আওয়ামী লীগের 'আগাছা' ও 'পরগাছা' উপাখ্যান

গত বুধবার গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের ত্রিবার্ষিক সম্মেলনে ওবায়দুল কাদের দলীয় নেতা-কর্মীদের সতর্ক করে বলেছেন, ‘কেউ ঘরের মধ্যে ঘর বানাবেন না। কমিটি করার সময় কেউ পকেট কমিটি করবেন না। ত্যাগী কর্মীদের মূল্যায়ন করতে হবে। ত্যাগীদের মূল্যায়ন না করলে দল ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ ছাড়া শুধু প্রবীণদের দিয়ে আওয়ামী লীগের কমিটি হবে না। নতুন ও প্রবীণদের নিয়ে কমিটি হবে।’

ওবায়দুল কাদেরের এই কথায় ‘ সুসংবদ্ধ’ আওয়ামী লীগের মধ্যে বিভাজনের আভাস পাওয়া যায়। আওয়ামী লীগের নেতারা নিজেদের বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক বলে দাবি করেন, কিন্তু সেই আদর্শের সৈনিকেরা কেন ঘরের মধ্যে ঘর বানাবেন? কেনই-বা পকেট কমিটি করবেন? ওবায়দুল কাদের যে কথাটি বলেননি তা হলো, ঘরের মধ্যে ঘর বা পকেট কমিটি বানানোর সুযোগটি কখন আসে। সুযোগটি আসে যখন নেতৃত্ব নির্বাচনের সর্বজনীন ও গণতান্ত্রিক রীতিটি অস্বীকার করা হয়। দেশের প্রাচীন ও গণতন্ত্রের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ বলে দাবিদার দলটি কেন তৃণমূল থেকে শীর্ষ স্তর পর্যন্ত গোপন ব্যালটে নেতা নির্বাচন করতে পারে না?

গণতান্ত্রিক দল যদি গঠনতন্ত্র মেনে চলে, তাহলে পকেট কমিটি কিংবা ঘরের মধ্যে ঘর বানানোর সুযোগ থাকে না। আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব এই চ্যালেঞ্জ নিক। এরপর বিএনপি, জাতীয় পার্টি কিংবা অন্যান্য দলকে আমরা বলতে পারব, আওয়ামী লীগের দেখানো পথই গণতন্ত্রের পথ। এখন গণতান্ত্রিক ও ক্ষমতা গর্ভে জন্ম নেওয়া দলের মধ্যে কোনো ফারাক করা যাচ্ছে না। সবাই সব ক্ষেত্রে ‘হাত তোলা গণতন্ত্র’ অনুসরণ করে চলেছে। তিনটি দলের উল্লেখ করেছি বলে কেউ মনে করবেন না অন্যরা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নেতা নির্বাচন করে। বাংলাদেশে ডান-বাম, ছোট-বড় প্রায় সব দলে গদিতে একবার কেউ বসলে ছাড়তে চান না। এ কারণেই ঘরের ভেতরে ঘর তৈরি হয়।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওই দিনের বক্তৃতায় আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। তাঁর ভাষায়, ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষে আওয়ামী লীগকে আগাছা-পরগাছামুক্ত করা হবে। কোনো হাইব্রিড, বসন্তের কোকিলরা আওয়ামী লীগের নেতা হতে পারবেন না। আওয়ামী লীগের দুর্দিনের ত্যাগীরাই নেতা হবেন।’ এর আগে তিনি আওয়ামী লীগে ঢুকে পড়া কাউয়া সম্পর্কে দলীয় নেতা-কর্মীদের সজাগ করে দিয়েছিলেন। কাক বাজার বা গৃহস্থবাড়িতে গিয়ে তক্কে তক্কে থাকে এবং যখনই সুযোগ পায়, ছোঁ মেরে মাছ বা মাংসের টুকরোটি নিয়ে উড়াল দেয়। প্রাকৃতিক কাউয়ারা কাজটি লুকিয়ে-ছাপিয়ে করলেও রাজনৈতিক কাউয়ারা সেটি করে প্রকাশ্যে। সবাইকে জানান দিয়ে। প্রয়োজনে ‘যার যা ন্যায্য বখরা’, তা-ও তারা পুরোপুরি শোধ করে।

আওয়ামী লীগ অদূর ভবিষ্যতে এসব কাউয়া, বহিরাগত তাড়াতে কিংবা আগাছা-পরগাছা পরিষ্কার করতে পারবে কি না, সেই আলোচনায় যাওয়ার আগে যে প্রশ্নটি করতে হয়, তা হলো, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় লালিত ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শে গড়া দলটিতে এরা ঢুকল কীভাবে? কাদের হাত ধরে?

আওয়ামী লীগ কিংবা এর সহযোগী কোনো সংগঠনে যে বহিরাগত, হাইব্রিড, আগাছা-পরগাছা আছে, সেটি নেতারা এত দিন স্বীকারই করতে চাননি। শুদ্ধি অভিযানে যখন একের পর এক যুবলীগের নেতা এবং দলীয় মনোনয়নে নির্বাচিত কাউন্সিলর, আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা ধরা পড়তে থাকলেন, তখন বলা হলো এঁরা বহিরাগত। এঁরা হাইব্রিড। গত সেপ্টেম্বর থেকেই আওয়ামী লীগে ‘বনেদি ও বহিরাগত’ শব্দ দুটি বেশি উচ্চারিত হচ্ছে। এর সীমারেখা ২০০৮, ২০১৪ না ২০০৮? গত ডিসেম্বরে আওয়ামী লীগের কাউন্সিলের আগে কেন্দ্র থেকে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে চিঠি লিখে গত ১০ বছরে যাঁরা দলে এসেছেন, যাঁরা দুর্নীতিবাজ হিসেবে পরিচিত, তাঁদের তালিকা চেয়ে পাঠানো হয়েছিল। সেই তালিকা দেখলে ভিরমি খাওয়ার অবস্থা। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী থেকে অনেক নেতা-কর্মী আওয়ামী লীগে এসেছেন। এঁদের অনেকেই এসেছেন আত্মরক্ষার্থে। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে যখন পুলিশ বিএনপির মিছিল থেকে লোক ধরে নিয়ে গিয়ে আওয়ামী লীগের মিছিলে যেতে বাধ্য করেছিল, তখন রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব কার বেশি, সেটি অনুমান করা কঠিন নয়।

ওবায়দুল কাদের যখন আওয়ামী লীগকে আগাছা ও পরগাছামুক্ত করার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন, যখন সুযোগসন্ধানীদের সম্পর্কে
নেতা-কর্মীদের সতর্ক থাকতে বলেন, তখন তৃণমূলের দিকে একবার চোখ ফেরানো যাক। দেশের দুই অঞ্চলের দুটি উদাহরণ দিলেই বিষয়টি পরিষ্কার হবে।

প্রথম আলোর লালমনিরহাট প্রতিনিধি আবদুর রবের পাঠানো প্রতিবেদনে বলা হয়, লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার মহিষখোঁচা ইউনিয়নের বাসিন্দা তামাক ব্যবসায়ী মমতাজউদ্দিন ২০১৮ সালের ২২ জানুয়ারি তৃতীয়বারের মতো আওয়ামী লীগে যোগ দেন লালমনিরহাট-২ (আদিতমারী-কালীগঞ্জ) আসনের সাংসদ ও প্রতিমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদের হাতে পিতলের একটি নৌকা তুলে দিয়ে। এ উপলক্ষে তিনি প্রায় ১৮ লাখ টাকা ব্যয় করে ২০ হাজার লোকের ভূরিভোজের আয়োজন করেন। মমতাজ এর আগে ২০১১ সালে মহিষখোঁচা ডিএস দাখিল মাদ্রাসা চত্বরে এক অনুষ্ঠানে জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি সিরাজুল হকের হাতে ফুলের তোড়া দিয়ে জাতীয় পার্টি থেকে প্রথমবার আওয়ামী লীগে যোগ দেন। এরপর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি হতে চান তিনি। সেটি হতে না পেরে ২০১২ সালে জেলা বিএনপির সভাপতি আসাদুল হাবিবের হাতে ফুল দিয়ে বিএনপিতে যোগ দেন। সেবার তিনি তাঁর নিজ বাড়িতে তিন-চার শ লোকের ভূরিভোজের আয়োজন করেন। মমতাজ ২০১৬ সালে ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনের আগে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মতিয়ার রহমানের সঙ্গে দেখা করে আওয়ামী লীগে যোগদান করেন, কিন্তু নৌকা প্রতীকে প্রার্থী হতে না পেরে ওই বছরই দ্বিতীয়বারের মতো বিএনপিতে যোগ দিয়েছিলেন।

মমতাজউদ্দিন এখনো আওয়ামী লীগে আছেন। আছেন এর আগে ও পরে যোগদান করা অনেক সুযোগসন্ধানী নেতা-কর্মীও। ঝালকাঠির রাজাপুর-নলছিটি এলাকার আওয়ামী লীগ নেতা মনিরুজ্জামান মণি গত ৮ নভেম্বর ডয়চে ভেলের, সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগে অনেক এমপিই আছেন বহিরাগত, অনুপ্রবেশকারী আমার এলাকায় যিনি আওয়ামী লীগের এমপি হয়েছেন, তিনি জাতীয় পার্টি ও বিএনপি ঘুরে এখন আওয়ামী লীগের এমপি, তিনি তাঁর অনুসারীদের দিয়েই স্থানীয় আওয়ামী লীগের কমিটি করেছেন। তাই কমিটিতে এখন প্রকৃত আওয়ামী লীগের চেয়ে বিএনপি, জামায়াত, ছাত্রশিবির ও জাতীয় পার্টির লোক বেশি।’

তবে এর চেয়েও কঠিন প্রশ্নটি করেছেন সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রফিক আহমেদ। তাঁর দাবি, ‘আমরা দেখেছি তৃণমূলের চেয়ে দলের শীর্ষ পর্যায়ে হাইব্রিড, বহিরাগত ও দুর্নীতিবাজ বেশি। আমার বিবেচনায় নেতৃত্বের পর্যায়ে এটা শতকরা ১০ ভাগের কম হবে না। আর তৃণমূলে কমপক্ষে ৫ ভাগ।’ কেন্দ্রের নির্দেশে তৃণমূল বহিরাগতদের যে তালিকা পাঠিয়েছিল, তাতে ৫ হাজারের নাম ছিল। এর মধ্যে দেড় হাজারকে অনুপ্রবেশকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে জানা নেই।

সে ক্ষেত্রে ওবায়দুল কাদের কীভাবে আশা করেন, আওয়ামী লীগ ২০২০ সালে বহিরাগত মুক্ত হবে? দেখা যাবে ঠগ বাছতে গিয়ে গাঁ উজাড়।

সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]