'এখনো কি গ্যাং গ্যাং বলিবেন আর ধরিয়া চুলই কাটিবেন?'

শিরোনামে লেখা প্রশ্নটি পাঠিয়েছেন নাটোরের বড়াইগ্রাম আর বগুড়ার ধুনট থেকে দুজন তরুণ পাঠক। ই-মেইলে দুই পাঠকের হুবহু একই কথা আসার ঘটনা নতুন নয়। পত্রিকায় নাম–পরিচয়ের সঙ্গে সঙ্গে লেখকের ই-মেইল ঠিকানা ছাপা হওয়ায় পাঠকদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের একটা সহজ সুযোগ তৈরি হয়েছে। তাঁদের বেগ, আবেগ, উৎকণ্ঠা, ভালো লাগা, তিরস্কারে আমি বেশ উপকৃত।

বিশ্বের যুবাদের সঙ্গে জোরদার লড়াই করে অপরাজিত থাকা আর শিরোপা জয় দেশবাসীর সঙ্গে সঙ্গে দেশের সব বালক–বালিকা, কিশোর–কিশোরীদের একটু অন্যভাবে নাড়া দিয়েছে। তরুণেরাও পারে, কিশোররাও পারে, শুধু কি পারে? না, সারা পৃথিবীকে নাড়িয়ে দেওয়ার মতো কাজ করার হিম্মত রাখে। এই অমূল্য আত্মবিশ্বাসের গভীরতা, তীক্ষ্ণতা আমাদের অনুধাবন করতে হবে, এটা অনেক ত্যাগে জমা এক মূল্যবান সামাজিক পুঁজি। এই কষ্টার্জিত পুঁজিটা আমাদের সঠিকভাবে ব্যবহার করতে হবে। কিশোর–তরুণদের দিকে একটু নয়, বরং যথাযথ সম্মান আর সমীহের দৃষ্টিতে তাকাতে হবে। না হলে আজকে যে ১১ জনকে মাথায় নিয়ে নাচবার মওকা মিলেছে, তার আর পুনরাবৃত্তি হবে না। ইতিহাসের পাতায় এক ব্যতিক্রমী ঘটনা হিসেবে ঠাঁই পাবে মাত্র।

যেদিন (৯ ফেব্রুয়ারি) দক্ষিণ আফ্রিকার পচেফস্ট্রুমে আমাদের কিশোর–তরুণেরা পৃথিবীকাঁপানো সাফল্য অর্জন করে প্রতিবেশী–অপ্রতিবেশী সবাইকে চমকে দিয়েছে, রাওয়ালপিন্ডিতে আমাদের পিণ্ডি চটকানো কষ্ট ভুলিয়ে দিচ্ছিল, ঠিক সেই দিনই নাটোরের বড়াইগ্রামে জোয়াড়ী উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সেকেন্দার আলী তাঁর স্কুলের  জনা পঞ্চাশ ছাত্রের চুল নিজ হাতে ব্যাঁকাত্যাড়া করে ছেঁটে দেন। তাঁর এই অন্যায় অভিযানে কয়েকজন ছাত্র মাথায় আঘাত পায়। একপর্যায়ে বিদ্যালয়ের অন্য ছাত্ররা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলে অভিভাবকেরা ছুটে আসেন। শেষমেশ পুলিশ এসে পরিস্থিতি সামাল দেয়।

প্রায় একই বয়ানে ধুনট থেকে ই–মেইল এলেও সেখানকার ঘটনা মাস সাতেকের পুরোনো (৩০ জুন ২০১৯,) তবে সেটা ঘটে পরীক্ষার হলে। বগুড়ার ধুনটে জামায়াতনিয়ন্ত্রিত বলে কথিত আবদুল মালেক ট্রাস্ট পরিচালিত আদর্শ উচ্চবিদ্যালয়ে পরীক্ষা চলাকালে স্কুলের কারিগরি শাখার কম্পিউটার ইনস্ট্রাক্টর সাজ্জাদ হোসেন ও রিক্তা আকতার গালিগালাজ ও মারধরের পর কাঁচি দিয়ে নবম ও দশম শ্রেণির ছাত্রদের মাথার সামনের চুল আঁকাবাঁকা করে কেটে দেন। বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা বর্জন করে বাড়িতে চলে যায়।

পরীক্ষার হলে চুল কাটার ঘটনা আরও আছে। গত ১৭ অক্টোবর ২০১৯, গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলার কুশলা নেছারিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসায় পরীক্ষা চলাকালে ২০ ছাত্রের চুল কেটে দেন অধ্যক্ষ নিজে। সেখানেও বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা পরীক্ষা না দিয়ে হল থেকে বেরিয়ে যায়। পরে অবশ্য শিক্ষকদের মধ্যস্থতায় ছাত্ররা পরীক্ষায় অংশ নেয়।

জোর করে চুল কেটে দেওয়া ছাড়াও কিশোর–তরুণদের প্রকাশ্যে খেলো করা, ছোট করা, অপমান করার নানা কৌশল আছে অভিভাবক শিক্ষক আর ‘মানুষ’ করার দায়িত্বে থাকা বড় মানুষদের। মনোবিজ্ঞানীরা এ বিষয়ে একমত যে কথায় কথায় মানসিক উৎপীড়নের জাঁতাকলে রাখলে শিশু–কিশোরদের বিকাশ বিঘ্নিত হয়। তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস গড়ে ওঠে না। তারা সামান্য চাপের মুখেই ভেঙে পড়ে। যেকোনো প্রতিযোগিতায় মেধা আর শারীরিক শক্তিই সব নয়, মানসিক শক্তিরও একটা বড় ভূমিকা আছে। অনেক সময় সেটাই মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। আমরা অনেক খেলায় ও প্রতিযোগিতায় নিশ্চিত বিজয়ের খুব কাছে গিয়ে চাপ সামলাতে না পেরে হেরে গেছি।

খাবার খেয়ে বা বুকডন দিয়ে মানসিক শক্তি সঞ্চয় ও সুরক্ষা করা যায় না। শিশু, কিশোর ও তরুণেরা এসব পান পারিবারিক পরিবেশ, বিদ্যালয়ের শিখনপদ্ধতি, শিক্ষকদের আচরণ ও সামাজিক মূল্যবোধ থেকে। অন্যভাবে বললে, বড়দের দেওয়া শাবাশ আর উৎসাহ থেকে ছোটরা আত্মবিশ্বাস তথা মানসিক শক্তি অর্জন করে। ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি ও বিজ্ঞানী এ পি জে আবদুল কালাম যেমন বলেছেন, ‘জীবনে যা–ই হোক, কখনো হাসতে ভুলে যেয়ো না। কারণ, এই হাসিটাই তোমাকে শক্তি আর সাহস জোগাবে।’ এ কথা কি কোনো দিন আমাদের কোনো শিক্ষক আমাদের বলেছেন? অথবা আমরা বলেছি আমাদের ছাত্রদের? আদব–লেহাজের তালিম দিতে দিতে আর সেটা কড়ায় গণ্ডায় আদায় করতে করতে আমাদের সময় খতম।

আমাদের এই দায়িত্বহীন অত্যাচারের নির্মম শিকার হচ্ছে আমাদের ভবিষ্যৎ শিশু–কিশোরেরা। তারা উদ্‌যাপন করতে গিয়েও তাল রাখতে পারছে না। কেটে যাচ্ছে তাল। আজ এত বড় একটা বিজয়ের মধ্যে দাঁড়িয়েও আমাদের বড় একটা বেইনসাফির শিকার হতে হলো। জিদানকে দেওয়া গালিটা কেউ শোনেনি, শোনা যায়নি, কিন্তু জিদানের প্রতিক্রিয়াটা কারও নজর এড়ায়নি।

ডাকাতের দলকে গ্যাং বলে। শিশু–কিশোরদের দলকে কেন আমরা কথায় কথায় গ্যাং বলব? তাদের দলবদ্ধ করা, দলবদ্ধ রাখা আমাদের দায়িত্ব। ক্রিকেটের যুব বিশ্বকাপ জয়ের পর এটার তাৎপর্য বোধ করি আর বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না। সাবেক সচিবেরা সরকারের থিংক ট্যাংকের সদস্য হওয়ার দরখাস্ত নিয়ে ছোটাছুটি না করে নিজ নিজ বিভাগে তরুণদের সংগঠিত করার একটা স্বেচ্ছা উদ্যোগ নিতেই পারেন।

গওহার নঈম ওয়ারা: গবেষক
[email protected]