দিল্লির নির্বাচন: বিত্ত ও ক্ষমতা নতজানু, জয়ী আম আদমি

অরবিন্দ কেজরিওয়াল। ছবি: রয়টার্স
অরবিন্দ কেজরিওয়াল। ছবি: রয়টার্স

রাজধানী-রাজ্য দিল্লিতে এই মুহূর্তের জনপ্রিয় স্লোগান অরবিন্দ কেজরিওয়াল জিন্দাবাদ, ঘৃণা ও দ্বেষের রাজনীতি মুর্দাবাদ।

এই স্লোগানের জন্ম মঙ্গলবার দুপুর থেকে। কিন্তু তার আগে দুটো বিষয় অনেকের মনেই খচখচ করেছে। প্রথমটা নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহর ক্ষমতা নিয়ে। কয়েক বছর ধরেই এমন একটা ধারণা সৃষ্টি করা হয়েছে যে এই জুটির অসাধ্য কিছু নেই। তাঁরা যা করবেন বলে ঠিক করেন, তা করতে পারেন। ব্যর্থ হন না। যাতেই হাত দেন সফল হন। দিল্লিতেও তাঁরা সেই ভেলকি দেখাবেন, এমন একটা ধারণা কীভাবে যেন ছড়িয়ে গিয়েছিল। মনে হচ্ছিল, শেষ পর্যন্ত মরা কই মাছকেও তাঁরা জ্যান্ত করে দেবেন।

দ্বিতীয় খচখচানি প্রথমটারই একটা এক্সটেনডেড চ্যাপটার। ভোটের রায় যা–ই হোক, ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএমে কারচুপি ঘটিয়ে মোদি-শাহ জুটি পাশার দান উল্টে দেবেন না তো? এই খচখচানিটা তীব্র বেগে সংক্রমিত হয়ে যায় চব্বিশ ঘণ্টা কেটে গেলেও নির্বাচন কমিশন মোট প্রদত্ত ভোটের হার না জানানোয়। কানাকানি শুরু হয় ইভিএমে কারচুপি নিয়ে। শোনা যেতে থাকে, বিজেপি নিশ্চয় ইভিএমে কিছু একটা করবে, যেহেতু দিল্লিতে তারা হারতে চায় না। মঙ্গলবার বেলা একটা নাগাদ দুই খচখচানিই অবশ্য দূর হয়। দেখা যায়, প্রাপ্ত ভোটের হার ও আসনসংখ্যা প্রায় এক রেখে আরও পাঁচ বছরের জন্য অরবিন্দ কেজরিওয়ালই দিল্লি শাসন করবেন। তিনিই দিল্লির বেতাজ বাদশাহ।

প্রমাণিত হয়, মোদি-শাহ জুটি অজেয় নয়, ইভিএমেও ইচ্ছেমতো কারসাজি করা যায় না।

ক্ল্যাসিক্যাল পলিটিকসের নিয়ম মেনে আম আদমি পার্টির নেতা অরবিন্দ কেজরিওয়াল এবারের এই ভোটের লড়াইয়ে নেমেছিলেন। পাঁচ বছরের অর্ধেকটা তিনি ব্যয় করেন কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করে। কারণে-অকারণে কখনো উপ–রাজ্যপাল, কখনো বা খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের সঙ্গে তিনি বিবাদে জড়িয়েছেন। সপার্সদ ধরনায় বসেছেন। দিল্লি পুলিশ, যা কিনা তাঁর অধীন নয়, তাদের শত্রু বানিয়েছেন। নাগরিক পরিষেবার দিকে নজর দেননি। এই সময় ভোট-কুশলী সংগঠক প্রশান্ত কিশোরের সঙ্গে তাঁর পরিচয়। নরেন্দ্র মোদি যখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী, বছর চল্লিশের এই যুবক তখন তাঁর ভোট প্রচারের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। পরে কখনো কংগ্রেস, কখনো সংযুক্ত জনতা দল, কখনো বা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেসের নির্বাচনী কৌশল ঠিক করার দায়িত্ব নিয়েছেন। কেজরিওয়ালকেও তিনি এবারের ভোটে সাহায্য করেছেন। বছর আড়াই আগে কাজে হাত দিয়ে তাঁর প্রথম পরামর্শ ছিল, কেন্দ্রের সঙ্গে ঝগড়া বন্ধ করুন। পাঁচ বছর রাজত্ব করার পর জনতা আপনার কোনো কৈফিয়ত বরদাশত করবে না। তারা কাজের খতিয়ান চাইবে। ভোটটা আপনাকে ইতিবাচক করে তুলতে হবে।

কেজরিওয়াল সেই যে ঝগড়া থামালেন, দ্বিতীয়বার আর সে পথে হাঁটলেন না। সচেষ্ট হলেন সাধারণ ও নিম্নবিত্তদের কিছু পাইয়ে দিতে। ন্যূনতম সরকারি পরিষেবাগুলো পৌঁছে দিতে। বিনা পয়সায় মাসে ২০০ ইউনিট বিদ্যুৎ ও ২০ হাজার লিটার জল দেওয়ার শুরু তখন থেকেই। সরকারি হাসপাতাল ও স্কুলগুলোর দিকে নজর দিলেন। স্বাস্থ্য পরিষেবাকে নিয়ে এলেন পাড়ায় পাড়ায়। খুলে দিলেন কয়েক শ মহল্লা ক্লিনিক। সরকারি পরিষেবাকে দালালমুক্ত করে প্রশাসনকে জনমুখী করে তুলতে সচেষ্ট হলেন। বিনা টিকিটে নারীদের সরকারি বাসযাত্রার ব্যবস্থা করলেন। সুরক্ষার জন্য বাসে বাসে নিযুক্ত করলেন মার্শাল। যে দলের নামকরণ তাঁরই, কেজরিওয়াল সেই আম আদমি পার্টিকে সাধারণ মানুষের কাছের ও নিজের বলে মনে করাতে শেখালেন। রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে জনতার বেড়ে যাওয়া দূরত্ব কমাতে লাগলেন। জনতা মনে করতে লাগল, এটা তাদেরই দল। এই ধারণা এখনো প্রবল বলেই ভোটের সময় এই দল স্বেচ্ছাসেবকের ভিড়ে উপচে ওঠে। উৎসাহীরা ভালোবেসে পথে নামে। স্বেচ্ছাশ্রমে ব্রতী হয়।

প্রচারের মাঝপথে বিজেপি যে উন্নয়নের এই রাজনীতি ছেড়ে হিন্দু জাতীয়তাবাদকে আঁকড়ে ধরবে, কেজরিওয়াল ও তাঁর ব্রিগেড তা বুঝতে পারেনি। এটা যদি তাঁদের ব্যর্থতা হয়, তাহলে সাফল্য অবশ্যই ওই ফাঁদে পা না দেওয়া। এই সুবুদ্ধিও প্রশান্ত কিশোরের দেওয়া। প্রচারের আগাগোড়া লক্ষ করলে দেখা যাবে, কেজরিওয়ালরা একবারের জন্যও সিএএ, এনআরসি, কাশ্মীর অথবা ৩৭০ অনুচ্ছেদ মুখে আনেননি। জেএনইউ, জামিয়া মিলিয়া বা শাহিনবাগের আন্দোলনের কথাও উচ্চারণ করেননি। দেশপ্রেম বা দেশদ্রোহ নিয়ে মাথা ঘামাননি। ভুলেও সমালোচনা করেননি প্রধানমন্ত্রীকে। ফাটা রেকর্ডে আটকে পড়ার মতো সারাক্ষণ ঘ্যান ঘ্যান করে গেছেন বিজলি-পানি-সড়ক-শিক্ষা-স্বাস্থ্যের মতো নাগরিক পরিষেবা নিয়ে। এর পাল্টা মোদি-শাহ এবং তাঁদের অনুগামীদের কণ্ঠে বেজেছে জাতীয়তাবাদের সুর।

ভোটের ফল প্রকাশের পর বিজেপির এখন অনুধাবন করা উচিত, একই টোটকায় সব রোগ সারে না। অতঃপর তারা হিন্দু জাতীয়তাবাদ, জাতপাত ও ধর্মীয় বিভাজনের বাইরে বের হবে কি না, সে সিদ্ধান্ত মোদি-শাহ জুটিকেই নিতে হবে।

বিজেপির এই ভরাডুবির কারণ অনেক। কিন্তু একটা বড় কারণ, গত পাঁচ বছরেও দিল্লির কাউকে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তুলে না ধরা। এমনিতে দিল্লিতে বিজেপির মুখ বাড়ন্ত নয়। হর্ষবর্ধন আছেন। বিজয় গোয়েল আছেন। মীনাক্ষী লেখি রয়েছেন। তাঁদের কাউকে না বেছে বিজেপি তুলে ধরল ভোজপুরি সিনেমার অভিনেতা মনোজ তিওয়ারিকে। মনোজ দিল্লির সাংসদ হলেও দিল্লির নন। তিনি বারানসির মানুষ। পূর্বাঞ্চলীয়। ২০০৯ সালে সমাজবাদী পার্টির টিকিটে উত্তর প্রদেশের গোরক্ষপুর কেন্দ্র থেকে দাঁড়িয়ে হেরেছিলেন। দল বদল ঘটিয়ে তাঁকে দিল্লি এনে ভোটের দায়িত্ব দেওয়ার একটাই কারণ, পূর্বাঞ্চলীদের সমর্থন জোটানো। বিজেপির বোঝা উচিত ছিল, দিল্লির পোড় খাওয়া দলীয় নেতারা এই চাপিয়ে দেওয়া মানবেন না। তাঁরা কেউ মানেনওনি।

না মানার বিষয়ও গাদা গাদা। ক্ষমতা দখলের জন্য প্রচারের মাঝপথে বিজেপির নেতারা যেভাবে কুকথার বিষ ছড়িয়েছেন, যেভাবে হিংসা ছড়াতে প্ররোচনা জুগিয়েছেন, ঘৃণার আগুনে বাতাস দিয়েছেন, গুলি ছুড়েছেন, বহু শিক্ষিত মানুষ তা মানতে পারেননি। এই মানুষেরাই কিন্তু আট মাস আগে লোকসভা ভোটে নরেন্দ্র মোদিকে সমর্থন করেছেন। তাঁরা দেখেছেন, বিজেপির ‘হাইপার ন্যাশনালিজম’-এর বিপরীতে দাঁড়িয়ে কেজরিওয়াল ঘরের ছেলের মতো হাসিমুখে পরিষেবার কথা বলছেন। আগামী দিনে আরও উন্নত পরিষেবার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। প্রতিপক্ষের কুকথা গায়ে মাখছেন না। দেশীয় রাজনীতিতে যা বহুদিন কর্পূরের মতো উবে গেছে, সেই বিনম্রতা ও শালীনতার প্রত্যাবর্তনকে দিল্লির আম আদমি সাদরে বরণ করে নিয়েছে। কেজরিওয়ালের প্রচার ঘৃণা ও বিদ্বেষের রাজনৈতিক আবহে বসন্তের বাতাসের মতো ফুরফুরে। এই আবহও বহুকাল অদৃশ্য ছিল।

কেজরিওয়ালরা উচ্চাশী নন। দিল্লির বাইরে হরিয়ানা ও পাঞ্জাবে আম আদমি পার্টির উপস্থিতিও সমীহ জাগানোর মতো আহামরি কিছু নয়। বিজেপির মতো গোটা দেশের ভার কেজরিওয়াল তাঁর কাঁধে তুলে নেননি। দিল্লিই তাঁর ‘ফোকাস এরিয়া’। বিজেপিকে দুরমুশ করায় তাঁর কতটা লাভ ও প্রতিপক্ষের কতটা ক্ষতি, অতঃপর সেই বিচার উঠে আসতে বাধ্য। রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, মহারাষ্ট্র, ঝাড়খন্ডের পর এবার দিল্লি বিজেপিকে যে ধাক্কাটা দিল, তা সামলে তাদের প্রস্তুত হতে হবে অক্টোবরে বিহারের ভোটের জন্য। দিল্লির রায় সিএএ ও এনআরসির বিরুদ্ধে গণভোট কি না, তার মীমাংসাও বিজেপিকেই করতে হবে। যদি তা–ই হয়ে থাকে, বিহার নিয়ে তা হলে তাদের চিন্তাগ্রস্ত হতে হবে। বছর পার হলেই আসাম, পশ্চিমবঙ্গ, তামিলনাড়ু ও কেরালায় মহাসংগ্রাম।

মুখ্যমন্ত্রী হয়েও কেজরিওয়াল কিন্তু ছিটেফোঁটা বদলাননি। পাঁচ বছর শাসনের পরেও তাঁর বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের কোনো অভিযোগ ওঠেনি। ভারতীয় রাজনীতিতে এই ভাবমূর্তি আজকাল বিরল। ওটাই এই সাবেক আমলার ‘ইউএসপি’(ইউনিক সেলিং প্রপোজিশন)। শীতকালে সোয়েটার-মাফলার, গ্রীষ্মে বুশ শার্ট ও চটি জুতায় তিনি যেন পাশের বাড়ির ছেলে, যাঁর বাড়িতে কড়া নেড়ে ঢুকে পড়া যায়। যাঁকে ভালোবাসা যায়। ভরসা করা যায়।

দিল্লির ভোট অনেক কিছুই দেখিয়ে দিল। হয়তো শেখালও। অমিত শক্তিধর বিজেপি কোনো শিক্ষা পেল কি না, আগামী দিন তার প্রমাণ দেবে।

সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়:প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি