সন্ধ্যা রাতের শেফালি ও নীতার জীবনযুদ্ধ

দুই নারীর জীবন: ‘মেঘে ঢাকা তারা’–র নীতা ও মিস শেফালি
দুই নারীর জীবন: ‘মেঘে ঢাকা তারা’–র নীতা ও মিস শেফালি

যে দুজন নারী চরিত্রকে নিয়ে এই রচনা, তাঁদের একজন বাস্তব, আরেকজন সিনেমার চরিত্র। দুজনের মধ্যে মিল যেমন আছে, তেমনি অমিলও বিস্তর। একজন মুখে রক্ত তুলে মরে যান এবং মরার আগে আকুতি জানান, ‘দাদা, আমি বাঁচতে চেয়েছিলাম।’ আর আরেকজন জীবনযুদ্ধে মাটি কামড়ে পড়ে থাকেন। যে কলকাতা শহরে একদিন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের বাড়িতে তিনি পরিচারিকার কাজ নিয়েছিলেন, একসময় সেই কলকাতার রাতের জীবনের সম্রাজ্ঞী হয়ে ওঠেন তিনি।

দুজনের মধ্যে মিলের জায়গাটা হলো তাঁরা উভয়েই পূর্ববঙ্গের মেয়ে। দেশভাগের তীব্র-তীক্ষ্ণ কাঁটাতারে বিদ্ধ হয়ে উভয়েই দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। বাস্তব চরিত্রটি হলেন কলকাতার প্রথম বাঙালি ক্যাবারে ড্যান্সার মিস শেফালি, যাঁর প্রকৃত নাম ছিল আরতি দাস। আর সিনেমার চরিত্রটি হলেন ঋত্বিক ঘটকের ‘মেঘে ঢাকা তারা’ চলচ্চিত্রের নীতা। দুটি চরিত্রের একটি অমিল হলো সিনেমার নীতা যেখানে বাস্তবে ১৯৫০/৬০-এর দশকের নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের আদর্শ সংগ্রামী নারীর প্রতিরূপ, সেখানে বাস্তবের শেফালির জীবন বরং অনেক বর্ণিল, সিনেমাটিক।

১৯৭০-এর দশকে মিস শেফালি ওবেরয় গ্র্যান্ডের প্রিন্সেস ডিসকোর স্টার ড্যান্সার। রাতের কলকাতা রীতিমতো সম্মোহিত তাঁর নামে। নাচের ফ্লোরে তাঁর প্রতিটি সুইং ও মুভ পুরুষের হৃদয়ে হিল্লোল তুলত। আর তাঁর অপরূপ দেহবল্লরি কত পুরুষকে পতঙ্গের মতো আকৃষ্ট করেছে, তার ইয়ত্তা নেই। এরপর একসময় থিয়েটারে এলেন, প্রশংসাও পেলেন। সে সময়ের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত থেকে অভিজাত সমাজ তাঁকে গ্রহণ করেছিল সাদরে। তাঁর নাচের ভক্তের তালিকায় কে ছিলেন না, মহানায়ক উত্তমকুমার থেকে শুরু করে মহানায়িকা সুচিত্র সেন, সবাই। সুচিত্রা সেন একবার মিস শেফালির নাচ দেখার জন্য থিয়েটারে চলে গিয়েছিলেন। আর উত্তমকুমার নাকি মদ্যপ অবস্থায় একা একা তাঁর নাচ দেখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বাস্তবে কখনো তাঁর শিল্পীর মর্যাদা জোটেনি। নৃত্যশিল্পীরও নয়। তবে যে জহুরি জহর চেনেন, তিনি ঠিকই চিনেছিলেন শেফালিকে। তিনি আর কেউ নন, স্বয়ং রবীন্দ্রোত্তর সেরা বাঙালি সত্যজিৎ রায়। আরতি দাস ওরফে মিস শেফালির অভিনয় আর নৃত্যদক্ষতার খবর পৌঁছে গিয়েছিল বিশপ লেফ্রয় রোডের রায়বাড়িতেও। শেফালি নিজের আত্মজীবনী ‘সন্ধ্যা রাতের শেফালি’তে বলেছেন, ‘ফোন করে বলেছিলেন “আমি সত্যজিৎ রায় বলছি। আমার নাম হয়তো শুনে থাকবেন।”’ সেখান থেকেই শুরু। তারপর সত্যজিৎ রায়ের ‘‌প্রতিদ্বন্দ্বী’‌ (১৯৭০) এবং ‘‌সীমাবদ্ধ’‌ (১৯৭১) ছবিতে অভিনয় করেছেন শেফালি।

মিস শেফালির মৃত্যুর পর সত্যজিৎ রায়ের ছেলে পরিচালক সন্দীপ রায় আনন্দবাজার ডিজিটালকে বলেন, ‘বাবার কাছেই শুনেছি, ওঁকে দৃশ্যটা একবার বুঝিয়ে দেওয়ার পরে আর দ্বিতীয়বার বলতেই হয়নি। এত প্রাণবন্ত সহজ অভিনয় করেছিলেন তিনি।’ সন্দীপ রায় আরও বলেন, প্রতিদ্বন্দ্বীর পরে তাই আবার ‘সীমাবদ্ধ’-তেও ডাক পড়ে অভিনেত্রী আরতি দাসের। ‘সীমাবদ্ধ’–এর ক্ষেত্রেও খুব স্বচ্ছন্দে ও রকম একটা দৃশ্য করে ফেলেছিলেন তিনি। অভিনেত্রী হিসেবে তাঁকে সম্মান করতেন বাবা। আমাদের বিয়েতেও নিমন্ত্রণ করেছিলেন। পরবর্তীকালে যতবার দেখা হয়েছে, ততবারই তাঁর সহজ–সরল ব্যবহার মুগ্ধ করেছে আমাদের।

অন্যদিকে ‘মেঘে ঢাকা তারা’–র নীতা চরিত্র উদয়াস্ত পরিশ্রম করে সংসার চালায়। বাবার বয়স হয়েছে, বড় ভাই সংগীত চর্চা করে এই আশায় যে একদিন বড় গায়ক হবে সে। পুরো সংসারের ভার তাই নীতার ওপর। একজন প্রেমিকও আছে তার। কিন্তু সেই প্রেমিক নীতার ছোট বোনের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে একসময়। নীতার মাও দেখল, সংসার চালাতে গেলে তো নীতার বিয়ে না হওয়াই ভালো। তাই তিনিও ছোট মেয়ের সঙ্গে নীতার প্রেমিকের বিয়েতে রাজি। সেই থেকে সংকটের শুরু। একসময় নীতা অত্যন্ত অসুস্থ হয়ে পড়ে। তখন তার দাদা গান গেয়ে ভালোই নাম ও টাকা কামিয়ে বাড়ি ফেরে। বোনের এই অবস্থা দেখে হাওয়াবদলের জন্য বোনকে তিনি পাহাড়ে নিয়ে যান। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর রক্ষা হয় না। তাকে আর বাঁচানো যায় না, মারা যাওয়ার আগে নীতার শেষ দুটি বাক্য বাংলা সিনেমায় এখনো অমর হয়ে আছে: ‘‌দাদা, আমি বাঁচতে চেয়েছিলাম.‌.‌.‌দাদা, আমি বাঁচব।’

জীবনে একটিবারের জন্যও আত্মসম্মান বিসর্জন দেননি মিস শেফালি ও নীতা। এটিই তাঁদের মধ্যকার সবচেয়ে বড় মিল। কিন্তু একজন জীবনযুদ্ধে হেরে যান, আর আরেকজন সগৌরবে দেখেন, রাতের কলকাতা তাঁর জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। মিস শেফালির লড়াইটা আরও কঠিন ছিল বলতে হয়। প্রথম বাঙালি মেয়ে হিসেবে হোটেলে স্বল্পবসনা হয়ে নাচা তখন অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং। একদিকে ক্যাবারে নর্তকীরা তখন ছিল সবাই অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান, অন্যদিকে বাঙালি সমাজ ক্যাবারের কথা শুনলেই ছি ছি করত। তার ওপর আবার ছিল শত শত পুরুষের কামুক দৃষ্টি। নিজেই বলেছেন আত্মজীবনীতে, ক্যাবারে ড্যান্সারদের যত খুশি দেখা যেত, কিন্তু ছোঁয়া যেত না।

নাচকে শিল্পের জায়গা থেকেই দেখেছেন মিস শেফালি, যাঁর পিতৃপুরুষের বাড়ি ছিল নারায়ণগঞ্জে। এটি তাঁর পেশাও ছিল বটে। দুটির মর্যাদা রক্ষা করেই তিনি নিজেকে কিংবদন্তি নৃত্যশিল্পীর পর্যায়ে তুলে এনেছেন। অভিনেত্রীও ছিলেন তিনি। ৬ ফেব্রুয়ারি চলে গেলেন তিনি। শ্রদ্ধাঞ্জলি।

প্রতীক বর্ধন: সাংবাদিক