বিএনপির নির্বাচন এবং শিয়াল-কুমিরের গল্প

মির্জা ফখরুল ইসলাম
মির্জা ফখরুল ইসলাম

নির্বাচনে অংশ নেওয়া বা না-নেওয়া বিষয়ে দীর্ঘদিন বিএনপির মধ্যে যে সংশয় ছিল আপাত তার অবসান হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। সম্প্রতি দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম বেশ জোরের সঙ্গেই বলেছেন, ‘আমরা মনে করি যে অতীতে দু-একটি নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত সঠিক হয়নি। এরপর থেকে নির্বাচনে অংশ নিয়ে আমরা আমাদের দলকে জনগণের সঙ্গে আরও বেশি করে সম্পৃক্ত করতে চাই। আমরা মনে করি, জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করেই এই ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন ঘটাতে হবে। নির্বাচনে অংশ নেওয়াকে আমরা এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক আন্দোলন বলে মনে করছি।’

অন্যদিকে, গত ১০ ফেব্রুয়ারি বিএনপির নেতা-কর্মীদের সাক্ষাৎকারভিত্তিক প্রথম আলোতে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে যার শিরোনাম হলো, ‘জিতবে না জেনেও চট্টগ্রামের ভোটে থাকতে চায় বিএনপি’। অনলাইনে প্রকাশিত সংবাদটিতে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পাঠকের একটি মন্তব্য হলো, ‘২০১৪ সালে এত নাটক না করে নির্বাচনে গেলে বিএনপিকে আজ পস্তাতে হতো না। এখন দেখছি নির্বাচন এলেই বিএনপির নেতারা লম্ফ-ঝম্প শুরু করেন। মাঝখান থেকে আম-ছালা সব গেল (সংশোধিত)।’

বাংলাদেশে নির্বাচন বর্জনের ইতিহাস নতুন নয়। ১৯৮৬ সালে এরশাদ সরকারের আমলে বিএনপি নির্বাচন বয়কট করেছিল। এরপর ১৯৮৮ সালে বিএনপি-আওয়ামী লীগসহ বিরোধী জোট নির্বাচন বর্জন করে। অন্যদিকে, বিএনপি সরকারের আমলে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচন বয়কট করেছিল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোট। বলা বাহুল্য, বিতর্কিত এ নির্বাচনগুলো বয়কট করে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক সুবিধা পেয়েছিল।

কিন্তু ২০১৪ সালে নির্বাচন বয়কটের জন্য বিএনপিকে চড়া মূল্য দিতে হচ্ছে। বিএনপির মহাসচিব নিজেই এখন বলছেন, ‘নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত সঠিক হয়নি।’ বলা বাহুল্য ২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত নির্বাচন বয়কট এবং নির্বাচন বাতিলের দাবিতে বিএনপি যে রাজনীতি শুরু করে এবং সে রাজনীতি মোকাবিলায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ যে রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া দেখায়, তার পরিণতি আজকের বিপর্যস্ত বিএনপি।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো রাজপথ। এখানে রাজপথ যার, রাজনীতি তার। এখানে রাজপথ যার, প্রশাসন তার। এখানে রাজপথ দখলে না থাকলে মেয়র প্রার্থীর মামলাও আমলে নেয় না পুলিশ । উল্লেখ্য, সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র প্রার্থী তাবিথ আউয়াল সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন যে তাঁর ওপর গাবতলীর একজন কাউন্সিলর প্রার্থী আক্রমণ করলেও পুলিশ তাঁর মামলা আমলে নেয়নি।

২০১৩-১৪ সাল পর্যন্ত রাজপথে দাপটের সঙ্গেই টিকে ছিল বিএনপি। তখনো পুলিশ ও প্রশাসনের অনেকের মনে হয়তো একটি ‘যদি’ ছিল অর্থাৎ কোনো কারণে যদি বিএনপি ক্ষমতায় চলে আসে, তাহলে নিজেদের চাকরি বাঁচাতে হবে। ফলে কারও পক্ষেই নগ্নভাবে শক্তিশালী বিএনপির বিরোধিতা করা সম্ভব ছিল না। যে কারণে বিএনপির একজন নেতাও তখন প্রতিপক্ষের কর্মীদের দ্বারা আক্রান্ত হননি। নিজ নিজ এলাকায় প্রত্যেক বিএনপি নেতাই তখন বেশ প্রতাপশালী ছিলেন।

মাত্র চার বছর পর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রচার-প্রচারণার সময় বিএনপিসহ বিরোধী জোটের প্রার্থীরা ব্যাপকভাবে সরকারদলীয় নেতা-কর্মীদের দ্বারা আক্রান্ত ও অবরুদ্ধ হন। সংসদ নির্বাচনের আগে ঢাকাসহ সারা দেশে বিপুলসংখ্যক প্রার্থীর ওপর সরকারদলীয় নেতা-কর্মী বা সমর্থকদের হামলার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ধরনের হামলার ঘটনায় কোনো বিএনপি নেতাকে বাঁচাতে আসেনি কেউ, এমনকি মামলা নেওয়ার ঘটনাও নেই। মাত্র চার বছরের ব্যবধানে শক্তিশালী বিএনপি পুরোপুরি অসহায় হয়ে পড়ে।

অথচ ২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশ নিলে বিএনপির এমন করুণ পরিণতি হতো না বলেই মনে হয়। ওই নির্বাচন বর্জন বিএনপিকে সাংগঠনিকভাবে একেবারে দুর্বল করে দেয় এবং প্রশাসনিক ও অন্যান্য জায়গায় তার সম্ভাবনা শেষ হয়ে যায়। যার শক্তি থাকে না, সম্ভাবনা থাকে না, এ দেশের রাজনীতিতে তার কোনো গুরুত্ব থাকে না।

যখন শক্তি ও সামর্থ্য ছিল, তখন বিএনপি নির্বাচন বর্জন করেছিল। এখন সাংগঠনিকভাবে একেবারে দুর্বল ও পর্যুদস্ত বিএনপি নির্বাচনে থাকতে চায়, পরাজিত হবে জেনেও ভোটে থাকতে চায়। এ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার অর্থ হলো বিএনপির শোচনীয় পরিস্থিতির আরেকটি নতুন পাঠ। একসময়ের প্রতাপশালী বিএনপি নেতাদের আত্মসমর্পণের সংবাদ।

রাজনীতি বড়ই জটিল ও কুটিল একটি বিষয়। মির্জা ফখরুল খুব সাদামাটাভাবে বলেছেন যে অতীতে দু-একটি নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত সঠিক হয়নি। কিন্তু এই ভুল সিদ্ধান্তের যে চরম মূল্য দলটিকে দিতে হচ্ছে, তা অপূরণীয়। প্রশ্ন হলো, এখন নির্বাচনে অংশ নেওয়ার যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তা যে ভুল নয়, তা কে বলবে? এখন হয়তো জোর দিয়ে বলা যাবে না সিদ্ধান্তটি কতটা যৌক্তিক। তবে, বিএনপির এ সিদ্ধান্তের ফসল যে আওয়ামী লীগের ঘরে যাবে, তাতে সন্দেহ নেই।

একসময় নির্বাচন বর্জন এবং এখন নির্বাচনে যাওয়ার বিএনপির সিদ্ধান্ত দেখে শিয়াল ও বোকা কুমিরের গল্পের কথা মনে পড়ে গেল। শিয়াল ও কুমির যৌথভাবে চাষাবাদ করেছিল। প্রথমে চাষ হয়েছিল আলু। সিদ্ধান্ত হলো কুমির মাটির নিচের অংশ নেবে আর শিয়াল নেবে মাটির ওপরের অংশ। শিয়াল পেল আলু আর কুমির পেল মরা আলু গাছ। দ্বিতীয়বার চাষ হলো ধান। এবার কুমির আগেই প্রস্তাব দিল যে তার মাটির নিচেরটাই চাই। শিয়াল মাটির ওপরে থাকা ধান নিয়ে গেলে কুমিরকে ঠকতে হলো আরও একবার।

নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ফলে বিএনপির সাংগঠনিক কোনো উন্নতি হবে না। ধরি মাছ না ছুঁই পানি ধরনের নির্বাচন দিয়ে কিছু করা যায় না। অন্যদিকে, এতে আওয়ামী লীগ অনেক ধরনের সুবিধা পাবে। ইতিমধ্যে এ বছরের বিশ্ব গণতন্ত্র সূচকে এক লাফে বাংলাদেশের ৮ ধাপ অগ্রগতি হয়েছে। গত বছরে এই সূচকে ৮৮তম থাকলেও এবার ৮০তম অবস্থানে উঠে এসেছে বাংলাদেশ। ব্রিটিশ সাময়িকী ‘দ্য ইকোনমিস্ট’ ম্যাগাজিনের গবেষণা প্রতিষ্ঠান দ্য ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট এ সূচক তৈরিতে পাঁচটি মানদণ্ড ব্যবহার করে। এগুলো হলো, নির্বাচন ব্যবস্থা ও বহুদলীয় পরিস্থিতি, সরকারে সক্রিয়তা, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ, রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং নাগরিক অধিকার।

বিএনপির নামমাত্র নির্বাচনে অংশ নেওয়া আর নিয়ন্ত্রিত রাজনৈতিক কর্মসূচিতে থাকার অর্থ দাঁড়ায়, এ দেশে এখনো রাজনৈতিক অংশগ্রহণ, নির্বাচন ব্যবস্থা ও বহুদলীয় পরিস্থিতি বিদ্যমান। এতে আন্তর্জাতিক মহলে আওয়ামী লীগের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে ।

বিএনপি কি নির্বাচন নিয়ে বোকা কুমিরের পথে হাঁটছে? কোনো একদিন আমাদের শুনতে হবে না তো যে এভাবে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্তটি সঠিক ছিল না!

মোহাম্মদ মোজাহিদুল ইসলাম: শিক্ষক ও গবেষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]