পোশাক কারখানাগুলোর অগ্রগতি

বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি আয়ের উৎস তৈরি পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের কর্মস্থলের পরিবেশ একসময় বিশৃঙ্খল, অস্বাস্থ্যকর ও ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। অধিকাংশ পোশাক কারখানার ভবনে অগ্নিনিরাপত্তার ব্যবস্থা ছিল না, ভবনধস ও অন্যান্য দুর্ঘটনা মোকাবিলা করার ব্যবস্থাও ছিল বেশ দুর্বল। অনেক পোশাক কারখানায় বড় বড় অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে, অনেক শ্রমিক নিহত হয়েছেন, গুরুতর আহত হয়ে কর্মক্ষমতা হারিয়েছেন।

২০১৩ সালে সাভারের রানা প্লাজা ধসে ১১ শতাধিক মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনায় বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের ভাবমূর্তি ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। কারণ, রানা প্লাজায় নিহত মানুষের প্রায় সবাই ছিলেন পোশাকশ্রমিক। ফলে আমাদের পোশাক কারখানাগুলোতে কর্মরত শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন উঠেছিল। শ্রমিকদের নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করাসহ তাঁদের কর্মস্থলের পরিবেশের সার্বিক উন্নয়নের দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠেছিল সমাজ। তখন আমাদের তৈরি পোশাকের ইউরোপীয় ক্রেতারা জোটবদ্ধ হয়ে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্প ও এই খাতের ট্রেড ইউনিয়নগুলোর সঙ্গে পাঁচ বছর মেয়াদি এক চুক্তি করে, যা ‘অ্যাকর্ড অন ফায়ার অ্যান্ড বিল্ডিং সেফটি ইন বাংলাদেশ’, সংক্ষেপে ‘অ্যাকর্ড’ নামে পরিচিতি লাভ করে। এই চুক্তির লক্ষ্য বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পের কর্মস্থলের নিরাপত্তাব্যবস্থা উন্নত করা এবং এর ওপর নিয়মিত নজরদারি নিশ্চিত করা।

ইউরোপীয় ক্রেতাদের জোট বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলো পরিদর্শন করে ৩৪ হাজার ৩৭৯টির অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থায়, ৩৫ হাজার ১২৬টির বৈদ্যুতিক সংযোগব্যবস্থায় এবং ১৯ হাজার ৯৫৯টির ভবনের কাঠামোতে ত্রুটি শনাক্ত করেছিল এবং এগুলো সংশোধনের তাগিদ দিয়েছিল। এর পরের গত কয়েক বছরে কারখানাগুলো এসব ত্রুটি সংশোধনের কাজ করেছে; অ্যাকর্ডের সর্বশেষ প্রতিবেদনে একটা স্বস্তিকর চিত্র পাওয়া গেল। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২৭৩টি পোশাক কারখানায় প্রাথমিক পরিদর্শনে যেসব ত্রুটি ধরা পড়েছিল, সেগুলোর শতভাগ সংশোধন সম্পন্ন হয়েছে। আর ১ হাজার ১৭৩টি পোশাক কারখানার ত্রুটি সংশোধনের লক্ষ্যে সম্পাদিত সংস্কারকাজের ৯০ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। এটা নিঃসন্দেহে আশাব্যঞ্জক অগ্রগতি।

তবে প্রতিবেদনে এ-ও বলা হয়েছে যে রানা প্লাজা ধসের সাত বছর পরও ৪৫ শতাংশ পোশাক কারখানা অগ্নিদুর্ঘটনা শনাক্ত করার ও সতর্কসংকেত বাজানোর স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা স্থাপন করেনি; জরুরি নির্গমন পথে উজ্জ্বলভাবে দৃশ্যমান নির্দেশিকা স্থাপন করেনি ৬ শতাংশ কারখানা এবং ২ শতাংশ পোশাক কারখানায় তালাবদ্ধ ফটক আছে। এই কারখানাগুলোর কোনো একটিতে অগ্নিকাণ্ড বা অন্য কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে এবং তার ফলে শ্রমিকদের মৃত্যু হলে এই কয়েক বছরের অর্জন নষ্ট হতে পারে। তাই এগুলোকে যথাসম্ভব দ্রুত ওই সব ত্রুটি দূর করার জন্য তাগিদ দিতে হবে।

লক্ষণীয় বিষয় হলো, বাংলাদেশের মোট প্রায় ৪০ হাজার তৈরি পোশাক কারখানার সিংহভাগই ‘অ্যাকর্ড’-এর সদস্য নয়; মাত্র হাজার দেড়েক বড় কারখানা, যাদের কাছ থেকে ইউরোপীয় ব্র্যান্ডগুলো তৈরি পোশাক কিনে থাকে, তারাই এই চুক্তির অধীনে পরিচালিত হয়ে আসছে। উপরন্তু অ্যাকর্ডের কার্যমেয়াদও শেষ হয়ে আসছে, শিগগিরই এর স্থলাভিষিক্ত হতে যাচ্ছে রেডিমেড গার্মেন্টস সাসটেইনেবিলিটি কাউন্সিল নামের এক নবগঠিত জাতীয় প্রতিষ্ঠান। সুতরাং যে বিপুলসংখ্যক পোশাক কারখানায় এখনো কর্মপরিবেশে নিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকি সম্পূর্ণভাবে দূর করা হয়নি, তাদের নতুন করে তাগিদ দিতে হবে। বিজিএমইএ ও সরকারকে এ কাজ বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে করতে হবে। অ্যাকর্ডের অধীন হোক বা না হোক, প্রতিটি পোশাক কারখানার নিরাপত্তাব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।