ইউএনওদের দামি গাড়ি

সম্প্রতি অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) জন্য ৫০টি পাজেরো গাড়ি কেনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। পত্রিকার খবর অনুযায়ী, ‘পাজেরো স্পোর্টস কিউ এক্স জিপ’ নামের যে গাড়ি ইউএনওদের দেওয়া হচ্ছে, তার প্রতিটির দাম ৯৪ লাখ টাকা। সে হিসাবে ৫০টির দাম পড়বে ৪৭ কোটি টাকা। আর এই গাড়ি কেনা হচ্ছে সরাসরি একটি প্রতিষ্ঠান থেকে; যদিও সরকারি কেনাকাটার নিয়ম অনুযায়ী উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে কেনার কথা।

বৈঠকে উপস্থাপিত প্রস্তাবে বলা হয়, সরকারি যানবাহন অধিদপ্তর ২০০৬-০৭ অর্থবছর থেকে ইউএনওদের সরকারি ও দাপ্তরিক কাজে ব্যবহারের জন্য জিপ বরাদ্দ দিয়ে আসছে। পুরোনো জিপগুলোর আয়ু শেষ হয়ে গেছে। এ কারণে নতুন গাড়ি কেনা জরুরি হয়ে পড়েছে। 

সরকারি কর্মকর্তাদের দাপ্তরিক কাজে প্রয়োজনীয় যানবাহন সরকার সরবরাহ করবে, এ বিষয়ে কারও দ্বিমত থাকার কথা নয়। কিন্তু ইউএনওদের গাড়ির বিষয়ে প্রথম প্রশ্ন হলো, উন্মুক্ত পদ্ধতিতে সেটি না কিনে কেন একটি প্রতিষ্ঠান থেকে সরাসরি কেনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো? মন্ত্রিসভা কমিটি সময়ের অজুহাত দেখিয়েছে। ইউএনওদের গাড়ি কেনার প্রস্তুতি চলছিল অনেক আগে থেকে। দশম সংসদের জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির ২৯তম বৈঠকে ইউএনওদের জন্য জিপ কেনার সুপারিশ করা হয়েছিল। মন্ত্রিসভা কমিটি সিদ্ধান্ত নিতে এত দেরি করল কেন? আগে সিদ্ধান্ত নিলে উন্মুক্ত পদ্ধতিতেই ৪৭ কোটি টাকা দামের এই গাড়িগুলো কেনা যেত।

দ্বিতীয় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো কী দামের গাড়ি কোন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের দেওয়া হবে? ইউএনওদের এখন যে গাড়ি দেওয়া হচ্ছে, সমমানের গাড়ি অতিরিক্ত সচিবেরা পেয়ে থাকেন। চাকরির ক্ষেত্রে ইউএনওরা যেখানে ষষ্ঠ গ্রেডে, সেখানে অতিরিক্ত সচিবেরা দ্বিতীয় গ্রেডভুক্ত। সে ক্ষেত্রে অতিরিক্ত সচিব কিংবা ইউএনওর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আরও বেশি দামের গাড়ি দাবি করবেন। যুক্তি দেওয়া হয়েছে ইউএনওরা জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের সব নির্বাচনে কাজ করেন। তাঁদের নির্বাচন কেন্দ্রে যেতে হয়, ইউনিয়ন পরিষদ, সরকারি-বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, হাটবাজার, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, গ্রামীণ উন্নয়ন প্রকল্প পরিদর্শনে যেতে হয়। একই যুক্তি মাঠপর্যায়ের অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তার বেলায়ও প্রযোজ্য।

ইউএনওদের বিলাসবহুল গাড়ি কেনার পেছনে মনস্তাত্ত্বিক কারণ আছে বলে জানা গেছে। মাঠপর্যায়ের পুলিশের কর্মকর্তারা বিলাসবহুল গাড়ি ব্যবহার করে থাকেন। তাঁদের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে এবার প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের জন্যও বিলাসবহুল গাড়ি কেনার দাবি জানানো হয়েছিল এবং সরকার শেষ পর্যন্ত সেই দাবি মেনেও নিল। অর্থ মন্ত্রণালয়ের চিন্তা ছিল ইউএনওদের জন্য ৫৬ লাখ ৮৭ হাজার টাকা দামের গাড়ি কেনার। কিন্তু জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সে সুপারিশ মানেনি। মন্ত্রিসভা কমিটি ইউএনওদের জন্য ৫০টি গাড়ি কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দেশে ৪৬৪টি উপজেলা আছে। সব উপজেলার ইউএনওদের গাড়ি কিনতে আরও কয়েকটি অর্থবছর লেগে যাবে। 

সরকারি কর্মকর্তাদের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের কারণে যদি তাঁদের জন্য বিলাসবহুল গাড়ি কিনতে সরকারকে অতিরিক্ত অর্থ খরচ করতে হয়, সেটি অত্যন্ত দুঃখজনক। আর সরকার এমন সময়ে সিদ্ধান্তটি নিল, যখন বিশাল অঙ্কের রাজস্ব ঘাটতি আছে। অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় যত বাড়বে, উন্নয়ন খাতে জোগান তত কমবে। বিলাসবহুল গাড়ি কেনার এই বিলাসিতা বন্ধ হওয়া জরুরি।