কেন্দ্রীয় ভর্তি পরীক্ষা: মতামতগুলো নিচ থেকে আসা জরুরি নয় কি

শিক্ষার্থীদের কষ্ট লাঘব করতে গিয়ে যেন ভিন্ন ধরনের অসুবিধা সৃষ্টি না হয়
শিক্ষার্থীদের কষ্ট লাঘব করতে গিয়ে যেন ভিন্ন ধরনের অসুবিধা সৃষ্টি না হয়

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে বেশ কয়েক বছর ধরেই টুকটাক কথা হচ্ছে। তবে রাষ্ট্রপতি বলার পর এ নিয়ে আলোচনা বেড়েছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন দিন পরীক্ষা হওয়ায় শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের অর্থনৈতিক, মানসিক ও শারীরিক যে ধকল সহ্য করতে হয়, তা এ সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্রপতির ভাষণে উল্লেখিত হওয়ার পরই বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এ বিষয়ে ত্বরিত সিদ্ধান্ত নেওয়ার তাগাদা বোধ করতে থাকে। তবে এতে এত দিন সায় ছিল না ৭৩–এর অধ্যাদেশের অধীনে পরিচালিত চারটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের। এবং এত দিন ইউজিসি সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতির ধারণা নিয়ে এগোচ্ছিল। ১২ ফেব্রুয়ারি উপাচার্য পরিষদের সভায় সমন্বিত পদ্ধতির বদলে কেন্দ্রীয় ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তাব ওঠে, চারটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা একাডেমিক কাউন্সিলের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ওপর গুরুত্ব দিয়ে কেন্দ্রীয় ভর্তি পরীক্ষার বিষয়েই একমত হন।

কোনো পরীক্ষা কী প্রক্রিয়ায় পরিচালিত হবে, কারা পরিচালনা করবেন, কারা প্রশ্নপত্র তৈরি করবেন, উত্তরপত্র মূল্যায়ন করবে কারা—এসব বিষয়ে পরিষ্কার চিত্র তুলে ধরা প্রয়োজন। যদি শিক্ষার্থীদের ঝামেলা কমাতেই এই পদ্ধতির দিকে যাওয়া, তাহলে সম্ভাব্য সমস্যাগুলো আমলে না নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ শিক্ষার্থীদের উপকার বয়ে আনবে এমন নিশ্চয়তা নেই। একটা বড় প্রশ্ন হলো, এত বড় কলেবরে পরীক্ষা নেওয়ার মতো সক্ষমতা আমাদের আছে কি না। এর ব্যবস্থাপনা বা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে কে বা কারা থাকবে? ইউজিসি? শিক্ষা মন্ত্রণালয়? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়? দায়িত্বটি শিক্ষা মন্ত্রণালয় নিলে প্রশ্ন উঠবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্তৃত্ব, খবরদারি ও নিয়ন্ত্রণ কি গ্রহণযোগ্য হবে? অন্যদিকে এত বড় পরীক্ষা পরিচালনার সামর্থ্য ইউজিসির নেই। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে প্রতিবছর বিভিন্ন ইউনিটের পরীক্ষা নিতেই হিমশিম খায় এবং প্রতিবছর প্রশ্ন ফাঁসের উদ্বেগ থাকে, সেখানে তাদের পক্ষেও এ পরীক্ষা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা খুব কঠিন হবে। আরও নানা প্রশ্ন এখানে রয়েছে, যেমন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন শিক্ষকদের কী ধরনের ভূমিকা থাকবে, কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের কারা ও কতজন এর সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকবেন। গত বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমসিকিউর পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের ভাষাগত ও বিশ্লেষণের সামর্থ্য মূল্যায়নের জন্য সৃজনশীল প্রশ্ন রাখা হয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো, খাতা মূল্যায়ন কারা করবেন? মূল্যায়নের ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার মানদণ্ড কী হবে?

কেন্দ্রীয় বা সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে শ্রেণি বিভাজন আরও প্রকট হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্তরবিন্যাস কীভাবে হবে? স্তরবিন্যাসের ভিত্তি কী হবে? এর মাধ্যমে আমরা বিদ্যমান একাডেমিক রেসিজমকে আরও উসকে দিচ্ছি কি না, সেটিও ভাবতে হবে। এ দেশে একটি বিশ্ববিদ্যালয় সব বিষয়ই ভালো, এ রকম ভাবার কোনো কারণ নেই। কারণ, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়েই ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ের জন্য ভিন্ন ভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় সেরা। কেন্দ্রীয় পরীক্ষার ফলে অলিখিতভাবেই ছাত্রদের প্রথম পছন্দের জায়গা, দ্বিতীয় পছন্দের জায়গা ইত্যাদির একটি ক্রম তৈরি হয়ে যাবে এবং সেটি একটি বড় ধরনের মানসিক বৈষম্যের খোরাক জোগাবে।

আরও যে বিষয়টি আড়ালে ফিসফাসের উপাদান হচ্ছে তা হলো, এ ধরনের পরীক্ষায় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকারদলীয় সমর্থক শিক্ষকদের আধিপত্য বিস্তারের লড়াই এবং সেটিকে কেন্দ্র করে নানা ধরনের সমস্যার সম্ভাবনা। ক্ষমতাসীন দলের বাইরে অন্য শিক্ষকদের ভূমিকার সুযোগ কমে যাবে এবং ভর্তি পরীক্ষার মতো একটি বিষয়ও দলীয় রাজনীতির অংশে পরিণত হবে।

কেন্দ্রীয় বা অভিন্ন বা সমন্বিত পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের জন্য আরও একটি সমস্যা হবে এ রকম: অসুস্থতা বা অন্য কোনো গুরুতর কারণে কোনো পরীক্ষার্থী পরীক্ষা দিতে না পারলে, দিতে পারলেও পরীক্ষা খারাপ হলে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্নের কী হবে? তার জন্য কি আরেকবার পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ থাকবে?

যথেষ্ট পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়া এত বড় পরীক্ষার সিদ্ধান্ত এত তড়িঘড়ি করে নেওয়া কি ঠিক হলো? সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা কী চান, তা একাডেমিক কাউন্সিলে জেনে তার ভিত্তিতে মতামত নেওয়ার কি প্রয়োজন ছিল না? মানি, উপাচার্যের সিদ্ধান্ত ক্ষমতাসীন সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভরশীল। সাধারণ শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্তটি নেওয়া হলে তার গুরুত্ব অন্য রকম হতো। এখন সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার মতোই মনে হচ্ছে। উপাচার্যরা কি সত্যিই শিক্ষার্থীদের কথা ভেবে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, নাকি ওপরের মানুষকে খুশি করতে রাজি হয়েছেন? শিক্ষার্থীদের কষ্ট কমানোর আরও অনেক ধরনের পথ খোলা ছিল, আছে। কেন্দ্রীয়ভাবে পরীক্ষা নেওয়ার পদ্ধতিই এ মুহূর্তে একমাত্র সমাধান নয়।

কেন্দ্রীয়ভাবে পরীক্ষা হতেই পারে। তবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, সম্ভাব্য সব সমস্যা নিরূপণ ও সেগুলো মোকাবিলা করার সম্ভাব্য পথ নির্ধারণ এবং প্রয়োজনীয় সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করার পরেই এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া ভালো। এটা যেন এক্সপেরিমেন্টের বিষয় না হয়। ‘প্রথমবার কিছু ভুল–ত্রুটি থাকবে’—এ ধরনের মনোভঙ্গি এত বড় ও গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য হবে না। শিক্ষার্থীদের কষ্ট লাঘব করতে গিয়ে যেন ভিন্ন ধরনের অসুবিধা সৃষ্টি না হয়।

কেন্দ্রীয় পদ্ধতির বিরোধিতা নয়, ক্ষেত্র প্রস্তুতের আগেই এটি বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ কি না, সেটাই প্রশ্ন। কীভাবে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের নানামুখী চাপ কমানো যায়, তা নিয়ে আলোচনার পরিবেশ তৈরি করা জরুরি। একজন শিক্ষার্থীও যদি অব্যবস্থাপনা বা অবিচারের শিকার হন, তার দায়ভার আমাদেরই নিতে হবে।

জোবাইদা নাসরীন: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক
[email protected]