বাংলাটা ঠিক আসে না

ভাষা মানুষের সংস্কৃতির অন্যতম নিয়ন্ত্রক। মানুষের মনস্তাত্ত্বিক অবস্থাকে বাস্তব রূপ দেয় ভাষা। এ জন্যই ভাষা শিক্ষা মানুষের প্রাচীন ইতিহাস থেকেই জ্ঞানের সবচেয়ে উৎকৃষ্ট পথ হিসেবে স্বীকৃত। যে যত বেশি ভাষা জানত, সে সমাজে তত বিজ্ঞ বলে পরিচিত হতো, সম্মান পেত। ভাষা জানার পর দেশভ্রমণে বের হতো কেউ, কেউ নানা ভাষার পুস্তক অধ্যয়ন করে জ্ঞান আহরণ করে নিজ ভাষায় তা অনূদিত করত। সে যুগে ভাষা ছিল জ্ঞান আহরণের মাধ্যম, আজকে ভাষা হয়ে দাঁড়িয়েছে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বাহন। কীভাবে?

এখন আমরা ইংরেজি বলাকে জাতে ওঠার একটি মাধ্যম হিসেবে নিচ্ছি। কথার মধ্যে প্রয়োজন ছাড়া ইংরেজি বলাটা স্বাভাবিকতার স্বীকৃতি পেয়েছে। খালি চোখে এসব সাধারণ মনে হলেও দেশ ও জাতির জন্য অশনিসংকেত। কারণ, ইন্টারনেট ও স্যাটেলাইটপ্রযুক্তির এই যুগে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন অর্থনৈতিক আগ্রাসনের দরজা খুলে দেয়। আমরা যখন একটি–দুটি করে নিজের ভাষার শব্দ ছেড়ে ভিন ভাষার শব্দ আঁকড়ে ধরব, ততই সেই ভিন ভাষাভাষীদের আনুগত্যের জন্য তৈরি হব। তখন বলব, আমার না বাংলাটা ঠিক আসে না।

নিজ ভাষায় শব্দ থাকার পরেও অন্য ভাষা ব্যবহারে যতটা ‘স্বাভাবিক’ হব আমরা, ততটা অন্য জাতির প্রতি মানসিক দাসত্বকেও স্বাভাবিক ভাবা শুরু করব। নিজের জাতিসত্তার গৌরবের ধারণা লোপ পাবে এবং এই মানসিকতা ধীরে ধীরে বিদেশি পণ্য ও সংস্কৃতিতে আমাদের মজিয়ে ফেলবে। এতে নিজের সংস্কৃতি ও পণ্য নিজ দেশেই অবহেলিত হবে। এই সাংস্কৃতিক প্রান্তীকরণই ‘দেশি জিনিস বা পণ্য তেমন ভালো না’ ধরনের মানসিকতার গণসম্মতি তৈরি করে। এর পরিণতি হয় ভয়াবহ। ইতালির তাত্ত্বিক আন্তোনিও গ্রামসি রাষ্ট্রের কর্তৃত্বপরায়ণ শাসক দ্বারা সাংস্কৃতিক শোষণের যে কথা বলেছিলেন, আজকের ইন্টারনেটনির্ভর পৃথিবীতে তা প্রভাব বিস্তারকারী (যেমন: ইংরেজি, হিন্দি) ভাষার মাধ্যমে ওই ভাষাভাষী রাষ্ট্রগুলো চালাচ্ছে।

আমি আন্তর্জাতিক একটি সম্মেলনে চেক রিপাবলিকের ইজবিনেক নামের এক গবেষকের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। তাঁর কথা হচ্ছে, ইউরোপে ব্রিটেন ছাড়া আর কোনো দেশে বাংলাদেশের মতো এতটা ইংরেজি ব্যবহার করা হয় না। নিজের ভাষা থাকতে অন্যের ভাষা ব্যবহারকে তারা ভীষণ অপমানজনক একটি বিষয় মনে করে। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, সেই সম্মেলনে ইজবিনেক ও জাপানের এক গবেষক এবং জার্মানির হাইডেলবার্গের হান্স হার্ডার বাংলায় কথা বললেও বাংলাদেশ ও ভারতের বাংলা ভাষাভাষী অধিকাংশ ব্যক্তি তাঁদের সঙ্গে ইংরেজি ভাষায় কথা বলার প্রচেষ্টা করছিল। এটি দেখে চীন থেকে আসা প্রায় শতবর্ষী একজন অধ্যাপক বললেন, নিজের ভাষাকে গুরুত্ব না দিলে কোনো জাতি কিন্তু টিকে থাকতে পারবে না।

আন্তর্জাতিক নানা সম্মেলনে বা দ্বিপক্ষীয়, বহুপক্ষীয় সভায় এ কারণেই ভ্লাদিমির পুতিন, আঙ্গেলা ম্যার্কেল, এমানুয়েল মাখোঁ, এরদোয়ান, সি চিন পিং তাঁদের নিজ নিজ ভাষায় কথা বলেন। তাঁদের মধ্যে ভাষান্তরকারী থাকেন অন্যপক্ষকে কথা বুঝিয়ে দিতে। নিজের ভাষা ছেড়ে অন্যের ভাষায় কথা বলাকে তাঁদের কাছে অমর্যাদাকর মনে হয়। কারণ তাঁরা জানেন, ভাষার মাধ্যমে অন্য জাতির প্রতি সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক দাসত্বের সূত্রপাত ঘটে। বিশ্বের প্রতিটি উন্নত জাতির উন্নতির পেছনে নিজের ভাষা ও সংস্কৃতিকে সবার আগে স্থান দেওয়া অন্যতম কারণ হিসেবে পরিগণিত হয়েছে।

বাংলাদেশে সামাজিক মাধ্যম থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বাংলার অমর্যাদা দেখা যায়। এমনকি আমাদের আদালতের ভাষাও পুরোপুরি বাংলা নয়। আমলাতান্ত্রিক প্রতিটি কাজে ইংরেজি অগ্রাধিকার পায়। চাকরির মৌখিক পরীক্ষায় ইংরেজিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়, এমনকি প্রজাতন্ত্রের ইংরেজি না-জানা জনতার অধিপতি থাকার ইচ্ছায় সরকারি কর্ম কমিশনের প্রধান ইংরেজিকে গুরুত্ব দেন প্রকাশ্যে। জার্মান না জানা থাকলে জার্মানিতে চাকরিই পায় না কেউ। আর আমাদের দেশে ঔপনিবেশিক ইংরেজি না জানলেই বরং কেউ চাকরি পায় না। মানে কী? আমরা কি স্বনির্ভর না হওয়াকে জাতির আলোচ্য সূচি করেছি?

টেলিভিশন মাধ্যমে উপস্থাপকদের মধ্যে অহেতুক ইংরেজি বা কিছু ক্ষেত্রে হিন্দি বলা স্বাভাবিক বিষয় হয়ে গেছে। বিজ্ঞাপন, বিলবোর্ড, দোকানপাট, যান, প্রচারণা, কথাবার্তা, এমনকি বাংলা একাডেমির দায়িত্বশীলরাও ইংরেজি সংস্করণেই সব ভাবছেন যেন! একই সঙ্গে বিভিন্ন বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানের চরিত্রও ইংরেজিঘেঁষা। এতে আমাদের দর্শকদের মধ্যে ইংরেজি বলে জাতে ওঠার এই হীন মানসিকতা ধীরে ধীরে বাড়ছে। জ্ঞানার্জনের জন্য অন্য ভাষা শেখা, সে ভাষার বই পড়া, চলচ্চিত্র দেখা এক কথা আর নিজের ভাষাকে অবজ্ঞা করে অন্য ভাষাকে প্রতিনিয়ত ব্যবহার করা অন্য কথা। দ্বিতীয় কারণে আমাদের জাতীয়তাবোধ ধীরে ধীরে বিপন্ন হচ্ছে। আমাদের দেশের সর্বক্ষেত্রে আজও মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা আজও পর্যাপ্তসংখ্যক পুস্তক বাংলায় রচনা করতে পারেননি। এই না পারাটাকে ঢাকতে তাঁরা ইংরেজিপ্রেম দেখান। অথচ স্বাধীনতার অর্ধশতকে আমাদের যেহেতু রাষ্ট্রের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ থেকে গণমাধ্যম, বিজ্ঞাপন, চাকরি, ব্যবসা, শিক্ষালয়—সর্বত্র বাংলা ভাষার চেয়ে অন্য ভাষাকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে, সেহেতু আমাদের এই প্রজন্মের মধ্যে দেশের ব্যাপারে ইতিবাচকতা জন্ম নেওয়ানো কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এমনকি ভারতের চেয়ে নানা সূচকে আমরা এগিয়ে থাকলেও তাদের ভাষিক আধিপত্যের কারণে অনেক বাংলাদেশি হীনম্মন্যতায় ভোগেন। আমাদের ভাষা নিয়ে আরও বিস্তৃত ভাবার সময় এসেছে।

আমি বাংলাদেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতিবিষয়ক একটি বিষয়ে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করি। এই কোর্সও তারা ইংরেজিতে লেখে। তো তারা আমাকে প্রশ্ন করল, আমরা কেন আমাদের ইতিহাস, ভাষা ও সংস্কৃতি অন্যের ভাষায় লিখব? আপনি আমাদের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতা পড়াচ্ছেন, তারা আমাদের ওপর অত্যাচার করেছে, আমাদের সম্পদ লুট করেছে, আমাদের নীল চাষে বাধ্য করেছে, আমাদের দেশের ফসল লোপাট করে কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ তৈরি করে লাখ লাখ বাঙালিকে হত্যা করেছে, কিন্তু আমরা এসব কেন তাদের ভাষায় পড়ব? তাদেরই ভাষায় লিখব? ওরা বলে, যদি আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতি এতই সমৃদ্ধ হয়, তবে কেন অন্যের ভাষায় তা লিখতে হয়? ওরা কি বাংলা ভাষায় লেখে ওদের ইতিহাস?

আমি এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিনি। ওরা আমার স্বাক্ষর নিয়ে এই বিষয়টি বাংলায় অধ্যয়ন করে পরীক্ষা দিতে চেয়ে দরখাস্ত দিয়েছিল। কর্তৃপক্ষ নাকচ করে দিয়েছে।

পুরো দেশেই বাংলা ভাষা ও বাঙালির সংস্কৃতিকে এভাবে নাকচ করা হচ্ছে। এই নাকচ আর ১৩৫৮–এর ৮ ফাল্গুনের ভাষাবিদ্রোহের দাবি নাকচের মধ্যে তফাত কতটুকু, সেটি নির্ণয়ের মধ্যেই বাঙালি জাতির পৃথক জাতিসত্তা হিসেবে টিকে থাকার সম্ভাবনা কতটুকু, সে উত্তর লুকায়িত।

মঈনুল ইসলাম: প্রভাষক, সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগ বিভাগ, নর্দার্ন ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজি, খুলনা।