, এমনকি তাদের কোচরাও সেলিব্রিটি ঘরানার বাইরে নীরবে তাঁদের কাজটা করে গেছেন।

নামগুলো দেখুন, চেহারা দেখুন, লাজুক হাসি দেখুন, আবার জয়ের পরের জিগির দেখুন; আদর করে যে নিজেদের আমরা মধ্যবিত্ত বলি, এরা সেসব নিম্নমধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান। নারী ক্রিকেট দলের সালমারাও তাই। ফুটবলের ছেলেমেয়েরাও তাই। সহি মধ্যবিত্ত সন্তানেরা কমই এখন খেলাধূলায় আসে। আকবরেরা সেই শ্রেণি থেকে উঠে আসা, যারা প্রবাসে কাজ করে বা দেশে নানা রকম উদ্যোগ-আয়োজন করে জাতির চাকাটা গড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্র, সমাজ, প্রতিষ্ঠান কেবল নামধারী রাষ্ট্রিকতার ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। জনগণের আত্মবিশ্বাস কেবল যুদ্ধ কিংবা অর্থনীতির মাঠে প্রমাণিত হয় না। জাতীয় সক্ষমতা খেলা থেকে শুরু করে সাহিত্য এবং সাংস্কৃতিক জলবায়ু থেকেও অক্সিজেন নেয়—নিতে পারে।

আমাদের জাতীয় সক্ষমতার একটা পরিচয় ক্রিকেট থেকেও পাওয়া যায়। দেখা যায়, এখনো গ্রাম-মফস্বল থেকে তাজা প্রাণের জোগান আসছে। প্রথম ধাপে এরা খুব ভালো করে। কিন্তু অচিরেই উচ্চপদস্থ ভুল লোকের হাতে পড়ে কেউ বিগড়ে যায়, কেউ কোণঠাসা হয়, কেউ চেপে যায়, কেউবা ধুঁকে ধুঁকে চলতে থাকে। আমাদের নিচের তলাটা এখনো সম্ভাবনাধর, ওপর তলাতেই যত বিষ। হুমায়ূন আজাদ লিখেছিলেন, যত ওপরে যাবে তত নীল, যত নিচে যাবে মধু। এখন যত ওপরে যাবে তত বিষ, যত নিচে যাবে তত তেজি কাঁচামাল। এটা কৃষি-সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য। বাংলার কৃষকেরা খুব জেদি আবার খুব আবেগপ্রবণ হয়। একা একা তাঁরা জমিতে পোকার মতো উবু হয়ে কাজ করেন। কিন্তু ডাকাত তাড়াতে কিংবা মুক্তিযুদ্ধে এই কৃষকসন্তানেরা যৌথভাবে অসাধ্য সাধন করে, যদি ঠান্ডা মাথার দূরদর্শী ও বিশ্বাসী নেতৃত্ব তারা পায়। দক্ষিণ আফ্রিকায় যে ফাইনাল খেলা হলো, ১৯ বছর বয়সী আকবর আলীর মধ্যে তেমন ঠান্ডা মাথার সংগ্রামী নেতার আভাস দেখেছি আমরা।

জয়ের উচ্ছ্বাসটাও আকবর আলীর মতোই হওয়া চাই। বিনীত ও বিচক্ষণ। জয়ের পরদিন মানে নতুন লড়াই সামনে। সেই লড়াইটাকে যেন ক্রিকেটের ব্যবস্থাপনায় ঢুকে পড়া জুয়াড়ি, ক্লাব-মাফিয়া, ক্ষমতার বিভীষণেরা যেন নষ্ট করতে না পারে। বাংলার মাটি অতীতেও বিশ্বমানের খেলোয়াড় উপহার দিয়েছে, এখনো সাকিব-তামিমরা আরও অনেক কিছু করার ক্ষমতা রাখে। মুশকিলটা অন্য জায়গায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, জগতে যোগ্য নায়ক আছে, কিন্তু তাকে দেখাবার যোগ্যমঞ্চ অনেক সময়ই মেলে না। আমাদেরও যোগ্য সন্তান আছে, তাদের গড়ে তোলার যোগ্য প্রতিষ্ঠান নেই। যোগ্য মঞ্চে আমরা যাই, কিন্তু গ্রিনরুমে ঢুকে পড়ে অযোগ্য লোক। আমরা দুনিয়ার যেকোনো দলকেই খেলার মাঠে হারাতে পারি, যদি আমরা আমাদের ভেতরকার ভেজালগুলো সরাতে পারি।

তা যখন পারি না, তখন দারুণ সম্ভাবনাময় তরুণেরা উদ্দেশ্য হারিয়ে ফেলে। কেউ বখে যায় কারুকে টেনে নিয়ে যায় অন্তহীন হতাশা। ইংল্যান্ডের বিখ্যাত ফুটবল ক্লাব ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ও ম্যানচেস্টার সিটির কথা ফুটবল সমঝদার সবাই জানেন। ম্যানচেস্টার ইংল্যান্ডের এক শিল্পশ্রমিকের শহর। উনিশ শতকের মাঝামাঝি এই শহরে তরুণ গ্যাংগুলোর মারামারি আর ছোরা-সন্ত্রাসের মহামারি দেখা যায়। রাস্তায় প্রায়ই দুই গ্রুপের মারামারি লেগে যেত; শিকার হতো সাধারণ পথচারীরাও। ১৮৯০ সালের দিকে শহরটির কিছু দূরদর্শী মানুষ একটা বুদ্ধি করলেন। তাঁরা শহরজুড়ে শ্রমিক যুবকদের ক্লাব তৈরি করে বস্তিবাসী যুবকদের খেলা ও বিনোদনের সুযোগ করে দিলেন। তরুণ বয়সের গরম রক্ত সুস্থ খাতে বয়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়ে মাস্তানি ছেড়ে দিল। মাস্তানির উন্মাদনার জায়গা নিল ফুটবল ‘উন্মাদনা’। সে সময়ই ওই শহরে প্রতিষ্ঠিত হয় ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ও ম্যানচেস্টার সিটি ক্লাব। বাকিটা ইতিহাস।

এই সময়েও ব্রাজিল ও কলম্বিয়া এই কৌশল নিয়ে সফল হয়েছে। মাস্তানপ্রবণ এলাকায় ফুটবল ক্লাব গড়ে দেওয়ার পর দেখা যায়, অপরাধ কমে গেছে। ওসব দেশ যে নিয়মিতভাবে ফুটবল প্রতিভা তুলে আনতে পারে, তার কারণ এসব সমাজমুখী উদ্যোগ। আমাদের কিশোর-তরুণেরা পাড়ায় পাড়ায় গ্যাংবাজি করে বেড়াচ্ছে। খুনোখুনি ও নেশায় নিজেরাও মরছে, দেশটাকেও ভোগাচ্ছে। যে মানসিক জোশ থেকে তারা গ্যাং বানায়, সেই জোশকে খেলাধুলার খাতে নিয়ে যাওয়া কঠিন কিছু না। দুঃখিত, এ ক্ষেত্রেও নেতৃত্বের সংকট। তাদের কারণেই পঁচিশেই ফুরায়। আকবরদের বেলায় সেটা যাতে না হয়, সেই চেষ্টা তাদেরও থাকুক, জাতিরও থাকুক। এদিক থেকে খেলার সঙ্গে রাজনীতি না মেশানোই ভালো।

ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
[email protected]