জানতে হবে কোথায় থামতে হবে

ইয়াসির আজমান
ইয়াসির আজমান

ইন্টারনেট ভৌগোলিক দূরত্বকে জয় করে আমাদের জীবনকে করেছে সহজ। আজকাল কিছু সময় ইন্টারনেট বিচ্ছিন্ন হলে একধরনের শূন্যতা অনুভূত হয়। প্রতিদিনের কর্মক্ষেত্রে বা দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে ইন্টারনেট সন্দেহাতীতভাবে নির্ভরযোগ্য যোগাযোগমাধ্যমে পরিণত হয়েছে। পোস্টম্যানের চিঠি বা ল্যান্ডফোন সেবা দেখে যাঁরা বড় হয়েছেন, তাঁরা সহজেই হয়তো ইন্টারনেটের সুফল সবচেয়ে ভালো বুঝতে পারেন।

ইন্টারনেট ও ইন্টারনেটভিত্তিক সেবায় বাংলাদেশে প্রতি মাসে গড়ে ১১ লাখের বেশি মানুষ যুক্ত হচ্ছে। সব মিলিয়ে এখন দেশে মোট ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ১০ কোটি। এই সংখ্যা বলে দিচ্ছে দেশের অর্ধেকের বেশি মানুষ কোনো না কোনোভাবে ইন্টারনেট সেবার আওতায় আছে। বাংলাদেশের ৪০ বছরের কম বয়সীদের প্রায় ৭৪ শতাংশ অর্থাৎ অধিকাংশই ইতিমধ্যে ইন্টারনেট ব্যবহার করছে।

বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪১ শতাংশই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণের সময় কোনো না কোনোভাবে ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। এটি একদিকে যেমন খুবই অনুপ্রেরণার, একই সঙ্গে অনেক বড় দায়িত্ব।

ইন্টারনেটে সবচেয়ে শক্তিশালী ও জনপ্রিয় ব্যবহার হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সহজলভ্যতা বদলে দিচ্ছে আমাদের গতানুগতিক চিন্তাধারা ও জীবনযাপন। ইন্টারনেটে সামাজিক যোগাযোগের প্ল্যাটফর্মগুলো মানুষের মতামত প্রকাশের সবচেয়ে সহজলভ্য মাধ্যম হিসেবে কাজ করছে। ইন্টারনেটভিত্তিক একটি স্মার্ট ডিভাইসের উপযুক্ত ব্যবহার যেমন শিক্ষা, বিনোদনের অবারিত সুযোগ তৈরি করতে পারে, তেমনি স্মার্ট ডিভাইসের অপব্যবহার আমাদের জীবন ও সমাজে ক্ষতিকর প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে।

আমাদের গবেষণা বলছে, এ বছর অর্থাৎ ২০২০ সালে প্রযুক্তি বিশ্বে সবচেয়ে আলোচিত হবে ফাইভ-জি। ফাইভ-জি প্রযুক্তির বিকাশ আইওটি এবং আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সংযুক্ত প্রযুক্তির ব্যবহার বহুগুণে বাড়িয়ে দেবে। সম্ভাবনা রয়েছে ই-সিমসহ উদ্ভাবনী সব প্রযুক্তিতে চলে আসার। আর এ প্রযুক্তি যেমন জীবনকে করে তুলবে সহজ, তেমনি একই সঙ্গে ডিপ ফেকের মতো বিষয়গুলোর মাধ্যমে সামাজিক বিভ্রাট তৈরি করতে পারে।

তাই এ ক্ষেত্রে বিশ্বজুড়েই প্রযুক্তিবিদদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে সাইবার নিরাপত্তা। নতুন নতুন সব প্রযুক্তির সঙ্গে কিছু উপসর্গ থাকেই, যেখানে সাইবার নিরাপত্তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আশঙ্কা করা হচ্ছে, ডিপ ফেক বা মিথ্যা সংবাদ ও গুজব আর অনাকাঙ্ক্ষিত নানা বিষয় প্রযুক্তি দুনিয়ায় চ্যালেঞ্জ হিসেবে থাকবে।

এই পরিপ্রেক্ষিতে ইন্টারনেট সচেতনতা ও নিরাপত্তার বিষয়টি বারবার সামনে আসছে। ডিপ ফেক ও ফেক নিউজের কারণে বিশ্বজুড়ে প্রায় প্রতিনিয়তই প্রকাশিত হচ্ছে ভুয়া সংবাদ ও গুজব; ঘটছে ইন্টারনেটে বুলিং, বিভিন্ন রকম প্রতারণা, ব্যক্তিগত তথ্য চুরিসহ আরও অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। সম্প্রতি বিশ্ব পরিচিত হয়েছে ফেক নিউজের ‘ডিজিটাল হাইড্রা’ টার্মের সঙ্গে এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর ক্ষতিকর প্রভাবও বাড়ছে, যা ক্রমান্বয়ে ভার্চ্যুয়াল জগতের সীমানা ছাড়িয়ে প্রভাব রাখছে আমাদের বাস্তব জীবনেও। ইন্টারনেটের এ ধরনের অপব্যবহারের ক্ষেত্রে আমাদের নতুন প্রজন্মই রয়েছে সবচেয়ে ঝুঁকিতে। ইন্টারনেট যদি কেবল একমুখী যোগাযোগের উৎস হতো, সে ক্ষেত্রে হয়তো ঝুঁকির মাত্রা নানাবিধ ফিল্টার কিংবা প্যারেন্টাল কন্ট্রোলের প্রয়োগে নিয়ন্ত্রণযোগ্য হতে পারত। কিন্তু ইন্টারনেট কেবল আর একমুখী সংযোগের জগৎ নয়। ইন্টারনেটের প্ল্যাটফর্মগুলোতে ইউজার অ্যাকাউন্ট তৈরির সুযোগ এবং দ্বিমুখী যোগাযোগের সুযোগ থাকায় অপরিচিত কারও সঙ্গে সহজেই যোগাযোগ তৈরির সম্ভাবনা থেকেই যায়। আর এভাবেই বাড়তে থাকে ঝুঁকি কিংবা সাইবার অপরাধ ঘটার আশঙ্কা।

ইন্টারনেট নামক এ উন্মুক্ত প্ল্যাটফর্মের দায়িত্বশীল ব্যবহার যেমন কোটি মানুষের জীবনকে সহজ করে তোলে, তেমনি এ মাধ্যমে দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ এক বড় ক্ষতির কারণ হয়ে উঠতে পারে। তাই সচেতন হতে হবে বাবা, মা, শিক্ষক, সন্তান, অভিভাবক সর্বোপরি সবাইকে। ব্যক্তি পর্যায়ে ইন্টারনেটের ঝুঁকি আর তা প্রতিরোধের উপায় সম্পর্কে যেমন জানতে হবে, তেমন কোনটি অপরাধ আর কোন ধরনের কাজের পরিণাম কী হতে পারে, সে সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকলে অনেক অপরাধ ঘটার আশঙ্কা কমে যাবে।

গত বছরের শেষের দিকে আমরা কাজ শুরু করেছিলাম ইন্টারনেট নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির একটি কর্মসূচি নিয়ে। ‘ইন্টারনেটের দুনিয়ায় জানতে হবে কোথায় থামতে হবে’—এ কর্মসূচির মাধ্যমে আমরা ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের কাছে জানাতে চেয়েছিলাম ব্যক্তিগত জীবন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে। আমাদের ইন্টারনেট বিশ্বে গতিবিধি কেমন হওয়া উচিত এবং ইন্টারনেট জগতের ঝুঁকি সম্পর্কে অবহিত ও প্রতিরোধের উপায় সম্পর্কে সচেতন হওয়া উচিত।

ইন্টারনেট ব্যবহারে দায়িত্বশীল হতে শেখার পক্ষে জনসচেতনতা তৈরি করলেই ইন্টারনেটের সর্বোচ্চ সুফল পাওয়া নিশ্চিত হবে। বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ৩৪ লাখের বেশি শিশু প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে। এত বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীকে নিরাপদ ইন্টারনেট বিষয়ে সচেতন করে গড়ে তুলতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারে পাঠ্যসূচিতে নিরাপদ ইন্টারনেট ব্যবহারের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা।

লেখক: প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও), গ্রামীণফোন