বায়োমেট্রিক পদ্ধতির হুমকি

রয়টার্স প্রতীকী ছবি
রয়টার্স প্রতীকী ছবি

বিশ্বজুড়ে সরকারগুলো বায়োমেট্রিক শনাক্তকরণ পদ্ধতির প্রলোভনে পড়ছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিশেষ করে আধুনিক রাষ্ট্রগুলোতে এই পদ্ধতি হয়তো অনিবার্য। তবে এই প্রযুক্তিগুলোর ঝুঁকির বিষয়টি কারোরই ছোট করে দেখা উচিত হবে না।

বায়োমেট্রিক শনাক্তকরণ পদ্ধতিগুলো মানুষের পরিচয় যাচাই করার জন্য তাদের আঙুলের বা হাতের ছাপ, মুখমণ্ডল, কণ্ঠস্বর, কনীনিকা, শিরার মানচিত্র এমনকি মস্তিষ্কের তরঙ্গগুলো ব্যবহার করে। পাসপোর্ট ও ভিসা যাচাই করতে এবং নিরাপত্তার হুমকি শনাক্ত করতে সরকারগুলো এই প্রযুক্তির প্রয়োগ ঘটাচ্ছে।

বেসরকারি সংস্থাগুলোও বায়োমেট্রিক শনাক্তকরণ পদ্ধতি গ্রহণ করেছে। স্মার্টফোন লক-আনলক করতে আঙুলের ছাপ ও মুখমণ্ডল শনাক্তকরণ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। আর্থিক পরিষেবাদিসহ বিভিন্ন পরিষেবার জন্য বিভিন্ন পাসওয়ার্ডের পরিবর্তে ব্যবহারকারীরা কেবল তাঁদের ফোনের একটি বোতামে আঙুলটি রাখেন অথবা ফোনের ক্যামেরার লেন্সে মুখটি দেখিয়ে দেন।

এটা অবশ্যই সুবিধাজনক। এবং প্রথম নজরে এটিকে অনেক বেশি সুরক্ষিত বলে মনে হতে পারে: কিন্তু আসলে তা নয়। আপনার তথ্য সরকারের কাছে থাকতেই পারে। কিন্তু সমস্যা তখনই হয়, যখন সেটি তৃতীয় পক্ষের কাছে চলে যায়। গত কয়েক বছরে ফেসবুক-টুইটার তাদের ব্যবহারকারীর এসব তথ্য ব্যবহার করে কোটি কোটি টাকা আয় করেছে। বিজ্ঞাপনী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে তারা এসব তথ্য বিক্রি করে। আপনার বায়োমেট্রিক তথ্য দিয়ে আপনাকে ইন্টারনেটে শনাক্ত করা সহজ হয়। আপনার কাছে তারা বিজ্ঞাপনগুলো সহজে পৌঁছাতে পারে। ফেসবুক, ‍টুইটার শুধু বিজ্ঞাপনের কাজে সীমাবদ্ধ থাকলেও বিভিন্ন ব্যাংকিং অ্যাপে এগুলো নিরাপদ নয়। আপনার হাতের ছাপ তারা ব্যবহার করে আপনাকে নিঃস্ব করে দিতে পারে!

অন্যান্য অনেক সুবিধাজনক প্রযুক্তির মতো, আমরা বায়োমেট্রিক শনাক্তকরণ পদ্ধতির ঝুঁকিগুলোকেও খুব একটা পাত্তা দিই না। ভারত এই ঝুঁকি সম্পর্কে জেনেছে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের ২১০টি ওয়েবসাইট থেকে আধার তথ্য ফাঁস হওয়ার ঘটনা থেকে।

মূলত আধার প্রকল্পটির প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল সরকারি সুবিধাগুলো পরিচালনা করা এবং সরকারি ভর্তুকির ‘অযাচিত সুবিধাভোগীদের’ নির্মূল করা। তবে এটি এখন অনেক ক্ষেত্রে কাজে লাগছে: ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা থেকে স্কুলে শিশুদের ভর্তি করা, হাসপাতালে ভর্তি হওয়া—সবকিছুর জন্য এখন আধার কার্ড দরকার। দুর্নীতি রোধে নরেন্দ্র মোদির সরকার প্যান কার্ড, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, রেশন কার্ড, মিড–ডে মিল, রান্নার গ্যাস, বিমা ইত্যাদিতে আধার কার্ড নম্বর যোগ বাধ্যতামূলক করেছে। ভারতের জনসংখ্যার ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ এই প্রকল্পে নাম তালিকাভুক্ত করেছে।

তবে এখন আধার প্রকল্পে গুরুতর দুর্বলতা দেখা দিয়েছে। বায়োমেট্রিক যাচাই চূড়ান্ত প্রযুক্তিগত সমাধানের মতো মনে হতে পারে, তবে মানুষের ভুল উল্লেখযোগ্য ঝুঁকি তৈরি করেছে, বিশেষত যখন ডেটা সংগ্রহের পদ্ধতিগুলো যথেষ্ট নিখুঁত নয়। ভারতে, সরকার আধার প্রকল্পে প্রচুর মানুষকে দ্রুত তালিকাভুক্ত করতে চেয়েছিল, তাই ক্ষুদ্র পরিষেবা সরবরাহকারীদের কাছে তথ্য সংগ্রহের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তাঁরাই এসব ভুল করেছেন।

যদি আঙুলের ছাপ বা চোখের মণির ছাপ নেওয়ার সময় সেগুলো একটু সরে যায় বা কাত হয়ে যায়, তাহলে ভবিষ্যতে যাচাইয়ের সময় এসব ছাপ মেলে না। এ ছাড়া দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে যেসব শ্রমিক কাজ করেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, তাঁদের আঙুলের ছাপ পরিবর্তিত হতে পারে। তখন রেকর্ড করা ছাপের সঙ্গে মিল পাওয়া যায় না।

এ ধরনের ত্রুটিগুলো সংশোধন করা একটি জটিল প্রক্রিয়া। আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে এটা তখন মারাত্মক সমস্যা হয়ে দেখা দেয়। বায়োমেট্রিক ছাপের সঙ্গে ব্যক্তির আঙুল বা কনীনিকার অমিলের ফলে রেশন নিতে বা মজুরি পেতে বহু লোককে সমস্যায় পড়তে হয়েছে।

ভারতের গুজরাট রাজ্যের পুলিশ সম্প্রতি সিলিকনজাতীয় উপাদানের ওপর ১ হাজার ১০০টির বেশি সুবিধাভোগী ব্যক্তির আঙুলের ছাপ খুঁজে পেয়েছে, যেগুলো কিনা সরকারি বিতরণ ব্যবস্থা থেকে অবৈধভাবে খাদ্য নেওয়ার কাজে ব্যবহৃত হয়েছে। যেহেতু আমরা যা কিছু স্পর্শ করি সবকিছুর ওপরে আমরা আঙুলের ছাপ রাখছি, তাই আমরা সবাই ঝুঁকির মধ্যে আছি।

বায়োমেট্রিক তথ্য স্থানান্তর এবং সংরক্ষণের সময় আরও ঝুঁকি দেখা দেয়। একবার সংগ্রহ করা হলে, বায়োমেট্রিক তথ্য সাধারণত সংরক্ষণের জন্য একটি কেন্দ্রীয় ডেটাবেইসে স্থানান্তরিত হয়। আর এই স্থানান্তরের সময় তথ্যগুলো হ্যাকড হতে পারে। এমনকি স্থানীয়, বিদেশি বা ক্লাউড সার্ভারগুলোতে আসার পরও তথ্যগুলো যে নিরাপদ, তা নিশ্চিত করে বলার উপায় নেই।

অবশ্যই সব ব্যক্তিগত তথ্যে এই জাতীয় দুর্বলতা বিদ্যমান। তবে কারও বায়োমেট্রিক তথ্যের ফাঁস হওয়াটা, একটি পাসওয়ার্ড বা ক্রেডিট কার্ড নম্বর প্রকাশের চেয়ে অনেক বেশি বিপজ্জনক, কারণ, আঙুলের বা কনীনিকার ছাপ ধ্বংস করা যায় না। আর আমরাও নতুন কনীনিকা পেতে পারি না।

চীন এবং অন্য কোথাও যেমন ঘটে থাকে তদারকি ও নজরদারি করার জন্য সংগৃহীত বায়োমেট্রিক তথ্য ব্যবহারের প্রচেষ্টার ফলে এই ঝুঁকি আরও বাড়ছে। এই অর্থে, বিশালসংখ্যক মানুষের বায়োমেট্রিক তথ্যভান্ডার তাঁদের গোপনীয়তার জন্য এক অভূতপূর্ব হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এবং মাত্র কয়েকটি দেশ তাদের বাসিন্দাদের সুরক্ষার জন্য আইন প্রণয়নের কাছাকাছি রয়েছে।

বায়োমেট্রিক শনাক্তকরণ পদ্ধতিগুলো আমাদের জীবনের প্রতিটি দিককে ঘিরে রেখেছে। যতক্ষণ পর্যন্ত নাগরিকেরা ও নীতিনির্ধারকেরা এ পদ্ধতির ঝুঁকিগুলো শনাক্ত না করবে, ততক্ষণ পর্যন্ত কারও নিজেকে নিরাপদ বোধ করা উচিত নয়।

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ইংরেজি থেকে অনূদিত
জ্যোতি ঘোষ: নয়াদিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক