জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতা প্রতিরোধে করণীয়

জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতা প্রতিরোধ, ধর্ষণ বন্ধ করা এবং আইনানুগ শাস্তির দাবি নিয়ে গত কয়েক সপ্তাহে বাংলাদেশি মানবাধিকারকর্মী, নারী আন্দোলনকর্মী ও শিক্ষাবিদেরা জোরালো বক্তব্য দিয়েছেন। তাঁদের বক্তব্যের জোরালো বার্তা হচ্ছে, যৌন হয়রানি একটি অমার্জনীয় অপরাধ। যৌন হয়রানি ও জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতা সমাজের প্রতিটি মানুষের জীবনের জন্য হুমকিস্বরূপ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের চরম রূপ। যৌন হয়রানি ও জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতা প্রতিরোধে বাংলাদেশ বহু উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। ২০১৯ সালের নভেম্বরে জাতিসংঘ এবং বাংলাদেশের মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে ২৫০ জনের বেশি সরকারি–বেসরকারি, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, শিক্ষাবিদ ও উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠান জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতা মোকাবিলা, ধর্ষণের মূল কারণ খুঁজে বের করা ও ধর্ষণ বন্ধের কার্যকর পদক্ষেপ চিহ্নিত করার জন্য একত্র হয়েছিল।

ব্যাপক আলোচনার পর জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতা ও ধর্ষণ প্রতিরোধের জন্য ১০ দফার একটি কার্যকর কর্মপরিকল্পনা নেওয়া হয়। সুশীল সমাজ সংগঠন, উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠান এবং জাতিসংঘের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনসহ মোট ৩০টি সংগঠন তা অনুমোদন করেছে। যেসব আচরণ ও মনোভাব জেন্ডারবৈষম্য এবং কন্যাশিশু ও নারীর প্রতি সহিংসতাকে উৎসাহিত করে, বর্তমানে জাতিসংঘ ও অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠান সেসব আচরণ ও মনোভাব পরিবর্তনের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।

জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতা প্রতিরোধে ও ধর্ষণের সঠিক কারণসমূহ চিহ্নিত ও গভীরভাবে অনুধাবন করতে সক্ষম না হলে এর প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়াও সম্ভব হবে না। নারীর প্রতি সহিংসতার ধরন বুঝতে এবং তা প্রতিরোধে সামাজিক পরিবর্তন আনতে হলে এটা বিশ্বাস করতে হবে যে নারীর প্রতি সহিংসতা তার প্রতি বৈষম্যের একটি ধরন ও এর বহিঃপ্রকাশ। সহিংসতা ও ধর্ষণের জন্য কোনোভাবেই নারী দায়ী নয়। বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে খুবই উদ্বেগজনক বিষয় হচ্ছে ধর্ষণের শিকার নারীকে ন্যায়বিচার ও সুরক্ষা দেওয়ার বদলে আদালতে তার শ্লীলতা ও চরিত্র নিয়ে বিশ্লেষণ করা হয়। ধর্ষণের শিকার নারীকে প্রকাশ্যে তার চরিত্র ও ঘটনার পেছনে তার উদ্দেশ্য সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়, যা নারীর জন্য চরম অবমাননাকর এবং এর মাধ্যমে আরেক দফায় তার মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হয়। 

কোনো অবস্থাতেই ধর্ষণের শিকার নারীকে তার আচরণ, পোশাক, কথা বলা বা হাঁটার ধরন নিয়ে দোষারোপ করা যাবে না। এর দায় শুধু ধর্ষকের। কিন্তু জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতা ও ধর্ষণ একমাত্র অপরাধ, যেখানে প্রায়ই অপরাধীর বিচার না করে সমাজ ভুক্তভোগীকে দায়ী সাব্যস্ত করে। প্রচলিত রীতিনীতি এবং নারী-পুরুষের চিন্তা ও আচরণের ধরন পরিবর্তনের মাধ্যমে ভুক্তভোগীকে দোষারোপ করা ও সহিংসতাকে স্বাভাবিকভাবে দেখার প্রবণতা রোধ করা সম্ভব।

যখন আমরা জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতা ও ধর্ষণ প্রতিরোধে কাজ করি, তখন নির্যাতনের শিকার নারীকে আমাদের এমনভাবে প্রাথমিক সেবা দিতে হবে, যাতে সে সমন্বিতভাবে একসঙ্গে মানসিক, চিকিৎসা, শারীরিক, কাউন্সেলিং আইনি সেবা পায়। নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে পুরুষালি আচরণ সম্পর্কে যে ভুল ধারণাগুলো পুরুষের মধ্যে বিদ্যমান, নারী-পুরুষের বৈষম্য এবং নারীদের নীচু করে দেখার যে মনোভাব, সেগুলোকে ভাঙতে হবে, প্রতিবাদ করতে হবে।

১০ দফা কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী বিদ্যালয়ে বয়সভিত্তিক সমন্বিত যৌনশিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনায় আমরা সহায়তা প্রদান করব এবং জাতীয় শিক্ষা পাঠ্যক্রমে এই কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত করার সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা গ্রহণ করব। পাশাপাশি মা-বাবাদের আমরা উৎসাহিত করব, যাতে তাঁরা যৌনতাকে নিষিদ্ধ বিষয় হিসেবে না দেখে এ সম্পর্কে সন্তানকে সঠিক তথ্য, ধারণা ও শিক্ষা দেন।

 দ্বিতীয় যে বিষয়টির ওপর আমরা জোর দিয়েছি, সেটি হলো যৌন সহিংসতাবিষয়ক বর্তমান আইন ও নীতিমালা আরও শক্তিশালী করা। বাংলাদেশ নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলোপ সনদ, শিশু অধিকার সনদ এবং নিপীড়নবিরোধী সনদসহ অনেক আন্তর্জাতিক সনদ বাস্তবায়নে অঙ্গীকারবদ্ধ। এসব সনদেই নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের জন্য সরকারকে সুপারিশ করা হয়েছে। নারী আন্দোলন এবং আইনি সংগঠনগুলোর একান্ত প্রচেষ্টার ফলে ২০১৮ সালে হাইকোর্ট ধর্ষণের প্রমাণ হিসেবে প্রচলিত ‘দুই আঙুল পরীক্ষা’কে অবৈধ ঘোষণা করেছেন, যা একটি অত্যন্ত সময়োপযোগী ও সঠিক পদক্ষেপ।

যৌন হয়রানিবিষয়ক হাইকোর্টের নির্দেশিকাসহ অন্যান্য আইনের সঠিক বাস্তবায়ন এবং সহিংসতার শিকার নারীর সুবিচার ও সমন্বিত সেবাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কর্মরত জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে আমাদের সহযোগী সংগঠনগুলোকে সব সহায়তা প্রদানে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কাজের অভিজ্ঞতা থেকে তারা জানিয়েছে, ধর্ষণ ও অন্যান্য যৌন সহিংসতার শিকার নারীরা আইনি সহায়তা নিতে গেলে কতটা ভোগান্তির শিকার হয়। যেসব আদালত নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতাবিষয়ক মামলার দায়িত্বে থাকেন, তাঁদের যথেষ্ট দক্ষতার অভাব রয়েছে। কিছু কিছু জেলায় মাত্র ৩ শতাংশ মামলায় দণ্ডাদেশ দিয়েছে। আমরা বিচার বিভাগের দক্ষতা ও সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক কার্যক্রম এবং আদালতে ভুক্তভোগীকেন্দ্রিক সুরক্ষা সেবা ও নীতিমালা তৈরিতে সহায়তা দিতে প্রস্তুত। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা যাতে জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতা ও ধর্ষণ প্রতিরোধে দায়িত্বসহকারে ও দ্রুত আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করে, সে জন্য আমরা তাদের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী।

অত্যন্ত প্রয়োজনীয় সেবার ক্ষেত্রে, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় ওয়ান–স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার এবং ২৪ ঘণ্টা জাতীয় হেল্পলাইন সেবা চালু করেছে। সম্প্রতি জাতিসংঘ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন সেবা প্রদানকারীদের জন্য জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতা ও ধর্ষণের শিকার নারীদের সেবা ব্যবস্থাপনা–সম্পর্কিত প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করেছে। সরকারি হাসপাতালগুলো যাতে জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতায় দ্রুত সাড়া দেয় এবং সেবা প্রদানকারীরা যাতে ধর্ষণের শিকার নারী তাৎক্ষণিক ও প্রয়োজনীয় সেবা দক্ষভাবে সেবা দিতে পারে, সে জন্য স্বাস্থ্যসেবা খাতকে শক্তিশালী করতে কাজ করে যাব। একই সঙ্গে জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতার শিকার সবার জন্য আইনি সেবা ও সুরক্ষা বৃদ্ধির জন্যও আমরা কাজ করছি। এসব সেবা সর্বত্র সহজপ্রাপ্য করা আবশ্যক, যাতে যার যখন প্রয়োজন, তখনই সেবা নিতে পারে। 

সবশেষে সমাজ পরিবর্তনের জন্য আবশ্যক নারীর ক্ষমতায়নের জন্য আমরা কাজ করে যাব।

জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতা প্রতিরোধে আমাদের সবার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ও জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। আমাদের বুঝতে ও স্বীকার করতে হবে যে ধর্ষণের কারণ একটি নয় এবং জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতা প্রতিরোধে ও বন্ধের জন্য সহজ কোনো সমাধান নেই। ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা, আচার-আচরণ এবং কীভাবে এগুলো ধর্ষণ সম্পর্কে সমাজের ধারণাগুলো তৈরি করছে, তা যতক্ষণ মানুষ বুঝতে পারবে না, ততক্ষণ এর সমাধান হবে না। ধর্ষণ সারা বিশ্বে ঘটা একটি ন্যক্কারজনক অপরাধ এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের চরম উদাহরণ। আমরা জাতিসংঘ এবং উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠান, জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতার প্রতিরোধে ও ধর্ষণ বন্ধে আরও কঠোরভাবে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করার অঙ্গীকার করছি।

পেনি মর্টন ভারপ্রাপ্ত অস্ট্রেলিয়ান হাইকমিশনার; রবার্ট চ্যাটার্টন ডিকসন ব্রিটিশ হাইকমিশনার; বেনোইট প্রিফন্টেইন কানাডিয়ান হাইকমিশনার; উইনি এস্ট্রাপ পিটারসেন ডেনমার্কের রাষ্ট্রদূত; হ্যারি ভারুইজ নেদারল্যান্ডসের রাষ্ট্রদূত; সিডসেল ব্লেকেন নরওয়ের রাষ্ট্রদূত; শার্লোটা শ্লিয়েটার সুইডেনের রাষ্ট্রদূত; সুসান মুলার সুইজারল্যান্ডের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স; মিয়া সেপ্পো বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক; জুডিথ হারবার্টসন ডিএফআইডি বাংলাদেশের কান্ট্রি প্রতিনিধি; শোকো ইশিকাওয়া ইউএন উইমেন বাংলাদেশের কান্ট্রি প্রতিনিধি; আশা টরকেলসন ইউএন পপুলেশন ফান্ডের কান্ট্রি প্রতিনিধি