ভোরবেলা পার্কে

রয়টার্স প্রতীকী ছবি।
রয়টার্স প্রতীকী ছবি।

সকালে পার্কে হাঁটতে যাই। সাধারণ মানুষ জীবনে দুবার ব্যায়াম বা হাঁটাহাঁটি করে। একবার যৌবনে কাউকে আকৃষ্ট বা মোহিত করার জন্য। আরেকবার পড়ন্ত বেলায় ডাক্তারের পরামর্শে। আমি শেষোক্তদের দলে। গত কদিনে সেখানে দেখা কিছু ছবি, আর শোনা কিছু কথা নিয়েই আজকের এ লেখা।

সম্ভ্রান্ত ভিক্ষুক

ফাল্গুনের ২ তারিখ সকালে পার্কে ঢুকতে যেতে দেখি একজন কমবয়সী কালো নিকাব পরিহিতা রিকশা থেকে নামলেন। হাতে একটা ছোট্ট থলি। এমন কাউকে তো আগে পার্কে হাঁটতে দেখিনি। হাঁটা শেষে ফেরার সময় পার্কের বাইরে দেখলাম তাঁকে আবার। ভিক্ষুকদের কর্নারে বসে আছেন। আমি পাশে যেতেই হাত বাড়িয়ে দিলেন। হাতের মুঠোফোনটা স্মার্টফোন কি না, ঠাওর করতে পারলাম না। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে মানুষ আবার কী বলবে? তাই কেটে পড়ি। মাশ আল্লাহ ভিক্ষাবৃত্তিও এখন সম্ভ্রান্ত পেশা হয়ে উঠেছে!

রাজনীতিবিদেরা যতই বলুন উন্নয়নের জোয়ারে ভিক্ষুক উঠে গেছে, বাস্তবে তা হয়নি। তবে এ পেশার ধরন পাল্টেছে। আমাদের তৈরি পোশাকশিল্প উচ্চ মূল্য সংযোজনকারী পণ্য রপ্তানি করতে না পারলেও ভিক্ষুকেরা তা পেরেছে। তারা তাদের পেশাকে উচ্চ মূল্য সংযোজনকারী পর্যায়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। কারণ, ভিক্ষুকদেরও তো জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে!

প্রথম আলোর লেখা

মাঘের শেষ দিন পার্কে জাকিয়া আপার সঙ্গে দেখা। বাংলাদেশের প্রথম নারী সচিব। প্রধানমন্ত্রীর সচিব ছিলেন ১৯৯৮-২০০০ সালে। অনুযোগ করলেন কবির, তোমাকে তো পাই না। প্রথম আলোয় তোমার লেখাটা খুব ভালো লেগেছে। বিস্তারিত বললেন। কী কী ভালো লেগেছে। ওহ, কেউ কেউ তাহলে পত্রিকার উপসম্পাদকীয়ও পড়েন! তবে আমি এটা নিশ্চিত, যাঁদের পড়া দরকার, তাঁরা কেউ পড়েন না। ধন্যবাদ জাকিয়া আপা।

বিদায় শীত, স্বাগত বসন্ত

গত শনিবার প্রথম শীতবস্ত্র ছাড়াই সকালে পার্কে হাঁটতে গেলাম। ভাবলাম ঋতুরাজ বসন্তকে আর বিলম্বিত করা ঠিক হবে না। পার্কে অন্য অনেকেই শীতের কাপড় পরে এসেছেন। দুই চক্কর দেওয়ার পর দেখি তাঁরা শীতবস্ত্র কোমরে বেঁধেছেন। মাথার টুপি হাতে নিয়েছেন। নিজের পিঠ নিজেরই চাপড়াতে ইচ্ছা করছে! ওয়েল ডান বয়!

সেদিন পার্কের এম্পিথিয়েটারে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখলাম। একজন নারী প্রকাশ্যে একজন শায়িত পুরুষের (অনুমান করি স্বামী) পায়ের পাতা চেপে ধরে আছেন। আর পুরুষটি শোয়া থেকে বারবার উঠছেন–নামছেন। দূর থেকে প্রথমে ভাবলাম নারীটি বোধ হয় কোনো কিছুর জন্য ক্ষমা চাইছেন। কাছে এসে বুঝলাম, ভদ্রলোক ব্যায়াম করছেন। বোধ করি মধ্যপ্রদেশের স্ফীতি হ্রাসের জন্য এ প্রচেষ্টা। দম্পতির মিল দেখে ভালো লাগল।

বাচ্চাদের স্কুলে যাওয়া

আজ বন্ধু শাহজালাল (বাংলাদেশ ব্যাংকে আমার সাবেক সহকর্মী) হাঁটতে হাঁটতে তাঁর স্মার্টফোনে সদ্য তোলা দুটি ছবি দেখাল। প্রথমটিতে, স্কুলের পোশাক পরিহিত আট-দশজন ছেলেমেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ রিকশাভ্যানে ঠাসাঠাসি করে যাচ্ছে। দ্বিতীয় ছবিতে বিলাসবহুল শীতাতপনিয়ন্ত্রিত মিনিবাসে একই বয়সের বেশ কয়েকটি ছেলেমেয়ে বাহারি পোশাক পরে স্কুলে যাচ্ছে। শাহজালাল আমার কাছে এর ব্যাখ্যা জানতে চায়। আমি কোনো জবাব দিতে পারিনি।

কারণ, চরম আয় ও সম্পদবৈষম্যের দেশ যুক্তরাষ্ট্রেও দেখেছি স্কুলের হলুদ বাস কয়েক মিলিয়ন ডলার বাড়ির সামনে থেকে ছেলেমেয়েদের ওঠাচ্ছে, আবার পরক্ষণেই দরিদ্রদের জন্য হাউজিং এস্টেট থেকে ছেলেমেয়েদের ওঠাচ্ছে। শিশু বয়সেই কি ধনী, মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র শিশুদের আলাদা করতে হবে? আর যারা স্কুলে যাওয়ার সুযোগই পায় না, তাদের কথা না–ই বা বললাম। সব নাগরিকের সমান সুযোগ গড়ে তোলার জন্য সরকার কি স্কুলবাস চালুর উদ্যোগ নিতে পারে না?

জি হুজুরের জমানা

চার–পাঁচজন প্রবীণ আজ বেশ চড়া গলায় কথা বলছিলেন, আবেগ ও ক্ষোভমিশ্রিত স্বরে। আলোচ্য বিষয় ডাকঘর সঞ্চয় স্কিমের মুনাফা ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ থেকে কমিয়ে ফেব্রুয়ারি থেকে ৬ শতাংশ হবে। খোদ বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে মুদ্রাস্ফীতির হার ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। যদিও প্রকৃত মুদ্রাস্ফীতি আরও বেশি বলে অনেকেই মনে করেন। তারপর আরও আছে অগ্রিম আয়কর, ব্যাংকের নানা নামের চার্জ। সুদের হার যদি ৬ শতাংশ হয়, তাহলে প্রকৃত সুদ বা মুনাফার হার কত হবে? একজন ক্ষুব্ধভাবে অভিযোগ করলেন, ইউএনওদের প্রায় কোটি টাকার গাড়ি দেওয়া হবে। আগে পুলিশ ও অন্য সরকারি কর্মকর্তাদের দেওয়া হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে এভাবে খেপিয়ে তোলা কি ঠিক হচ্ছে?

অবসরভোগীদের অভিযোগ যথার্থ। অবসরকালে কেবল সঞ্চয়ই ভরসা। সরকারের ব্যয় সংকোচন করতে হবে, ব্যবসায়ীদের কম সুদে ঋণ দিতে হবে। ভালো কথা। এ জন্য তো সরকারের বিপুল অপব্যয় কমালেই হয়! খেলাপি ঋণ ও ব্যাংকে পরিচালন ব্যয় কমাতে পারলে সুদের হার আপনা–আপনিই নেমে আসবে। তা না করে অবসরভোগীদের জীবন দুর্বিষহ করতে হবে কেন? তাঁরা অসহায় বলে? তাঁরা রাস্তায় নামবেন না বলে?

উন্নয়ন অর্থনীতির ক্লাসে প্রথমেই জেনেছি সঞ্চয় ও বিনিয়োগের সঙ্গে প্রবৃদ্ধির সম্পর্কের কথা। আরও জেনেছি সঞ্চয়ের হার নির্ভর করে প্রকৃত সুদের হারের ওপর। প্রকৃত সুদের হার শূন্য বা ঋণাত্মক হয়, তাহলে মানুষ কেন সঞ্চয় করবে? সঞ্চয় কম হলে বিনিয়োগ ও ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধিরই বা কী হবে?

আগে মন্ত্রীদের দেখেছি যেকোনো আর্থিক প্রস্তাবের দরিদ্র ও মধ্যবিত্তের ওপর প্রভাব নিয়ে ভাবতে এবং সচিবদের তাত্ত্বিক জগৎ থেকে বাস্তবের জগতে ফেরাতে। আবার সচিবদেরও দেখেছি মন্ত্রীদের অবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত থেকে নিবৃত্ত করতে। এখন সেই অবস্থা নেই। এখন জি হুজুরের জমানা। সরকারের ক্ষমতা এখন নিরঙ্কুশ। বিরোধী দল এখন আর সাধারণ মানুষের সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামায় না। তাই সামনে এখন কঠিন সময়।

করোনাভাইরাস

পার্কে বেশ কয়েকজন টেক্সটাইল ও গার্মেন্টস শিল্পমালিক হাঁটতে আসেন। সাধারণত তাঁরা ফুরফুরে মেজাজে থাকেন। সেদিন দেখলাম, তাঁদের কথাবার্তায়ও উদ্বেগ ও উত্কণ্ঠার সুর। একজন বললেন, চীনে করোনাভাইরাসের প্রকোপ শিগগির বন্ধ না হলে তাঁদের কারখানা বন্ধ করতে হবে। অন্য একজন কেন জানতে চাইলে, তিনি ব্যাখ্যা করলেন, তাঁদের শিল্পের কাঁচামাল কাপড়, কেমিক্যালস, রং প্রায় সবই আসে গণচীন থেকে। এখন তা পুরোপুরি বন্ধ। একই সঙ্গে হাঁটতে থাকা একজন ব্যাংকার বললেন, এর প্রভাব পড়বে ব্যাংকিং খাতে। ঋণখেলাপি আরও বাড়বে। চীন ও সারা বিশ্ব দ্রুত করোনাভাইরাসের প্রভাবমুক্ত হোক—এ মুহূর্তে এটাই চাওয়া।

বার্ডস অব প্যারাডাইস

অনেক হতাশার কথা হলো। এবার একটু ফুলের কথা বলে শেষ করি। সেদিন ফেরার পথে একটা বাড়ির সামনে সারবাঁধা ‘বার্ডস অব প্যারাডাইস’ ফুলের ছবি দেখলাম। বড় বড় সবুজ পাতার মধ্যে উড়ন্ত পাখির মতো হলুদ ফুল। এ ফুলগুলো আমার মেয়ে ও তাঁর স্বামীর অনেক প্রিয়। নিজেদের বিয়ের কার্ডে তারা এ ফুলের ছবি ব্যবহার করেছিল।

সবাইকে বসন্তের বিলম্বিত শুভেচ্ছা!

মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান: সাবেক সচিব