আঙ্কেল সির স্বর্ণযুগ শেষ হচ্ছে?

রয়টার্স ফাইল ছবি।
রয়টার্স ফাইল ছবি।

বাস্তব ও ভবিষ্যতের মাঝখানে একটা ধূসর এলাকা থাকেই বরাবর। চীনের কথাই ধরা যাক। ২০২০ ও ২০২১ হওয়ার কথা দেশটির ইতিহাসের স্বর্ণালি বছর। পরিকল্পনা ছিল এ বছর ১৪০ কোটি মানুষের দেশ চীন থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে দারিদ্র্য বিদায়ের ঘোষণা দেওয়া হবে। পরের বছর হবে দেশটির শাসক দল কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিসি) প্রতিষ্ঠার ১০০ বছর পূর্তি উত্সব। আর ২০২২ হওয়ার কথা দলের নেতা হিসেবে সি চিন পিংয়ের ১০ বছর পূর্তি। করোনাভাইরাস আসন্ন এই তিন উৎসবের একটাকে অসম্ভব করে ফেলেছে; বাকি দুটিকে ফেলেছে হুমকিতে।

করোনা শনাক্ত হওয়ার পর থেকে প্রতিদিন আমূল বদলে যাচ্ছে চীন। মৃতের সংখ্যা দেড় হাজার ছাড়িয়ে গেছে। আক্রান্তের সংখ্যাও ৫০ হাজার ছাড়িয়েছে। সব সংখ্যাই ক্রমে বাড়ছে। চীনকে নিয়ে মুশকিলে পড়েছে বিশ্ব। ৩০-৪০ দিন আগেও চিত্রটি ছিল উল্টো।

বিশ্বের কর্তৃত্ববাদী শাসকদের অন্যতম মডেল দেশ চীন। উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের মধ্যে একটাকে বেছে নেওয়ার জন্য চীনকে দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরা হতো। ছোট ছোট ‘আঙ্কেল সি’ হওয়ার বাসনা ছিল বিশ্বজুড়ে অনেকের। সেসব শাসকও চীনের সঙ্গে দেশের যোগাযোগ বন্ধ করতে কালবিলম্ব করছেন না এ মুহূর্তে।

বিশেষজ্ঞদের সর্বশেষ অনুমান, করোনার বিস্তার হয়তো কল্পনার পরিসর ছাড়াতে চলেছে। ২৫টি দেশে ইতিমধ্যে এর উপস্থিতি শনাক্ত হয়ে গেছে। সুদূর ইসরায়েলেও ৯ বছর বয়সী করোনাবাহিত একজন রোগী আছে এখন। স্পষ্ট যে এটা আর স্বাস্থ্য–দুর্যোগ আকারে নেই এখন। কীভাবে এটা ছড়িয়েছে, সেই আলাপেও আগ্রহ কমে গেছে সবার। এর যে বিধ্বংসী ও অচিন্তনীয় ফল দেখা যেতে পারে, সেটাই বরং বর্তমানে মনোযোগ পাচ্ছে বেশি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা চীনকে বৈশ্বিক জনরোষ থেকে রেহাই দিতে ভাইরাসটির নাম দিয়েছে ‘সিওবিআইডি-১৯’। অর্থাৎ ভাইরাসটির গায়ে আর চীনের গন্ধ থাকছে না। কিন্তু ইতিমধ্যে চীন বিশ্বে প্রায় একঘরে হয়ে পড়ছে। প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংও জনসমক্ষে আসা কমিয়ে দিয়েছেন। সিপিসির ৭০ বছরের শক্ত মেরুদণ্ডে ক্ষীণ এক আতঙ্কবোধ বইতে শুরু করেছে। যে পার্টি এত দিন কেবল ২০৪৯-এ চীনের বিপ্লবের শত বছর পূর্তির আয়োজন নিয়ে ভাবছিল, তারা এখন কেবল আগামী মাসগুলো নিয়ে ভাবতে বসেছে। ভাইরাসটি এত দিনকার স্থিতিশীল চীনে রাজনৈতিক ভূকম্প তৈরি করতে চলেছে কি না, সেই শঙ্কা ভাবাচ্ছে অনেককে।

চীনের চলতি বিপর্যয়ে ইউরোপ-আমেরিকার প্রাথমিক গোপন উচ্ছ্বাসও উবে গেছে ইতিমধ্যে। কারণ, গোটা বিশ্ব অর্থনীতি নিয়ে টান দিয়েছে করোনা।

উহানেই আক্রান্ত হতে পারে পাঁচ লাখ

বিশ্বে চীনের প্রধান শক্তির জায়গা ব্যবসা-বাণিজ্য। করোনা আঘাত হেনেছে সেখানেই। চীনের ব্যবসা-বাণিজ্যে এখন দমবন্ধ অবস্থা। কয়েক ডজন শহরে নাগরিকেরা কোয়ারেন্টাইন বা ‘সংগনিরোধ’ ব্যবস্থায় বন্দী। আন্তপ্রদেশ চলাচল বেশ নিয়ন্ত্রিত। জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে নতুন বছরের শুরুর দীর্ঘ ছুটি শেষে শিল্পকলকারখানা খুলছে। তবে আতঙ্ক নিয়ে। কর্মীদের উপস্থিতি স্বাভাবিক নয়। দেশটির আমদানি-রপ্তানি দুটিই নৈরাজ্যের শিকার। সামনে অনিশ্চয়তা। নতুন বছরের উত্সব করোনার কারণে উদ্‌যাপনই করা গেল না এবার। এটা চীনে বড় আকারে খরচপাতির সময়। শতকোটির অধিক মানুষের চীনে নববর্ষ ইউরোপের বড়দিনের উত্সবের মতো। দৈনিকগুলো বলছে, করোনার কারণে ব্যবসায়ীদের ৭৩ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্যিক ক্ষতি হলো। ভ্রমণ থেকে বিনোদন, কোনো খাত উত্সব থেকে ব্যবসা করতে পারেনি। পরিবহন খাত আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৫৫ ভাগ কম যাত্রী পেয়েছে।

করোনা যেখান থেকে ছড়িয়েছে, সেই উহান চীনের শিক্ষা ও বিজ্ঞানচর্চার তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। ৮৩টি বড় বড় কারিগরি প্রতিষ্ঠান রয়েছে এখানে। শহরটির অবস্থা আপাতত মৃত্যুপুরীতুল্য। এর চারপাশের শহরগুলোও সংগনিরোধে স্তব্ধ। এ অস্বাভাবিকতা কাটতে বহুদিন লাগবে। লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিনের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা গাণিতিক মডেল করে বলছেন, সংক্রমণ কমে আসার আগে চূড়ান্ত পর্যায়ে যাওয়ার একটা মুহূর্ত থাকে। উহানে সেটা আসেনি। তার আগে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা হয়তো পাঁচ লাখ ছাড়াবে। প্রতি ২০ জনে একজনের বেশি আক্রান্ত হলে এ সংখ্যা আরও বাড়বে। এ মুহূর্তে সবচেয়ে ক্ষতির মুখে পড়েছে দেশটির পর্যটন খাত। বাইরের দেশের নাগরিকেরা অতি জরুরি না হলে চীন যাচ্ছে না। হোটেল-রেস্টুরেন্টের তাই বিপন্ন দশা।

গত বছর চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ শতাংশের মতো, যা গত তিন দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন। এ বছর এটা আরও কমে যাবে। এখন কল্পনা করাও কঠিন যে ঠিক এক দশক আগে ২০১০-এ চীনের প্রবৃদ্ধি ছিল ১০ শতাংশ।

অসন্তোষ বাড়ছে ‘কমিউনিস্ট পার্টি’র বিরুদ্ধে

পরিস্থিতি সামাল দিতে চীন প্রধানত যে কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছে তা হলো কোটি কোটি মানুষকে প্রায় বন্দী করে ভাইরাস ছড়ানোর হার কমানো। কোথাও কোথাও অনেকখানি নির্মমভাবে কাজটি করতে হচ্ছে। এ অবস্থায় নাগরিকেরা সরকারকে দোষারোপ করবে, সেটা অস্বাভাবিক নয়। সরকার শুরুতে কেন ভাইরাসের বিস্তৃতিকে আমলে নেয়নি, সে জন্য কমিউনিস্ট পার্টির আঞ্চলিক নেতৃত্ব প্রশ্নের মুখে পড়ছে। এর মধ্যেই মারা গেলেন ডাক্তার লি ওয়েনলিয়াং, যিনি প্রথম সাত সহযোগীসহ ভাইরাসের কথা সাহস করে জনসমক্ষে তুলে ধরেছিলেন। পুলিশের হাতে তাঁর অপদস্থ হওয়া এবং পরে তাঁর রহস্যময় মৃত্যু নিয়ে সেন্সরশিপ এড়িয়ে চীনজুড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্ষোভের স্পষ্ট আভাস মিলেছে। এর মধ্যে আবার আরেক সাংবাদিকও নিখোঁজ হয়েছেন। ভাইরাস নিয়ে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের গাফিলতি নিয়ে লিখেছিলেন তিনি। এসব ঘটনা প্রমাণ করছে, পরিস্থিতির সবকিছু সিপিসির নিয়ন্ত্রণে থাকছে না। নিয়ন্ত্রণহীনতার এই দায়ভার ও ক্ষোভের ঢেউ ক্রমে প্রদেশ থেকে কেন্দ্রমুখী। দেশটির প্রশাসনও সে রকম, অতিকেন্দ্রীভূত।

ভাইরাসের বিস্তৃতি ঠেকাতে সরকার ক্রমে নতুন নতুন এলাকায় মানুষ চলাচলে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করছে। যাকে বলা হচ্ছে ‘সংগনিরোধ’ কর্মসূচি। করোনার উত্সভূমি হুবেই প্রদেশে কেবল পাঁচ-ছয় কোটি মানুষ গত এক মাস এভাবে গৃহবন্দী অবস্থায় আছে। ১ মার্চ পর্যন্ত সেখানে স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকছে। প্রতি বাড়িতে ‘কার্পেট স্ক্রিনিং’ চলছে। কিন্তু ভাইরাস হুবেই ছেড়ে ক্রমে দূরে দূরে ছড়াচ্ছে।

এ রকম অবস্থা যত দীর্ঘায়িত হবে এবং সংগনিরোধ কর্মসূচির পরিসর যত বাড়বে, ততই মানুষের অসন্তোষও বাড়বে। হংকংয়ের চীন–বৈরিতার বিষয় সামলাতে না পারার বিষয়টিও এখন করোনা ব্যর্থতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সিপিসির বিরুদ্ধে। করোনা অধ্যায়ের পর এটাও স্পষ্ট, তাইওয়ানোর সঙ্গে একীভূত হওয়ার বিষয়ও আপাতত আর হচ্ছে না।

আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলো দোকান গোটাচ্ছে

দীর্ঘদিন থেকে চীন যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে বাণিজ্যযুদ্ধের মুখোমুখি ছিল। করোনা সেই যুদ্ধে ভারসাম্য নষ্ট করে দিয়েছে আমূল। প্রবৃদ্ধি কমাচ্ছিল বাণিজ্যযুদ্ধ। আর করোনা চীনের পেশি অনেকখানি শিথিল করে দিয়েছে। রাশিয়ার মতো বন্ধুও সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপ করেছে। চীনের মানুষ ও চীনের পণ্য উভয়ই অনেক দেশে আগমন-নির্গমনে বাধায় পড়ছে। প্রবাসী চীনাভাষীরা অনেক দেশে সামাজিকভাবে একঘরে অবস্থায় পড়ছে। কোনো কোনো দেশে তারা স্বপ্রণোদিত হয়ে সংগনিরোধ ব্যবস্থায় থাকছে, সামাজিক দূরত্ব এড়াতে। অন্যান্য দেশ চীনের নাগরিকদের স্বাগত জানাতে অনাগ্রহী আপাতত।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অবশ্য ভাইরাস মোকাবিলায় চীনের পদক্ষেপে সন্তুষ্ট। কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া রক্ষণশীল। সবাই নিজ দেশে এর সংক্রমণ থামাতে মরিয়া। জাপান প্রায় চার হাজার যাত্রী থাকা এক প্রমোদতরিকে টোকিও উপকূলে সাগরেই আটকে রেখেছে। যেখানে ১৩৫ জন ভাইরাসে সংক্রমিত।

অন্য সব দেশের চেয়ে হংকংয়ের সিদ্ধান্তটি চীনের জন্য বিশেষ বেদনাময়। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়েছে, চীন থেকে কেউ এলেই ১৪ দিন বাধ্যতামূলক নজরদারিতে থাকতে হবে। চিকিৎসকেরা চীনের সঙ্গে সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়ার দাবিতে ধর্মঘট করেছেন। চীন হংকংকে তাদের মালিকানার ভূমি মনে করে। সেখানকার এ রকম খবর চীনের মূল ভূখণ্ডের মানুষদের জন্য কেবল পেশাগত সমস্যাই নয়, অপমানকরও। যদিও এরই মধ্যে হংকংয়ে ২১ জন আক্রান্ত হয়ে গেছে। চীনের ওপর বহুভাবে নির্ভরশীল উত্তর কোরিয়াও সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে। চীন ছাড়া কীভাবে এই দেশ বাঁচবে, সেটাও আরেক অনুসন্ধানের বিষয় হয়ে থাকছে। তার রপ্তানির ৯১ ভাগই হতো চীনে।

আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলো ইতিমধ্যে চীনের বহু শহরে তাদের দোকানপাট ও কার্যালয় আপাতত বন্ধ করে নিয়েছে। আফ্রিকা ও এশিয়ার যেসব দেশের চীনের যৌথ বিনিয়োগ রয়েছে, সেগুলোর গতি কমে আসতে শুরু করায় ওই সব দেশও বিপত্তিতে পড়েছে। এই বিপত্তি কেবল প্রকল্পের সময় নিয়ে নয়, চীনের কর্মীদের দ্বারা রোগ ছড়ানোর হাত থেকে বাঁচতেও।

বাংলাদেশের বিকল্প আমদানির উত্স কী?

কয়েক দশক ধরে চীন আন্তর্জাতিক পুঁজিতন্ত্রের প্রধান এক ভরকেন্দ্র। ১৪ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি তার। বৈশ্বিক জিডিপিতে চীনের হিস্যা প্রায় ১৭ ভাগ। বলা হচ্ছে চীনের প্রবৃদ্ধি এক ভাগ কমলে, বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি কমবে দশমিক দুই ভাগ। করোনা তাই আঘাত হেনেছে কেবল চীনে নয়, বিশ্ব অর্থনীতিতে। এই প্রথম সবাই দেখছে আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে চীনের অংশীদারত্ব কত গভীর।

আতঙ্ক এখন দ্বিমুখী। একদিকে চীনের খুচরা যন্ত্রাংশের ওপর নির্ভরতা রয়েছে প্রায় সব দেশের রপ্তানিমুখী শিল্পের। বৈশ্বিক পণ্য উত্পাদন ও বিপণনের ‘সাপ্লাই চেইনে’ চীন রয়েছে কেন্দ্রে। আবার সবচেয়ে বেশি মানুষের দেশে রয়েছে বিশ্বের সব বড় বড় কোম্পানির ফ্যাক্টরি থেকে দোকান পর্যন্ত নানান ব্যবসা। যুক্তরাষ্ট্রের কফি বিক্রেতা স্টারবাকেরই কেবল চীনে চার হাজার বিক্রয়কেন্দ্র আছে। তার দুই হাজার করোনার প্রথম ধাক্কাতেই বন্ধ হয়ে গেছে। অ্যাপলের পুরো ব্যবসার অন্তত এক–চতুর্থাংশ চীনের সঙ্গে যুক্ত। কফি থেকে কম্পিউটার—সবাই এভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। সংবাদপত্রগুলোতে বড় খবর হচ্ছে কেবল প্রধান প্রধান খাতের কথা।

যেমন, বৈশ্বিক ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে চীনের যন্ত্রাংশের চালান ঠিকমতো না পাওয়ার শঙ্কায় এখন তুমুল হট্টগোল চলছে। সবচেয়ে বড় ক্ষতি হতে পারে গাড়ি নির্মাণ খাতের। কেবল এই খাতের বিশ্বকে ৩৫ বিলিয়ন ডলার মূল্যের যন্ত্রাংশ সরবরাহ করে চীন। যার মধ্যে ২০ বিলিয়ন ডলারের সামগ্রী যেত যুক্তরাষ্ট্রে। বিষয়টি এখানে এমন যে প্রতি ১০০টি যন্ত্রাংশের ১টিও যদি সময়মতো না মেলে, তাহলে কাজ থেমে যাবে। চীনের যেকোনো একটি যন্ত্রাংশ উত্পাদক কারখানা যদি ঠিকঠাকমতো সবকিছু সরবরাহ না করতে পারে, তাহলে অনেক বড় বড় কোম্পানির জন্য তা বড় ক্ষতির কারণ হবে।

ইতিমধ্যে বিভিন্ন দেশের গাড়িশিল্পে করোনার ধাক্কা লেগেছে। হুন্দাই থেকে ভক্সওয়াগন পর্যন্ত সবাই যন্ত্রাংশের বিকল্প উত্স খুঁজছে। অটো খাত মনে করছে, চীন কারখানা সচল রাখলেও তার এত দিনকার জনবলে ছন্দপতন ঘটবেই। আবার তাদের এত দিনকার উত্পাদন সামর্থ্য এত বিপুল ছিল যে এর বিকল্প উত্স পাওয়া কঠিন।

অটো সেক্টরের মতোই বহু খাতে চীনের ভাইরাস আঘাত হেনেছে। সমুদ্র পরিবহন কোম্পানিগুলো ইতিমধ্যে কনটেইনার কমে যাওয়ার কথা জানিয়েছে।

এর মধ্যে কেবল পর্যটনের উদাহরণ দিয়ে টুইটারে একজন গবেষক জানিয়েছেন, গত বছরের প্রথম তিন মাসে চীন থেকে ভ্রমণে বেরিয়েছিল প্রায় ১৭ কোটি মানুষ। বিশ্বের যেকোনো দেশের চেয়ে এটা বেশি। নিশ্চিতভাবেই ২০২০-এর প্রথম প্রান্তিকে সে রকম হবে না।

বিশ্বের বহু বিশ্ববিদ্যালয়ের চীনা শিক্ষার্থীরা নতুন বছরের ছুটিতে গিয়ে আপাতত আর না ফেরার কথা জানাচ্ছে। অন্যদিকে চীন থেকে অন্য দেশের ছাত্রছাত্রীরাও ফিরতে মরিয়া। যার মধ্যে কেবল উহানে আছে বাংলাদেশের প্রায় ৫০০ জন।

করোনার কারণে বাংলাদেশের ক্ষয়ক্ষতিও হতে পারে বহুমুখী। প্রতিদিনই নতুন নতুন দুঃসংবাদ আসছে। নেপাল ও ভারত পর্যন্ত রোগী মিললেও এখনো ভাইরাস বয়ে আনা কারও সন্ধান মেলেনি বাংলাদেশে। তবে ভাইরাস না এলেও তার চেয়ে শত গুণ দ্রুততায় চলে আসছে অর্থনৈতিক দুর্যোগের বার্তা।

আদা, রসুন থেকে শুরু করে কয়েক ডজন পণ্যের দাম ইতিমধ্যে রকেট গতিতে বাড়ছে বাংলাদেশের বাজারেও। আমাদের আমদানি বাণিজ্যে চীনের পণ্যের হিস্যা প্রায় ২৮ ভাগ। দুই দেশের মধ্যে গত বছরও ১৪ বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা হয়েছে, যার অনেকখানিই আমদানি। ৪০ ভাগ ক্যাপিটাল মেশিনারি আসে চীন থেকে। পোশাক খাতের উপাদান, কৃষি যন্ত্রপাতি, মোবাইল ফোন থেকে রান্নাঘরের সামগ্রী পর্যন্ত শত শত সামগ্রী আসছে চীন থেকে। ফলে গুরুতর এক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বাংলাদেশের বাজার ব্যবস্থাতে।

রসুন আর আদা কেজিতে অন্তত ২০ টাকা বেড়েছে দুই সপ্তাহের ব্যবধানে। এটা হলো একটা প্রতীকী বার্তা। বাংলাদেশের জন্য এ রকম পণ্যের বিকল্প বাজার ভারত। কিন্তু তারাও ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত।

চীন থেকে শিল্প কাঁচামালের সরবরাহ কমে গেলে রপ্তানি খাতের উত্পাদনও আগামী মাসেই বিপদে পড়তে পারে। কিছু কিছু আমদানি চুক্তি চীন থেকে বাতিলও হচ্ছে এরই মধ্যে। সবচেয়ে বড় ধাক্কা আসতে পারে তৈরি পোশাক খাতে। টেক্সটাইল বাংলাদেশের ৩৪ বিলিয়ন ডলারের শিল্প। এই খাতে করোনার অভিঘাতে বাংলাদেশের করণীয় কী, সেটা জরুরি অবস্থার মতো পর্যালোচনা দাবি করছে। স্থানীয় বড় বড় অবকাঠামোগত প্রকল্পগুলোও চীনের জনবলের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। প্রধান প্রধান এয়ারলাইনস চীনের সঙ্গে যোগাযোগ কমিয়ে দেওয়ায় বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে চীনের সরাসরি যোগাযোগও কমে আসছে।

এ রকম সমস্যাগুলো অবশ্য বাংলাদেশের একার নয়। বিশ্ব জনসংখ্যার পাঁচ ভাগের এক ভাগই চীনে। ফলে চীনের বিচ্ছিন্নতা পুরো বিশ্বের জন্য ভয়াবহ এক অঙ্গহানির মতো। পুরো বিশ্বের সামাজিক মনোযোগ এখন চীনের দিকে। আরও স্পষ্ট করে বললে আঙ্কেল সির দিকে।

চূড়ান্ত বিপদে আছেন পরাক্রমশালী সি চিন পিং। ফোর্বস ম্যাগাজিন ২০০৯ থেকে এ পর্যন্ত নয় দফা বিশ্বের শক্তিশালী ব্যক্তিদের যে তালিকা প্রকাশ করছে, তাতে আঙ্কেল সি প্রথম ১০–এ ছিলেন ৭ বার। সর্বশেষ তালিকায় ছিলেন সবার ওপরে। কিন্তু এ মুহূর্তে চরম নাটকীয় অবস্থার মুখে তিনি।

শঙ্কা আছে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার

গত এক দশক চীনের মনোজগৎ দখল করে আছে প্রতিপক্ষ যুক্তরাষ্ট্র। সির আট বছরের শাসনামলে দক্ষিণ সাগরে এবং বাণিজ্যযুদ্ধে ওয়াশিংটনকে মোকাবিলাই ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে প্রায় ৬০ দেশজুড়ে বিস্তৃতি চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ কর্মসূচিকে মনে হচ্ছিল মহাকাব্যিক এক অর্থনৈতিক সম্প্রসারণচেষ্টা।

কিন্তু করোনা বিপর্যয়ে সি ও তাঁর সহযোদ্ধারা একদম অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়েছেন। একদলীয় কর্তৃত্ববাদী রাজনৈতিক কাঠামোর কারণে প্রথম দিকে বিষয়টি ধামাচাপার চেষ্টা ছিল। কেবল এ কারণেই পার্টি ও সরকার করোনা প্রতিরোধে পুরো শক্তিতে নামতে গিয়ে মধ্যে এক মাস সময় পার হয়ে যায়। সামাজিক দুর্যোগে বিরোধী দল থাকলে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের যে সুবিধা হয়, চীনে করোনার প্রাথমিক বিস্তৃতি থামাতে না পারা তার সাক্ষী। তবে বিরোধী দল না থাকলেও করোনা নিয়ন্ত্রণ যত বেশি সময় নিচ্ছে, ততই সামাজিক ক্ষোভ প্রকাশ হয়ে পড়ার ঝুঁকি বাড়ছে।

ইতিমধ্যে সি জনসমক্ষে আসা কমিয়ে দিয়েছেন। ২০১২ থেকে তিনি সিপিসির প্রধান। একই বছর হয়েছেন সেন্ট্রাল মিলিটারি কমিশনের প্রধান। পরের বছর থেকে প্রেসিডেন্ট। দেশের ক্ষমতার সবটুকু তাঁর হাতে তুলে দিয়েছে চীন। জীবিত মাওয়ের মতোই ‘চেয়ারম্যান’ সিও ছিলেন এত দিন চীনের শেষ কথা। সাফল্যের পালকের পর পালক যুক্ত হচ্ছিল তাঁর মুকুটে। এখন হঠাৎ অনেকের মনে হচ্ছে তাঁর ব্যর্থতাও অনেক! হংকং, তাইওয়ান প্রশ্ন ছাড়াও বাণিজ্যযুদ্ধ এড়াতে পারেনি তাঁর প্রশাসন। বলা বাহুল্য, অর্থনীতি বেশি বিপর্যস্ত হয়ে পড়লে দলের ভেতর বিরুদ্ধবাদীরা তাঁকে হটিয়ে আরও কঠোর কোনো পদক্ষেপ নিয়ে নিজেদের ৭০ বছরের রাজত্ব ধরে রাখতে চাইবে। তার আগে, এ রকম কর্তৃত্ববাদী শাসনে যা হয়, ‘টিম-সি’ স্থানীয় অনেক নেতাকে আটক ও বিচার করে জনরোষ শীতল করতে চাইবে। হুবেই প্রদেশে সেটা ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। উহানের মেয়র ঝাও জিয়াংওয়াং ইতিমধ্যে বলে দিয়েছেন—মহামারির ঘোষণায় বিলম্ব ঘটে পার্টির ঊর্ধ্বতন নেতারা অনুমতি দিতে দেরি করেছিলেন বলে। কিন্তু ঝাওকেই এখন হয়তো যেতে হবে। যেকোনো আমলাতান্ত্রিক একদলীয় ব্যবস্থায় এমনই হয়।

গত ৭০ বছরের ক্ষমতায় চীনের পার্টি এ নিয়ে তিনবার বড় ধরনের সংকটে পড়ল। মাওয়ের আমলে ১৯৫৯–পরবর্তী দুর্ভিক্ষ, ১৯৮৯-এর তিয়েন আনমেন বিক্ষোভ এবং সর্বশেষ এ ভাইরাস অধ্যায়। প্রথম দুটি ঘটনা ব্যাপক মানবক্ষতির মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছিল। ইতিমধ্যে চীনে ব্যাপক ‘আধুনিকায়ন’ হয়েছে। কিন্তু দেশটি একই ধাঁচের কর্তৃত্ববাদী আমলাতান্ত্রিক নীতিকৌশলের উত্তরাধিকার বহন করছে আজও। সেই ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে পুরোনো দুই বিপর্যয়ের মতোই এবারও চীনকে নিয়ে শঙ্কা হয়।

আমলাতন্ত্রের তরফ থেকে এ মুহূর্তে ভাইরাস সাহসের সঙ্গে মোকাবিলাকারীদের জাতীয় বীর হিসেবে তুলে ধরার আয়োজনও চলছে পরিকল্পিতভাবে। দুই সপ্তাহের কম সময়ে দুটি বড় হাসপাতাল বানানোকে মহাকাব্যিক সাফল্য হিসেবে পুনঃপুন তুলে ধরা হচ্ছে প্রচারমাধ্যমে। বিদ্যমান ‘ব্যবস্থা’কে ক্ষোভের তাপ থেকে দূরে রাখার পুরোনো জাতীয়তাবাদী ফর্মুলা এসব। কিন্তু করোনা-পরবর্তী চীনে মানুষ রাষ্ট্রীয় প্রচারযন্ত্রে আর আস্থা রাখছে না। রোগী সামলাতে গিয়ে শত শত চিকিৎসক ও নার্স যে রোগাক্রান্ত, সে রকম সংবাদ সরকারি সংবাদমাধ্যমে পুরোপুরি নিষিদ্ধ। মানুষের জন্য বোঝাশোনার প্রধান বাহন হয়ে উঠেছে স্থানীয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম উইচ্যাট, উইবো, কিউকিউ ইত্যাদি। ঘরবন্দী মানুষের কাছে এগুলোই এখন নির্ভরতার জায়গা। সরকারও এগুলোতে নজরদারি করেই রাজনৈতিক করণীয় ঠিক করছে।

৩ ফেব্রুয়ারি সি নিজেই বলেছেন, করোনা ‘চীনা ধাঁচের শাসনব্যবস্থা’কে বড় ‘পরীক্ষা’য় ফেলেছে। বক্তব্য থেকে স্পষ্ট, করোনার অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির চেয়েও রাজনৈতিক ব্যবস্থাটি ভেঙে পড়ে কি না, সে পরীক্ষায় উদ্বিগ্ন সি। মুশকিল হলো এই উদ্বেগ ও পরীক্ষার
ফলাফল তাঁকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হবে। যদি দ্রুত মহামারি রোধ করা যায়, তবে একে দেখিয়ে সি আরও দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকবেন। তাঁর ও দলের একতরফা নিয়ন্ত্রণ দেশে আরও বাড়বে তখন। উল্টোটি হলে জন–অসন্তোষের মুখে পার্টি তাঁকে বলি দিয়ে বিশ্ব থেকে চীনকে আরও বিচ্ছিন্ন করবে। পুরো দেশকে কারাগারতুল্য করে টিকে থাকতে চাইতে পারে তারা। সব মিলিয়ে চীনের সামনে আপাতত বৈশ্বিক বিচ্ছিন্নতাই নিয়তি। এর মধ্যে আর যা হতে পারে—দেশজুড়ে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা।

আলতাফ পারভেজ: দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক