ধর্ষণের কি প্রতিকার নেই

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

ধর্ষণসহ নারীর প্রতি সব ধরনের সহিংস অপরাধের বিরুদ্ধে অত্যন্ত কঠোর আইন থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে ধর্ষণের প্রবণতা কেন রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না, তা এক গভীর প্রশ্ন। সংবাদমাধ্যমে প্রতিদিন অনেক ধর্ষণের খবর প্রকাশিত হচ্ছে, প্রকাশিত হচ্ছে না এমন ঘটনার সংখ্যা কত হতে পারে, তা অনুমান করাও সম্ভব নয়। তবে নিশ্চিতভাবেই অনুভব করা যাচ্ছে, এই সমাজ পুরোনো ও দুরারোগ্য ব্যাধির মতো ধর্ষণপ্রবণতা বয়ে চলেছে। উদ্বেগের বিষয় হলো, দেশজুড়ে ধর্ষণ এমন দৈনন্দিন ও সহজে–সংঘটিত অপরাধ হিসেবে বিস্তার লাভ করেছে যে এর একধরনের স্বাভাবিকীকরণ ঘটেছে বলে মনে হতে পারে।

চলতি ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে দেশের সংবাদমাধ্যমগুলোতে অনেকগুলো ধর্ষণের খবর প্রকাশিত হয়েছে; দেখা যাচ্ছে ধর্ষণের শিকার ব্যক্তিদের অধিকাংশই কিশোরী। বছরজুড়ে ধর্ষণের পরিসংখ্যানেও শিশু ও কিশোরীদের সংখ্যাধিক্য লক্ষ করা যায়। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলোর ভিত্তিতে যে পরিসংখ্যান নথিবদ্ধ করে, তাতে দেখা যাচ্ছে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে যে মোট ৯৮ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে, তাদের মধ্যে ৪৯ জনেরই বয়স ১৮ বছরের নিচে। বিস্ময়কর হলো, এই ৪৯ জনের মধ্যে ৯ জনের বয়স ৬ বছর ও তার কম এবং ১৭ জনের বয়স ৭ থেকে ১২ বছর। ৬–৭ বছর বা তার কম বয়সী মেয়েশিশুরা এই মাত্রায় যৌন সহিংসতার শিকার হচ্ছে—এর ব্যাখ্যা কী হতে পারে? কোনো সমাজের পুরুষদের একাংশের মধ্যে এহেন বিকৃত যৌন সহিংসতা যখন প্রতিনিয়ত ঘটতে থাকে, তখন গুরুতর উদ্বেগের কারণ ঘটে। কিন্তু আমাদের আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষ, নীতিনির্ধারক ও সার্বিকভাবে পুরো সমাজে এ বিষয়ে সেই মাত্রায় উদ্বেগ লক্ষ করা যায় না, যা থাকলে এসব বন্ধ করার সামাজিক–প্রাতিষ্ঠানিক তৎপরতা ব্যাপকভাবে দৃশ্যমান হতো।

এখন সংবাদমাধ্যমে কোনো নারী ধর্ষণের খবর প্রকাশিত হলে সমাজে তেমন কোনো সাড়া পড়ে না; কারণ প্রতিদিনই একাধিক ধর্ষণের খবর প্রকাশিত হচ্ছে। ৭ বছর বয়সী কোনো মেয়েশিশু, ১২ বছরের কোনো কিশোরী, কিংবা ২১ বছরের কোনো তরুণী দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হলেও সমাজের টনক নড়ে না, যতক্ষণ না ধর্ষকেরা তাদের রোমহর্ষক পন্থায় হত্যা করে। ধর্ষণের বিরুদ্ধে মানববন্ধন ইত্যাদি প্রতিবাদ–বিক্ষোভের আয়োজন এ রকম বিরল ঘটনার ক্ষেত্রেই শুধু দেখা যায় এবং সেগুলো সীমাবদ্ধ থাকে রাজধানী ঢাকা কিংবা বড় কোনো শহরে। নিভৃত গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র মা–বাবার কিশোরী মেয়ে ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হলে আমাদের সমাজের সংবেদনশীলতা সেভাবে লক্ষণীয় হয়ে ওঠে না।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের ২০১৯ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত বছর সারা দেশে মোট ১ হাজার ৪১৩ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে; তাদের মধ্যে ৭৬ জনকে ধর্ষকেরা ধর্ষণের পরে হত্যা করেছে। ধর্ষণের শিকার হওয়ার কারণে আত্মহত্যা করেছে ১০ জন। আইন বলছে, ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ধর্ষণকালে হত্যার সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড। আইন কঠোর এতে কোনো সন্দেহ নেই; কিন্তু কঠোর আইন থাকলেই অপরাধ কমে যাবে, ধর্ষণের ক্ষেত্রে অন্তত বাংলাদেশে তা বাস্তবে প্রমাণিত হয়নি। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে কঠোর আইনের প্রয়োজন নেই; বরং খুব জোর দিয়ে বলতে চাই, আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা আইন প্রণয়নের মতোই জরুরি দায়িত্ব। ধর্ষণের বিচার ও অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে আমাদের আইন প্রয়োগ ব্যবস্থার কার্যকারিতা যে হতাশাব্যঞ্জক তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

তবে কি আমরা ভেবে নিয়েছি যে এ দেশে ধর্ষণের কোনো প্রতিকার নেই?