জনশক্তি রপ্তানি নিম্নমুখী

বাংলাদেশ দীর্ঘকাল একটি জনশক্তি রপ্তানিমুখী দেশ এবং সেই সুবাদে রেমিট্যান্সকে বিদেশি মুদ্রা অর্জনের অন্যতম মুখ্য হাতিয়ার হিসেবে দেখে চলছে। কিন্তু এই ধারণার আমূল পরিবর্তন ও হালনাগাদ করার সময় এসেছে। গত বছরে প্রবাসীরা আয় পাঠানোয় রেকর্ড তৈরি করেছেন। ইতিহাসে এটিই সর্বোচ্চ। আবার টানা দুই বছর জনশক্তি রপ্তানি কমছে। অনেক আগ থেকেই এই খাতে একটা মন্দাভাব লক্ষ করা যায়। তদুপরি বেশি আয়, নিম্নমুখী জনশক্তি রপ্তানি—দুটোই বাস্তবতা। সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হলো, বিদেশি শ্রমবাজার তার প্রয়োজন অনুযায়ী জনশক্তি আমদানি করে। অবশ্যই কোনো বিদেশি সরকারের জনশক্তি নীতির আলোকে নয়।

সরকারকে যা অনতিবিলম্বে বিবেচনায় নিতে হবে, তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি দিক হলো, প্রথমত ধরে নিতে হবে, বিশ্ব শ্রমের বাজারে আর অদক্ষ বা আধা দক্ষ শ্রমিকদের কদর বাড়বে না। এর চাহিদা দ্রুত নিচে নামছে। তাই দেশ গঠনে যেমন, তেমনি বিদেশে কর্মসংস্থান জোটাতে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা ছাড়া বিকল্প নেই।

দ্বিতীয়ত, বিদেশে জনশক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রে অকারণ রিক্রুটিং এজেন্সিনির্ভরতা কমাতে হবে। জনমনে একটা ভ্রান্তি আছে যে, এই সংস্থাগুলোই বিদেশে শ্রমের বাজার তৈরিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। কিন্তু বাস্তবতা একদম তা নয়। বরং শতকরা ৮০ ভাগের বেশি ভিসা ব্যক্তি নিজেই জোগাড় করে। কিন্তু আইন বলছে, রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমেই যেতে হবে। এই এজেন্সিগুলোর জবাবদিহি সরকার নিশ্চিত করতে পারেনি। এখানে সুশাসনের শর্ত পূরণ করতে হবে।

তৃতীয়ত, জনশক্তি রপ্তানিতে এজেন্ট বা দালালেরা শক্তিশালী ভূমিকা রাখেন। কিন্তু তাঁদের কারণেই মানুষ সবচেয়ে বেশি প্রতারিত হচ্ছে। ২৬ আগস্ট ২০১৯ অভিবাসনবিষয়ক জাতীয় স্টিয়ারিং কমিটির প্রথম সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘দালালদের’ দ্বারা জনগণ যেন ‘প্রতারিত’ না হয়, সেই বিষয়ে সতর্ক করেছিলেন। আরও শক্তিশালী মনিটরিং ব্যবস্থায় জোর দিয়েছিলেন। কিন্তু কোনো বড় পরিবর্তন দেখা যায়নি। একটি সাম্প্রতিক সমীক্ষার তথ্য বেশ উদ্বেগজনক। সমীক্ষা অনুযায়ী, প্রতিবছর ২৭০৬ কোটি টাকা ব্যয় করেও মানুষ বিদেশে যেতে ব্যর্থ হন। কারণ, তাঁরা দালালদের দ্বারা প্রতারিত হন। এটা বিদেশগামীদের শতকরা ১৯ ভাগ। আর বিদেশে গিয়ে হয়রানির শিকার হন আরও ৩৪ ভাগ। পঞ্চমত, ২০১১ সালে পাস হওয়া জাতীয় দক্ষতা নীতিমালা বাস্তবায়ন এবং ২০১৮ সালে সংসদে পাস হওয়া জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কার্যক্রমকে গতিশীল করার কাজ ঢিমেতালে চলছে।

জনশক্তি খাতের উল্লিখিত মলিন চিত্র বদলাতে হলে সনাতনি পদ্ধতিতে যেভাবে এতকাল এই খাত চলে আসছে, সেটা আর চলবে না। আমরা মুখ গুঁজে পড়ে থাকলে জনশক্তি রপ্তানি খাতের অন্যান্য কুশলীবেরা আমাদের পাশ কাটিয়ে যাবে। তিনটি বৃহত্তম শ্রমবাজারের মধ্যে দুটির অচলাবস্থাকে মনে রেখে ‘আসন্ন ঝড়’ সামলানোর আগাম প্রস্তুতি নিতে হবে।

জনশক্তি আমদানিকারী দেশগুলোর চাহিদা ও পরিবর্তনের সঙ্গে আমাদের জনশক্তিকে খাপ খাইয়ে নিতে হবে। বিশেষজ্ঞরা প্রধানত ঐতিহ্যগত শ্রমবাজারগুলোর পরিবর্তন ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সংকোচনের বিষয়টি মনে রেখে এই খাত পুনরুজ্জীবনের সার্বক্ষণিক তদারকিসাপেক্ষ একটি বৃহত্তর কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের ওপর জোর দিয়ে আসছেন। সরকারি নীতিনির্ধারক মহলের প্রকাশ্য মন্তব্য পর্যালোচনায় পরিষ্কার যে, তারা এই খাতের সমস্যা, সংকট ও সম্ভাবনা সম্পর্কে বেশ ভালোই ওয়াকিবহাল আছেন। কিন্তু পদক্ষেপগুলো নিচ্ছেন নামকাওয়াস্তে। এই ধারাটাই বন্ধ করতে হবে।