অর্থ পাচার: সন্দেহজনক লেনদেনে আমরা কোথায়

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল অব বাংলাদেশের (টিআইবি) সদ্য প্রকাশিত প্রতিবেদনে বছরে প্রায় সাড়ে ২৬ হাজার কোটি টাকা পাচার হয় বলে দাবি করা হয়েছে। টাকার অঙ্কটা এত বেশি কি না, সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। তবে এটা অর্ধেকের কাছাকাছি হলেও এটা যে গভীর উদ্বেগজনক, তাতে সন্দেহ নেই। বিষয়টি সরাসরি অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত। এভাবে অর্থ পাচারের ঘটনায় শুধুই অর্থনৈতিক বিধিবিধান লঙ্ঘনের বিষয় নেই, এর সঙ্গে সন্ত্রাসী কর্মে অর্থ জোগানের ঝুঁকিটাও থাকে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ বিভাগ তফসিলি ব্যাংক কর্তৃক গ্রাহকের হিসাব খোলা ও পরিচালনাকালে তাঁদের পরিচিতি নিশ্চিতকরণ ও সংরক্ষণের রীতি-পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত নির্দেশনা প্রদান করে থাকে। যদিও কিছু কিছু তফসিলি ব্যাংক এ নিয়মগুলো কঠোরভাবে অনুশীলন করছে না। এ কারণে বেশ কিছু ব্যাংকের কর্মকর্তা ও গ্রাহকের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংসহ বেশ কিছু অপরাধের কারণে মামলা হয়েছে এবং বর্তমানে সেগুলো চলমান। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ গ্রাহক পরিচিতি সংরক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিধায় এ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন।

অনেক সময় দেখা যায়, বিভিন্ন সংস্থার পরিচালকের পদের আড়ালে অনেকে অবৈধ উপায়ে বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্জনপূর্বক সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে অবৈধভাবে বিনিয়োগ করছেন। এ ক্ষেত্রে দেখা যায়, অভিযুক্ত ব্যক্তি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নম্বরের পাসপোর্ট ব্যবহার করে থাকেন। অর্থাৎ একই ব্যক্তি আট থেকে নয় বছরে ছয়-সাতবার পাসপোর্ট পরিবর্তন করেছেন এবং বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্জন করেছেন, যা তাঁর জ্ঞাত আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় মর্মে প্রতীয়মান বা প্রমাণিত হয়।

এমনও দেখা গেছে, একই দিনে একই ব্যাংকের একই শাখায় বিপুল পরিমাণ টাকা জমা করেছেন এবং একই দিনে পে-অর্ডারের মাধ্যমে কোটি টাকা উত্তোলন করেছেন। প্রকৃতপক্ষে ওই হিসাবে জমাকৃত টাকারও কোনো উৎস খুঁজে পাওয়া যায়নি। সে ক্ষেত্রে দুর্নীতি দমন কমিশনকে সঠিক সময়ে স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তি অবরুদ্ধ না করলে ওই অভিযোগসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি কর্তৃক যেকোনো সময় সম্পদ হস্তান্তরিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে এবং বিচারকালে রাষ্ট্রের অনুকূলে তা বাজেয়াপ্ত করা সম্ভব হয় না। এ ক্ষেত্রে সন্দেহজনক লেনদেনের বিষয়টি অতীব গুরুত্বপূর্ণ। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২-এর ধারা ২-এর (য) উপধারায় সন্দেহজনক লেনদেনকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। যেমন সন্দেহজনক লেনদেন বলতে বোঝায়, ‘যাহা স্বাভাবিক এবং সাধারণ লেনদেনের ধরন হইতে ভিন্ন বা যে লেনদেন অপরাধ হইতে অর্জিত সম্পদ বা কোন সন্ত্রাসী কার্যে, কোন সন্ত্রাসী সংগঠনকে বা সন্ত্রাসীকে অর্থায়ন।’

মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে রিপোর্ট প্রদানকারী সংস্থার গুরুত্ব অপরিসীম, কারণ রিপোর্ট প্রদানকারী সংস্থার রিপোর্ট ছাড়া বড় বড় আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মানি লন্ডারিংয়ের অনুসন্ধান, তদন্ত ও বিচারকাজ পরিচালনা অসম্ভব। রিপোর্ট প্রদানকারী সংস্থার বিষয়টি অতীব গুরুত্বপূর্ণ।

অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন দমনে দুদক, বিএফআইইউ, সিআইডি (পুলিশ), শুল্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তর; এনবিআরকে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি রিপোর্টিং এজেন্সি এবং তার মান অনেক বাড়াতে হবে। এসব প্রতিষ্ঠানকে নিজেদের মধ্যে আরও সমন্বয় বাড়াতে হবে। এলসি-সংক্রান্ত আর্থিক অপরাধের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং এনবিআরের মধ্যে প্রযুক্তিগত সমন্বয় বেশি প্রয়োজন। কারণ, যখন কোনো ব্যাংকে এলসি খোলা হয়, যে পরিমাণ টাকার এলসি খোলা হয়েছে, সে পরিমাণ পণ্য আনা হয়েছে কি না, তা দেখার দায়িত্ব এনবিআরের। সে জন্য এনবিআর ও ব্যাংকের মধ্যে একটি আন্ত-অনলাইন সম্পর্ক প্রয়োজন।

মানি লন্ডারিং অপরাধ প্রতিরোধে রিপোর্ট প্রদানকারী সংস্থার দায়দায়িত্বের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে গ্রাহকের হিসাব পরিচালনাকালে গ্রাহকের পরিচিতির সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ তথ্য সংরক্ষণ করা; কোনো গ্রাহকের হিসাব বন্ধ হলে বন্ধ হওয়ার তারিখ থেকে অন্যূন পাঁচ বছর পর্যন্ত ওই হিসাব ও হিসাবের লেনদেনসংক্রান্ত তথ্য সংরক্ষণ করা; সংরক্ষিত তথ্যাদি বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের চাহিদা মোতাবেক সময়-সময় সরবরাহ করা; সন্দেহজনক লেনদেন বা লেনদেনের প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হলে নিজ উদ্যোগে অবিলম্বে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটে সন্দেহজনক লেনদেনের রিপোর্ট করা। এ জন্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ গ্রাহক পরিচিতি সংরক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিধায় এ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন।

মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে তথ্য ফাঁস করা বা মিথ্যা তথ্য দেওয়া অপরাধ। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের কাছে কোনো সন্দেহজনক লেনদেন রিপোর্ট করা হলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক বা কোম্পানির সব কর্মকর্তা-কর্মচারী বা মালিকপক্ষের সব সদস্যের জন্য এ–সংক্রান্ত তথ্যাদি গোপন রাখা বাধ্যতামূলক হয়ে দাঁড়ায়। এ ছাড়া মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের চাহিদা মোতাবেক যাচিত তথ্য প্রদান করার বাধ্যবাধকতাও বাংলাদেশে কর্মরত ব্যাংক বা বিমা বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য প্রযোজ্য।

সন্ত্রাসে অর্থায়ন ও মানি লন্ডারিং দুটি ভিন্ন বিষয় হলেও একটির সঙ্গে অপরটি ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। আইনের পরিভাষায় মানি লন্ডারিং হলো অবৈধ পন্থায় সম্পত্তি বা অর্থ অর্জন বা বৈধ সম্পদে বা অর্থের অবৈধ পন্থায় স্থানান্তর বা ওই কাজে সহায়তা করা। অপর দিকে সন্ত্রাসে অর্থায়ন হলো নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে (যা সমাজের বা জাতির জন্য ক্ষতিকর) অর্থের জোগান দেওয়া।

সন্ত্রাসে অর্থায়ন ও মানি লন্ডারিংয়ে ব্যবহৃত কলাকৌশল অনেকটা একই ধরনের। অর্থের উৎস গোপন করা কিংবা সন্ত্রাসে অর্থায়নে মোটামুটি একই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। সন্ত্রাসে অর্থায়ন ও মানি লন্ডারিংয়ের মধ্যে পার্থক্য খুঁজলে দেখা যায় যে সাধারণত অধিকতর মুনাফা অর্জন বা অবৈধ উপায়ে সম্পদ অর্জনের উদ্দেশ্যে মানি লন্ডারিং করা হয়ে থাকে। অপর দিকে কোনো একটি বিশেষ আদর্শ বা বিশ্বাসে উদ্দীপ্ত হয়ে কোনো অপরাধ সংঘটন বা ওই অপরাধমূলক কাজে সহায়তা করার উদ্দেশ্যে সন্ত্রাসে অর্থায়ন করা হয়ে থাকে। মানি লন্ডারিংয়ের ক্ষেত্রে অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ বা সম্পদ গোপন করা বা লুকানোর উদ্দেশ্যে সম্পদের রূপান্তর বা হস্তান্তর করা হয় কিন্তু সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ব্যবহৃত সম্পদ কোনো বৈধ উৎস কিংবা কোনো সন্ত্রাসী কার্যকলাপ থেকে অর্জিত অথবা উভয়ভাবেই অর্জিত হতে পারে।

প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অপরাধী চক্রও নতুন নতুন কৌশল উদ্ভাবন এবং মানি লন্ডারিং কার্যক্রমে তা কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে সক্ষম হচ্ছে। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অর্থব্যবস্থার মাধ্যমেই তারা এসব অবৈধ কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। একইভাবে বিশ্বসম্প্রদায়ও, বিশেষ করে উন্নত দেশগুলো মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে নতুন নতুন কৌশল উদ্ভাবন এবং প্রয়োগ করছে। তবে উন্নয়নশীল দেশগুলোর এসব উদ্যোগ-প্রচেষ্টা এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে বলা যায়। দেশে উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে চ্যালেঞ্জও বাড়ছে। বদলে যাচ্ছে অপরাধের ধরন, আগে অর্থনীতির আকার ছিল ছোট, তাই অপরাধের আকারও ছিল ছোট, তবে এখন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ব্যাংক, স্টক মার্কেটসহ আর্থিক খাতে বড় বড় অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। দেশের অর্থনীতি এবং মানুষের জীবনযাত্রায় এটি গুরুতর প্রভাব ফেলছে। বিচারাধীন মামলা, তদন্ত কার্যক্রম, অনুসন্ধান কার্যাবলি আইন ও বিধি মোতাবেক নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করে দৃশ্যমান অগ্রগতি হলেই বোঝা যাবে আমাদের অবস্থান কোথায়।


মো. খুরশীদ আলম খান বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট, দুর্নীতি দমন কমিশনের সিনিয়র প্রসিকিউটর ও ঢাকা ল রিপোর্টার্সের (ডিএলআর) সম্পাদক