শহীদ জোহা দিবস শিক্ষক দিবস হোক

ড. মুহম্মদ শামসুজ্জোহা। ফাইল ছবি
ড. মুহম্মদ শামসুজ্জোহা। ফাইল ছবি

১৮ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের ইতিহাসের সেই দিন, যেদিন এক মহান বাঙালি শিক্ষক বলেছিলেন, ‘ছাত্রদের গায়ে গুলি লাগার আগে সেই গুলি আমার বুকে লাগবে।’ ১৮ ফেব্রুয়ারি আমাদের ইতিহাসে সেই দিন, যেদিন ছাত্রছাত্রীদের জীবন বাঁচানোর জন্য শহীদ হওয়া এক যুবক শিক্ষকের রক্তে রক্তিম হয়েছিল মতিহারের সবুজ ঘাস। ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৯ সালের ভেতর প্রথম শহীদ হওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. সৈয়দ মোহাম্মদ শামসুজ্জোহা (মে ১, ১৯৩৪-ফেব্রুয়ারি ১৮, ১৯৬৯) নামের সেই মহৎপ্রাণ শিক্ষককে কি মনে রেখেছে বাংলাদেশ? দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, এই শিক্ষকের আত্মত্যাগের কথা ভুলতে বসেছে আগামী প্রজন্ম। অথচ তাঁর আত্মত্যাগের ইতিহাস জানার কথা ছিল সমগ্র বাংলাদেশের।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে আনা ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার’ বিরুদ্ধে বাংলার জনতা দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। উনসত্তরের সেই অগ্নিঝরা দিনগুলোতে বাঙালি নিজেদের উৎসর্গ করার দীক্ষা নিচ্ছিল। উত্তাল বিক্ষোভের মধ্যে ২০ জানুয়ারি পাকিস্তানি পুলিশের গুলিতে শহীদ হন ছাত্র ইউনিয়ন নেতা আমানুল্লাহ মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান, যিনি শহীদ আসাদ নামেই সমধিক পরিচিত। এরপর উনসত্তরের ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা সেনানিবাসে হত্যা করা হয় সার্জেন্ট জহুরুল হককে। এই দুই হত্যাকাণ্ড বাংলার মানুষকে ক্ষিপ্ত করে তুলেছিল। সার্জেন্ট জহুরুল হক হত্যার প্রতিবাদে ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শত শত শিক্ষার্থী ১৪৪ ধারা ভেঙে মিছিল নিয়ে ক্যাম্পাস থেকে রাজশাহী শহরে যাওয়ার চেষ্টা করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজলা গেটে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সে মিছিল আটকে দেয় এবং সরিয়ে দেওয়ার প্রস্তুতি নেয়। এ সময় ড. জোহা নিজের প্রক্টর পরিচয় দিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সেখান থেকে সরে যেতে বলেন। পাকিস্তানি সেনাসদস্যরা তাঁর দাবি মানতে অস্বীকার করলে তাদের সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে পড়েন তিনি। বাগ্‌বিতণ্ডার একপর্যায়ে শিক্ষার্থীদের সামনেই পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে গুলি করে। গুলি করেই ক্ষান্ত হয়নি পাকিস্তানি বাহিনী, বেয়োনেট দিয়ে নৃশংসভাবে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা নিশ্চিত করা হয় তাঁর। ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সেই প্রথম কোনো বিশ্ববিদ্যালয়শিক্ষক বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের শিকার হলেন।

শহীদ ড. শামসুজ্জোহার মৃত্যুর ৩৯ বছর পর ২০০৮ সালে তাঁকে স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করা হয় এবং তাঁর নামে একটি স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করা হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার দীর্ঘদিন থেকে আবেদন জানিয়ে আসছে তাঁকে মরণোত্তর একুশে পদক দেওয়ার জন্য। ১৮ ফেব্রুয়ারি ড. সৈয়দ মোহাম্মদ শামসুজ্জোহার শহীদ হওয়ার দিনটিকে শিক্ষক দিবস ঘোষণা করার জন্য দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, শিক্ষার্থী এবং কর্মকর্তা- কর্মচারীরা। সেই আন্দোলনের মিছিলে তিন বছর ধরে যুক্ত হয়েছে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু এ দাবি পূরণ হয়নি আজও।

ইউনেসকো ১৯৯৪ সাল থেকে ৫ অক্টোবর তারিখটিকে ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস’ হিসেবে পালন করছে শিক্ষকদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে। এর বাইরেও বিশ্বের প্রায় ১০০টি দেশ স্বতন্ত্র শিক্ষক দিবস পালন করে থাকে। ভারত তাদের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি ড. সর্বপল্লি রাধাকৃষ্ণানের জন্মদিন ৫ সেপ্টেম্বরকে সে দেশে শিক্ষক দিবস হিসেবে পালন করে। তিনি পেশায় শিক্ষক ছিলেন। এমনকি নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কাও স্বতন্ত্র শিক্ষক দিবস পালন করে তাদের শিক্ষকদের প্রতি সম্মান দেখিয়ে। অথচ বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে শিক্ষকদের গৌরবজনক ভূমিকা থাকা সত্ত্বেও এ দেশে শিক্ষকদের সম্মান জানানোর কোনো স্বতন্ত্র দিবস নেই। আমরা তাই জোরালো দাবি জানাচ্ছি, বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের প্রথম শহীদ শিক্ষক ড. মুহম্মদ শামসুজ্জোহার মৃত্যুর দিনটিকে অর্থাৎ ১৮ ফেব্রুয়ারি তারিখটিকে শিক্ষক দিবস করা হোক। এর কারণ এই নয় যে তিনি এখনো পর্যন্ত স্বাধীনতা আন্দোলনে শহীদ হওয়া প্রথম শিক্ষক হিসেবে গণ্য। এর কারণ এই যে, ড. শামসুজ্জোহা নিজে স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন, তাঁর শিক্ষার্থীদের প্রভাবিত করেছিলেন স্বাধীনতার পক্ষে কথা বলার জন্য। শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষকে জানানোর চেষ্টা করেছিলেন পাকিস্তানি শাসকদের শোষণের কথা। সচেতন করার চেষ্টা করেছিলেন স্বাধীনতার প্রশ্নে। এবং এই সবকিছু তিনি করেছিলেন ঢাকার বাইরে তাঁর কর্মক্ষেত্রে বসে। এর ফল আমরা পেয়েছিলাম ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে যখন তাঁর ছাত্ররা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন বিভিন্ন সেক্টরে।

একজন মানুষ একা কতটা আগুন জ্বালাতে পারেন একটা আন্দোলনে, শহীদ ড. সৈয়দ মোহাম্মদ শামসুজ্জোহা তার উদাহরণ। অথচ জাতির জন্য আত্মদানকারী এই শিক্ষক এখন বিস্মৃতপ্রায়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েই নিভৃতে স্মরণ করা হয় তাঁর নাম। এই অচলায়তন ভাঙতে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছাত্র হলের নামের বাইরে বের করে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্মরণ করা হোক শহীদ ড. সৈয়দ মোহাম্মদ শামসুজ্জোহার আত্মত্যাগের কাহিনি। ১৮ ফেব্রুয়ারিকে জাতীয় শিক্ষক দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হোক।

তোফাজ্জল লিটন: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র।