তাঁরা কর ফাঁকি দিতে পর্যটন ভিসায় আসেন

২০১৮ সালে বাংলাদেশ থেকে বিদেশি কর্মীরা ২৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা পাচার করে নিয়ে গেছেন। কর ফাঁকি দিয়েছেন ১২ হাজার কোটি টাকা। মোট আড়াই লাখ বিদেশি কর্মীর মাধ্যমে এটা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তাঁদের মধ্যে ৯০ হাজার ছিলেন বৈধ কর্মী, বাকিরা এসেছেন পর্যটন ভিসায়। এই তথ্য-উপাত্তগুলো বেরিয়ে এসেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) গবেষণায়।

পাচারের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে কর ফাঁকি। কিছু মানুষের উদ্দেশ্য কর না দিয়ে বা কম দিয়ে টাকা এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিয়ে যাওয়া। শুধু ব্যক্তি নয়, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোও যে এ কাজ করে। যেসব দেশে করের হার বেশি, সেসব দেশ থেকে যেসব দেশে করের হার কম, সেখানে কর ফাঁকিবাজেরা অর্থ নিয়ে যান। ‘পানামা পেপার্স কেলেঙ্কারি’তে ফুটবল তারকা মেসি ও বলিউড স্টার অমিতাভ বচ্চনের মতো ব্যক্তির নামও ছিল। কর ফাঁকি বা কর সুবিধা নেওয়ার জন্যই এসব ঘটেছিল।

টিআইবির তথ্য অনুযায়ী ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মাত্র সাড়ে ৯ হাজার বিদেশি কর্মী আয়কর রিটার্ন জমা দিয়েছেন। এটা হওয়ার কথা নয়। কারণ, বলা হচ্ছে বৈধ কর্মীর সংখ্যা ছিল ৯০ হাজার, তাঁদের সবারই আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়ার কথা। কেন বাকিরা দেননি, তা আয়কর সার্কেল খুঁজে দেখতে পারে। যে প্রতিষ্ঠানের হয়ে তাঁরা কাজ করতে এসেছিলেন, তাদের কাছে কর সার্কেল জবাব চাইতে পারে।

বিদেশি কর্মীরা ই-ভিসার মাধ্যমে বাংলাদেশে কাজ করার জন্য বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটির (বিডা) অনুমতি নেন। বিডার অনুমতি পাওয়ার পর নিরাপত্তা ছাড়পত্র, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অনুমতি নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ই-টিআইএন এবং ব্যাংক হিসাব খুলতে হয়, যেখানে তাঁর বেতন জমা হবে। তাই তাঁদের নিয়ম অনুযায়ী আয়কর রিটার্ন দাখিল করার কথা।

যেসব বিদেশি কর্মী যথাযথ নিয়ম মেনে বাংলাদেশে এসে কাজ করেন, তাঁরা যদি প্রথম বছর বাংলাদেশে ১৮২ দিন বা তার বেশি অবস্থান করেন, তাহলে আয়কর আইনে নিবাসী হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেন। এর সুবিধা হলো একজন বাংলাদেশি ব্যক্তি করদাতা যে হারে কর দিয়ে থাকেন, সেই একই হারে বিদেশি কর্মীও কর দেওয়ার সুবিধা ভোগ করেন। কিন্তু যাঁরা বৈধভাবে এসেও বছরে ১৮২ দিন থাকতে পারেন না, তাঁদের অনিবাসী ধরা হয় এবং তাঁদের মোট আয়ের ওপর সরাসরি ৩০ শতাংশ হারে কর দিতে হয়। যেমন বিদেশ থেকে শিল্পীরা বাংলাদেশে প্রায়ই বাইরে থেকে এসে কনসার্ট করেন। ফিরে যাওয়ার আগে তাঁদের অবশ্যই ৩০ শতাংশ হারে কর পরিশোধের নিয়ম আছে। যে প্রতিষ্ঠান তাঁদের বাংলাদেশে নিয়ে আসে, তারা টাকা পরিশোধ করার সময় উৎসে করের টাকা কেটে বাকি টাকা তাঁদের পরিশোধ করবে।

বিদেশিদের পর্যটন ভিসায় এসে কাজ করা অবৈধ। এ ভিসার মেয়াদ তিন মাস। তাই তাঁকে ভিসা নবায়ন করার জন্য তিন মাস পরপর তাঁর নিজ দেশে চলে যেতে হয়। আর আসা-যাওয়ার খরচসহ আনুষঙ্গিক খরচ তো আছেই। বৈধভাবে এসে নিবাসী হলে কর সুবিধা পাওয়া যায়। কিন্তু কিছু বিদেশি নাগরিক এ দেশে কাজ করতে পর্যটন ভিসা নিয়ে আসেন? এর সুবিধা দুটো। এক. পর্যটন ভিসা পাওয়া সহজ। দুই. আয়কর পুরুটাই ফাঁকি দেওয়া যায়। কিন্তু ই-ভিসা পেতে হলে কোনো বিদেশি নাগরিক বাংলাদেশে যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করবেন, সেখান থেকে নানা কাগজপত্র জোগাড় করতে হয়, কয়েকটা ধাপ পেরোতে হয়।এসব প্রক্রিয়া তাঁদের একার পক্ষে সম্পন্ন করা সম্ভব নয়, পরামর্শকের সহায়তা নিতে হয়, সে জন্য পরামর্শককে ফি দিতে হয়। সরকারি ফি তো আছেই। ই-ভিসায় আরেকটি অসুবিধা হলো, বিদেশি কর্মীটি তাঁর বেতন পাবেন বাংলাদেশেই, আর স্বদেশে নিয়ে যেতে পারবেন তাঁর প্রাপ্ত মোট বেতনের ৭৫ শতাংশ।

পর্যটন ভিসায় বিদেশি নাগরিক এনে কাজ করালে আয়কর আইনে কঠোর জরিমানার বিধান রয়েছে। সরকারের অনুমতি ছাড়া কোনো বিদেশি নাগরিককে নিয়োগ দিলে তিন মাস থেকে তিন বছর পর্যন্ত জেল হতে পারে অথবা পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা হতে পারে অথবা উভয় দণ্ডই হতে পারে। এটা জেনেও যেসব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বিদেশি কর্মী নিয়োগ দেয়, তাদের সুবিধা কী? ঝামেলা এবং খরচ উভয়ই কমানো। বিদেশি কর্মীরা যেহেতু ই-ভিসা নেওয়ার বিষয়টা জানেন না, তাই এ কাজটা হয়তো বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানই করে দিচ্ছে। এর ফলে ঝামেলা এবং খরচ তাকেই নিতে হচ্ছে। আরেকটা বড় সুবিধা হলো কর ফাঁকি। বিদেশি কর্মীকে নগদে বেতন দিলে একদিকে যেমন বিদেশি কর্মী কর ফাঁকি দিতে পারছেন, অন্যদিকে বাংলাদেশি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানও আয়কর ফাঁকি দিতে পারছে। কারণ, আয়কর রিটার্নের সঙ্গে ব্যাংক বিবরণী জমা দিতে হয়। যেহেতু নগদে লেনদেন হয়েছে, তাই তাঁর ব্যাংকে কোনো আয়-ব্যয় প্রদর্শন হয়নি। এর ফলে কর কর্তৃপক্ষের পক্ষে প্রকৃত কর নির্ণয় করা সম্ভব হয় না।

বিদেশি কর্মী নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে একটি অজুহাত শোনা যায়, আমাদের দেশে দক্ষ কর্মীর অভাব রয়েছে। দেশি প্রতিষ্ঠানের বাইরে বিদেশি প্রতিষ্ঠানও বিদেশি কর্মী নিয়োগ দিয়ে থাকে। বর্তমানে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ এবং নির্মাণ খাতে প্রচুর বিনিয়োগ হচ্ছে চীন, জাপান, রাশিয়া থেকে। এসব দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশে লিয়াজোঁ অফিস বা শাখা অফিস খুলে কাজ করে। লিয়াজোঁ অফিস বা শাখা অফিসের জন্য অনুমতি নিতে হয় বিডা থেকে। অনুমতি নেওয়ার সময় শর্ত থাকে, নির্বাহী পদে একজন বিদেশিকে নিয়োগ দিলে এর বিপরীতে বাংলাদেশ থেকে পাঁচজনকে নিয়োগ দিতে হবে। এই অনুপাত না মানলে বিডা অনুমতি বাতিল করতে পারে।

কিছু ক্ষেত্রে দক্ষ জনবল না পাওয়ার সমস্যা আছে। যেমন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে দক্ষ কর্মী বাংলাদেশে না–ও থাকতে পারে। কারণ, এই কাজ বাংলাদেশে প্রথম হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে অনুপাত মানা সম্ভব না হলে বিডাতে আবেদন করতে হবে। পরে বিডা এই আবেদন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেবে। সেখান থেকে অনুমতি এলেই তারা এই অনুপাতের বাইরে বিদেশি কর্মী নিয়োগ দিতে পারবে।

তবে দেশে দক্ষ কর্মীর অভাব আছে, এটা সম্পূর্ণ সঠিক নয়। এখন বিদেশি কর্মীদের অবৈধভাবে পর্যটন ভিসা নিয়ে কাজ করতে আসা ঠেকাতে পারে বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশি মিশনগুলো। তিন মাস অন্তর অন্তর যখন ভিসার কোনো বিদেশি নাগরিক আবেদন করবেন, তখন দেখা দরকার তিনি লম্বা সময় ধরে বাংলাদেশে কোথায় থেকেছেন, কোথায় ঘোরাঘুরি করেছেন, টাকা কোথায় পেয়েছেন। এসব খতিয়ে দেখে ভিসা দিলেই অবৈধভাবে কাজ করা ঠেকানো যাবে। তবে সদিচ্ছার অভাবে অনেক কিছুই হয়ে ওঠে না।

আর কিছু ক্ষেত্রে হয়তো এখনই বিদেশি কর্মী ঠেকানো যাবে না। তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। দেশে রবি, গ্রামীণফোন এবং বিদেশে ইনটেল কোম্পানির শীর্ষ পদে বাংলাদেশিরা জায়গা করে নিয়েছেন। নিশ্চয়ই এ খবর দেশের তরুণদের প্রেরণা জোগাবে নিজেকে আগামীর জন্য যোগ্য করে তৈরি করতে। তখন বিদেশ থেকে কর্মী যেমন আনতে হবে না, তেমনি বিদেশে বাংলাদেশিরা বিভিন্ন নামী কোম্পানির শীর্ষ পদে নেতৃত্ব দিতে পারবেন।

জসীম উদ্দিন রাসেল: চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট
[email protected]