বসন্ত, রংকানা, বিশ্বজয়

এবার ১৪ ফেব্রুয়ারিতেই পয়লা ফাল্গুন পড়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা, ১৪ ফেব্রুয়ারি। ছবি: দীপু মালাকার
এবার ১৪ ফেব্রুয়ারিতেই পয়লা ফাল্গুন পড়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা, ১৪ ফেব্রুয়ারি। ছবি: দীপু মালাকার

জাতীয় সংসদে বসন্ত, শাড়ি, রং, রংকানা ইত্যাদি নিয়ে একপশলা রসিকতা হয়ে গেছে।

‘জাতীয় সংসদে আজ বুধবার প্রশ্নোত্তর পর্বে সম্পূরক প্রশ্ন করতে গিয়ে জাতীয় পার্টির সাংসদ মুজিবুল হক বলেন, “মাননীয় সংসদনেত্রীকে দেখে আজকে মনে হলো যে বসন্ত খুব শিগগির।’”

‘প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে বর্ণিল শাড়ি পরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিছুটা মজা করে বলেন, “আমার মনে হয় মাননীয় সংসদ সদস্যের জানা উচিত বসন্তের যে রং, সেটা কিন্তু বাসন্তী রং। আমি কিন্তু বাসন্তী রং পরিনি। এখানে অনেক রং আছে। কালোও আছে। আমার মনে হচ্ছে মাননীয় সংসদ সদস্য কালার ব্লাইন্ড। এটা বাংলা করলে হয় রংকানা। জানি না, আজকে বাড়িতে গিয়ে ওনার কপালে কী আছে।”’ (প্রথম আলো অনলাইন, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২০)

আজ পয়লা ফাল্গুন। কবিদের সবচেয়ে প্রিয় ঋতু বসন্তের প্রথম দিন। আবার আজকে নাকি ভালোবাসারও দিবস।

এত দিন পর্যন্ত বসন্তের প্রথম দিনে বাসন্তী রং আর ১৪ ফেব্রুয়ারিতে লাল রং পরার চল ছিল। এটা বোধ হয় আমাদের ফ্যাশন ডিজাইনাররা প্রবর্তন করেছিলেন। কিন্তু এবার হয়েছে মুশকিল। ১৪ ফেব্রুয়ারিতেই পয়লা ফাল্গুন পড়ে গেছে।

এইবার তাহলে আমরা কী করব? ছেলেরা এক কাজ করতে পারি। ওপরে বাসন্তী রঙের পাঞ্জাবি পরে নিচে লাল রঙের পায়জামা পরতে পারি।

প্রসঙ্গত বলে রাখি, পাঞ্জাবি কথাটা পাঞ্জাব থেকে আসেনি। এসেছে পাঞ্জা থেকে। পাঞ্জাবির হাতা হাতের তালু পর্যন্ত বিস্তৃত থাকে বলে এর নাম পাঞ্জাবি। এটি বাঙালিদের পোশাক।

পায়জামা-পাঞ্জাবি এমন এক পোশাক, যেটা পরে আপনি বাজারেও যেতে পারবেন, ফাইভ স্টার হোটেলেও যেতে পারবেন। এই পোশাক একই সঙ্গে আটপৌরে এবং আনুষ্ঠানিক। জুতা পরতে হয় না, বেল্ট লাগাতে হয় না। মজাই আলাদা। একটাই সমস্যা। মাঝেমধ্যে পায়জামার ফিতার গিঁট প্যাঁচ খেয়ে যায়। আটকে যায়। আর এটা হয় খুব ইমার্জেন্সির সময়ে।

মাওলানা ভাসানী লুঙ্গি পরতেন। লুঙ্গি পরেই তিনি বিদেশ সফর করেছেন। মাও সে-তুংয়ের সঙ্গেও দেখা করেছেন লুঙ্গি পরেই।

আমাদের লেখক, গবেষক, সাংবাদিক সৈয়দ আবুল মকসুদ সেলাই ছাড়া কাপড় পরেন। দুই টুকরা সাদা চাদর। এই নিয়ে রসিকতাও করেন তিনি। একদিন বললেন, ‘সেদিন দেখি দুজন ঝগড়া করছে। আমি আর সাহস করে ঝগড়া থামাতে গেলাম না। বোঝেনই তো, পরনে লুঙ্গি। লুঙ্গি পরে বিবাদের মধ্যে না যাওয়াই ভালো।’

লুঙ্গি নিয়ে চমৎকার কবিতা লিখেছেন কবি কায়সার হক। ইংরেজি সে কবিতার খানিকটা অনুবাদ অনলাইন থেকে তুলে দিচ্ছি, অনুবাদকের নাম উদ্ধার করতে পারিনি বলে দুঃখিত।
কেবল ভাবুন—
যেকোনো মুহূর্তে
লুঙ্গি পরিহিত লোক আছে এ দুনিয়ায়
মার্কিন মুল্লুকের জনসংখ্যার চেয়ে বেশি
এখন চেষ্টা করুন একটি পরতে
হোয়াইট হাউসের যেকোনো অনুষ্ঠানে—
...

আপনি এর ভেতরে ঢুকে পড়তে পারেন
আর ঢিলা বাঁধনে বাঁধতে পারেন
কোমরের চারপাশে—
একটি সাইজই সকলের লাগবে
আর ময়লা দূর করতে
ধরা যাক আপনার সিটে
আপনি এটাকে ঝাঁকাতে পারবেন


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নাকি কালার ব্লাইন্ড ছিলেন। নির্মলকুমারী লিখেছেন, ‘পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছিল যে উনি রংকানা ছিলেন। লাল রংটা চোখে পড়ত না, মানে লাল আর সবুজের বেশি পার্থক্য বুঝতে পারতেন না। কিন্তু কোনো জায়গায় নীলের একটু আভাসমাত্র থাকলেও সেটি তাঁর দৃষ্টি এড়াত না। তিনি বলতেন, “আমি তোমার লাল ফুল ভাল দেখতে পাইনে বলে আমাকে ঠাট্টা করো। নীল রংটা যে পৃথিবীর রং, আকাশের শান্তির রং, তাই ওটার মধ্যে আমার চোখ ডুবে যায়; আর লাল রংটা হলো রক্তের রং, আগুনে রং অতএব প্রলয়ের রং, মৃত্যুর রং—কাজেই বেশি না দেখতে পেলে দোষ কী?”’

রংকানা শব্দটা জুতসই। যেমন একটা শব্দ আছে, রাতকানা। ভিটামিন ‘এ’ না খেলে রাতকানা রোগ হয়।

আরেকটা শব্দ আছে দলকানা। নিজের দলের প্রতি স্নেহান্ধ। নিজের দলের কোনো দোষত্রুটি দলকানারা দেখতে পান না।


প্রমথ চৌধুরী সবুজপত্রে লিখেছিলেন, ‘যৌবনে দাও রাজটিকা। গত মাসের সবুজপত্রে শ্রীযুক্ত সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত যৌবনকে রাজটিকা দেবার প্রস্তাব করেছেন। আমার কোনো টিকাকার বন্ধু এই প্রস্তাবের বক্ষ্যমাণরূপ ব্যাখ্যা করেছেন—যৌবনকে টিকা দেওয়া অবশ্যকর্তব্য, তাহাকে বসন্তের হস্ত হইতে রক্ষা করিবার জন্য। এস্থলে রাজটিকা অর্থ রাজা অর্থাৎ যৌবনের শাসনকর্তা কর্তৃক তাহার উপকারার্থে দত্ত যে টিকা, সেই টিকা।’

বসন্ত এখন নির্মূল হয়ে গেছে। এখন এসেছে করোনা। ফেসবুকে এই নিয়ে রসিকতা চালু আছে: বাঙালি ছেলেমেয়েরা নতুন করে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হবে না, কারণ তারা ইমিউন হয়ে গেছে। ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছে, এটা কোরো না, ওটা কোরো না, দুষ্টুমি কোরো না, বাড়াবাড়ি কোরো না, মারামারি কোরো না, ছোটাছুটি কোরো না, এতবার কোরো না শুনতে হয়েছে যে করোনাভাইরাস বাঙালি ছেলেমেয়েদের বেলায় কাজ করবে না।

না। করোনা নিয়ে রসিকতা করা যাবে না। এটা এখন খুবই উদ্বেগজনক একটা ব্যাপার। বিশেষ করে অর্থনীতিতে এর প্রভাব হতে পারে ভয়াবহ।

লেখাটা শেষ করতে চেয়েছি ভালোবাসার কথা বলে। একটা খবর পেলাম অনলাইনে। জানি না, এর সত্যতা কতটুকুন। তবু বলি...

‘গোটা বিশ্ব এখন আতঙ্কিত, তবে এই আতঙ্কের মধ্যেই এক চীনা তরুণী প্রেমের টানে ছুটে গেলেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর জেলায় এক তরুণের কাছে। বিয়েও করেছেন তাঁরা।

বর কাঁথির পশ্চিম পারুলিয়া গ্রামের বাসিন্দা পিন্টু। আর কনে চীনের গোয়াং প্রদেশের বাসিন্দা অ্যাঞ্জেল।

জানা যায়, সাত বছর আগে ছোট মামার হাত ধরে চীনে কাপড়ের ব্যবসা করতে গিয়েছিল পিন্টু। সেখানেই পরিচয় অ্যাঞ্জেলের সঙ্গে। শেষমেশ চার হাত এক করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় দুই পরিবার। সেইমতো এক মাস আগে বিয়ের দিনক্ষণ পাকা হয়।

চলতি মাসের ৪ তারিখ বিয়ের দিন ঠিক হয়। স্থির হয়, হিন্দুমতেই হবে বিয়ে। সেইমতো সব ঠিকঠাক চলছিল। কিন্তু হঠাৎই মাঝখান থেকে বাগড়া দেয় প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস। দিন ১০-১২ আগে করোনাভাইরাসের প্রকোপ দেখা দিতেই কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে দুই পরিবারের।

শেষে ঠিক হয়, নির্দিষ্ট দিনেই হবে বিয়ে। কোনোমতে পাত্র ও পাত্রী ভিসা নিয়ে ভারতে চলে আসেন। কিন্তু আটকে পড়ে কনের পরিবার। সেই পরিস্থিতির মধ্যেই মঙ্গলবার চার হাত এক হলো অ্যাঞ্জেল ও পিন্টুর। (রাতদিন নিউজ)


ভালোবাসার জয় হোক। শুভ বসন্ত।
আজ বইমেলা যাব। গান গাইব:

এতদিন যে বসেছিলেম পথ চেয়ে আর কাল গুনে
দেখা পেলেম ফাল্গুনে॥
বালক বীরের বেশে তুমি করলে বিশ্বজয়—
এ কী গো বিস্ময়।
অবাক আমি তরুণ গলার গান শুনে॥

আমাদের অনূর্ধ্ব ১৯-এর বিশ্বকাপ জয়ের প্রেক্ষাপটেও গানটা গাওয়া যায়। বালক বীরের বেশে তুমি করলে বিশ্বজয়! এ কী গো বিস্ময়! অবাক আমি আকবর আলীর সাক্ষাৎকার শুনে!

আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক