নথিপত্রের ইলেকট্রনিক ব্যবস্থাপনা

ঔপনিবেশিক সময়ে কে কবে সরকারি নথিপত্র লাল রঙের ফিতা দিয়ে বাঁধার প্রচলন করেছিলেন, কে জানে। লাল, সাদা, নীল—কত রংই তো হতে পারত। এখানে লাল রংটা ‘রেডটেপিজম’ বা লাল ফিতার দৌরাত্ম্য আমলাতন্ত্রপন্থী, জনস্বার্থের পরিপন্থী হয়েছে। প্রথমে হয়তো এটা দিয়ে আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রতা বোঝানো হতো, কিন্তু পরে এর সঙ্গে ‘স্পিডমানি’ বা অবৈধ আর্থিক লেনদেন যুক্ত হয়।

বাংলাদেশের জন্য ইলেকট্রনিক ব্যবস্থাপনা (ই–গভর্ন্যান্স) এই লাল ফিতার দৌরাত্ম্যে ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা করেছে। ২৫টি মন্ত্রণালয়ের ৯০ শতাংশ নথিপত্রের কাজ ইতিমধ্যে ইলেকট্রনিক ব্যবস্থাপনায় চলছে, সাড়ে ৩২ লাখ ই–পত্র চালাচালি হয়েছে, এক কোটির বেশি নথি নিষ্পত্তি হয়েছে। এগুলো প্রশংসনীয় অগ্রগতির লক্ষণ। অফিস–আদালতের ঘুষ–বাণিজ্যে একটি ইতিবাচক পদ্ধতিগত পরিবর্তন এসেছে। সংশ্লিষ্ট অসাধু কর্মকর্তা–কর্মচারীরা হয়তো এই দ্রুত পরিবর্তনশীল ব্যবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হিমশিম খাচ্ছেন, ফলে কিছু ক্ষেত্রে স্পিডমানি লাগছে না। হয়রানি, জনভোগান্তি কমে আসছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, শেষ বিচারে এটাই বড় হয়ে উঠবে যে যন্ত্রের পেছনের মানুষই গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং আজ ই–নথি চালুর প্রাথমিক পর্যায়ের কিছু গতি দেখে একেই স্থায়ী ধরে নেওয়ার কারণ নেই। নীতিনির্ধারকদের এ বিষয়ে অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে যে অসাধু কর্মকর্তা–কর্মচারীরা স্বভাবজাত কারণেই উপযুক্ত বিকল্প বের করার ধান্দায় থাকবেন। তাই সফটওয়্যার বা সিস্টেম গড়ে তোলার বিষয়ে মনে রাখতে হবে যে ই–ব্যবস্থার যেকোনো অপব্যবহার ও তার সম্ভাব্য প্রতিকার অপারেটরদের জানা–বোঝার মধ্যে থাকতে হবে। এ জন্য বিদ্যমান লোকবলকে একটা ন্যূনতম পর্যায়ের দক্ষতা অর্জন করতে হবে। আমরা চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের দোরগোড়ায়, ফলে বিবেচনায় রাখতে হবে যে অফিস ব্যবস্থাপনার কাজে একসময় রোবটও যুক্ত হবে। সুতরাং সার্বিকভাবে আমরা একটি সম্পূর্ণ নতুন পরিস্থিতির মুখোমুখি।

ইলেকট্রনিক নথি ব্যবস্থাপনা সরকারি কাজে স্বচ্ছতা দিচ্ছে; জবাবদিহি আনছে। এখন চ্যালেঞ্জ হলো, এই ব্যবস্থা যাতে নিজেই কারিগরিভাবে দূষিত (করাপটেড) না হয়ে পড়ে। যান্ত্রিক কারণে করাপটেড হওয়ার ঝুঁকি থাকবে। নতুন সিস্টেমের অপব্যবহার করে নতুন ফন্দিফিকির ও কৌশলে স্পিডমানির অদৃশ্য ভূতকে জিন্দা করার চেষ্টা হতে পারে। ই–নথি যে ব্যাপকতায় গতি বয়ে আনছে, সেভাবে কোনো সামান্য ভুলে বড় ধরনের ই–বিপর্যয় ঘটে যেতে পারে। এটা হবে গভীরভাবে অনুশোচনীয় যে ই–নথি ব্যবস্থাপনায় যদি বড় মাপের গলদ থাকে, তাহলে তার মাশুল হবে চড়া। সুতরাং ই–নথি আপাতত হয়রানি কমানোর যে সুফল দিচ্ছে, সেটা যাতে অপব্যবহাররোধক ও টেকসই হয়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্ট হ্যাকিং থেকে বড় পাঠ নিতে হবে। ওই ঘটনা দেখাচ্ছে যে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর ই–নথি যেমন গতি বাড়ায়, তেমনি তা সামান্য অসতর্কতায় বড় বিপদ বয়ে আনতে পারে। হ্যাকিংয়ের মতো দুর্বৃত্তায়নের ঝুঁকি তাই বিশেষভাবে স্মরণ রাখতে হবে।

আমরা ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে কাগজের ব্যবহার কমিয়ে ই–নথি ব্যবস্থাপনায় বিপ্লব সাধনের সরকারি লক্ষ্যমাত্রা পূরণের প্রচেষ্টার সাফল্য কামনা করি। এ জন্য যত ধরনের সুরক্ষা ও রক্ষাকবচ তৈরি করা দরকার, তাতে যেন কোনো গাফিলতি বা অসতর্কতার কারণ না ঘটে, তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।