প্রযুক্তি ও মানুষের সহযোগিতার সমন্বয় প্রয়োজন

বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা প্রতিটি নির্বাচনের সময় নিত্যনতুন চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়ে। বিশেষ করে বিগত দুটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছিল একপ্রকারের যুদ্ধ। হালে এ চ্যালেঞ্জ আরও বড় আকার ধারণ করেছে—গুরুত্বপূর্ণ এবং সার্বিকভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে, যার আইনি দায়িত্বও নির্বাচন কমিশনের। এ চ্যালেঞ্জে নতুন নতুন উপাদান ও আঙ্গিক পরিবর্তন ও পরিবর্ধন হয় নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় মাঠের ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে। প্রার্থীর ও রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচন ও প্রচারণাকে নিজের আয়ত্তে আনতে নানা ধরনের কায়দা। কাজেই বাংলাদেশে নির্বাচনী ব্যবস্থাপনায়, বিশেষ করে মাঠপর্যায়ের ব্যবস্থাপনায় প্রতিটি নির্বাচনের পর নির্বাচন কমিশনকে পর্যালোচনা করে পরবর্তী নির্বাচনের সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত হতে হয়।

প্রতিটি নির্বাচনে যেসব চ্যালেঞ্জ নির্বাচন কমিশনকে মোকাবিলা করতে হয়, সেগুলো কমিশনের জন্য যথেষ্ট চিন্তার খোরাক জুগিয়ে থাকে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনকে স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কাটতে হয়, যা এই উপমহাদেশে বর্তমানে বিরল। বলা হয়, নির্বাচনী ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন-পরিবর্ধন চলমান প্রক্রিয়া। কাজেই এ প্রক্রিয়াতে পরিবর্তন চলমান রাখতে হয়। এদিক থেকে ভারতের নির্বাচন কমিশন অনেক এগিয়ে, বিশেষ করে কারিগরি সংযোজনার দিক থেকে। ভারতের নির্বাচন কমিশনের মাঠপর্যায়ের ব্যবস্থাপনা (Micro Management) অনেক সুবিন্যস্ত। একসময় ভারতের কিছু কিছু রাজ্যে নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা নৈরাজ্যজনক ছিল। সেখান থেকে ভারতীয় নির্বাচন কমিশন বহুদূরে এসেছে।

এসব কথা উত্থাপনের উদ্দেশ্য হালে অনুষ্ঠিত ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ব্যবস্থাপনার ত্রুটি-বিচ্যুতি থেকে কিছু পর্যবেক্ষণ-অভিজ্ঞতার আলোকে আলোচনা ও সুপারিশ করার প্রয়াস। নির্বাচন কমিশনের সামনে রয়েছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ব্যাপক অভিজ্ঞতা আমার স্মৃতিপটে ভাস্বর হয়ে রয়েছে। ২০১০ সালে ওই শহরের নির্বাচনে বাংলাদেশে প্রথম একজন নারী কর্মকর্তা রিটার্নিং অফিসার হিসেবে দেশে ও আন্তর্জাতিক মহলে দারুণ সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন। ব্যাপক প্রতিকূলতার মধ্যে প্রশংসনীয় ও অত্যন্ত সাহসের সঙ্গে সব বাধা অতিক্রম করেছিলেন। চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচন এবারও সহজ হওয়ার নয়। অবশ্য যদি সব বড় দল অংশগ্রহণ করে।

নির্বাচন কমিশন ধন্যবাদ পেতে পারে ঢাকার নির্বাচনে উন্নত প্রযুক্তির ইভিএম ব্যবহারের জন্য, যদিও দুটি জায়গায় আজও উন্নতির লক্ষ্যে আমার মতামত রয়েছে। এর একটি ভিডিপি-সংক্রান্ত এবং অপরটি প্রার্থীর তথ্য প্রোগ্রামিংয়ের সময় প্রার্থী অথবা দলের আইটি বিশেষজ্ঞদের কারিগরি দলে অন্তর্ভুক্তির। ঢাকার নির্বাচনে ইভিএম না হলে ভোটার উপস্থিতির সঠিক চিত্র পাওয়া যেত না। ইভিএমের যাঁরা বিরোধিতা করছেন, ইভিএম না থাকলে এবার তাঁদের জামানতের টাকা ফিরে পাওয়া বোধ হয় দুষ্কর হতো। জামানত হারানো প্রার্থী বা দলের জন্য শুভ ইঙ্গিত বহন করে না। বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিপক্ষের যতসংখ্যক প্রার্থী জামানত হারিয়েছেন, ততসংখ্যক বোধ হয় অতীতে কোনো নির্বাচনে দেখা যায়নি। এবার ইভিএমের মাধ্যমে যে কারচুপির অভিযোগ উঠেছে তা যান্ত্রিক নয়, বরং দলীয় সমর্থকদের বিভিন্ন ধরনের অসৎ উপায় অবলম্বন করার কারণে। অভিযোগ রয়েছে যে ভোটার শনাক্ত করার পর ব্যালট ইউনিট কার্যকর হওয়ার পর হয় অন্য কেউ নির্ধারিত প্রতীকে ভোট দিয়েছেন অথবা ভোটারকে বাধ্য করেছেন তাঁর পছন্দের বাইরে ভোট প্রদানে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে এটা ইভিএমের দ্বারা কারচুপি নয় (not System failur), বরং স্বভাবত অসৎ মানুষের দ্বারা কারচুপি (Systematic distortion)। তবে একটা সত্য মানতেই হবে যে পাঁচ মিনিটে ১০০ ব্যালট স্টাফিং থেকে এই মেশিন ব্যবহারে ভোট ব্যবস্থা রেহাই পেয়েছে এবং ভোটের হার বাড়িয়ে দেখানো সম্ভব হয়নি। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, ইভিএম ব্যবহার চালু রাখাই বাঞ্ছনীয়। তাতে অন্তত জাল ভোটে ব্যালটবাক্স ভরানো (স্টাফিং) থেকে নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা মুক্ত থাকবে।

এই নির্বাচনে ভোটকেন্দ্র দখল হয়েছে ভিন্নভাবে তিন স্তরে—মহল্লা পাহারা, ভোটকেন্দ্র পাহারা এবং বুথে প্রকাশ্যে ভোট দেওয়াতে বাধ্য করা। এসবের প্রতিকার নির্বাচন কমিশন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী করতে পারেনি। প্রকাশ্যে ভোটকেন্দ্র পাহারা ও দখল-পাল্টা দখলের ঘোষণা দেওয়া আইনের পরিপন্থী এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ হওয়া সত্ত্বেও নির্বাচন কমিশন এসবের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি। এমনকি মৌখিক সতর্ককরণও করা হয়নি। কেন্দ্রের বাইরে সরকারি দলের ব্যাপক উপস্থিতি সাধারণ ভোটারদের শঙ্কিত করেছে। এর বিরুদ্ধেও নির্বাচন কমিশন এবং কমিশন কর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা ব্যবস্থা নেননি বা নিতে পারেননি। ভবিষ্যতে নির্বাচন কমিশনকে এ বিষয়ে খতিয়ে দেখে আইন প্রয়োগের ব্যবস্থা কার্যকর করতে হবে।

ভোটকেন্দ্রের বাইরে ভোটারদের তথ্য ও ভোটার নম্বর দিয়ে সাহায্য করার কাজটি দলগুলোর করা উচিত নয়। ভারতের মতো আমাদের নির্বাচন কমিশনেরও উচিত নিজেদের আওতায় কেন্দ্রভিত্তিক পর্যবেক্ষক নিয়োগ করা। এই পর্যবেক্ষকেরা ভোটার তালিকা থেকে ভোটারদের স্লিপ দেবেন। এ পদ্ধতি গ্রহণ করলে কেন্দ্রের বাইরে বিভিন্ন দলের বিশেষ প্রতিনিধিদের প্রয়োজন কম হবে। কেন্দ্র নির্বাচন কমিশনের নিযুক্ত ব্যক্তিদের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত থাকবে। ভোটারদের ভয়ভীতি কমবে। ভোটার স্লিপ প্রদানের কাজটি নির্বাচন কমিশনের আওতায় করতে যেসব ব্যক্তি ভোটার নিবন্ধনের সঙ্গে নিয়োজিত ছিলেন, তাঁদেরই নিয়োজিত করার বিষয়ে নির্বাচন কমিশন পরীক্ষামূলকভাবে দেখতে পারে। এ ব্যবস্থায় কেন্দ্রের বাইরে অবাঞ্ছিত ব্যক্তিদের উপস্থিতি কম হতে পারে।

প্রকাশ্যে ব্যালটে সিল দিতে ভোটারদের বাধ্য করার রেওয়াজ হালের কিছু নির্বাচন থেকে শুরু হয়ে এখন একধরনের বদভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এ কারণে প্রতিপক্ষের এজেন্টকে বের করার অভিযোগ অহরহ পাওয়া যায়। আমি মনে করি, যেহেতু ইভিএম প্রকৃত ভোটার শনাক্ত করতে পারে, তাই বুথে শুধু ভোটার এবং ভোটের সঙ্গে সম্পৃক্ত এজেন্ট, কর্মকর্তা-কর্মচারী ছাড়া অন্য অবাঞ্ছিত ব্যক্তিদের উপস্থিতি নিষিদ্ধ করা উচিত। কোনো ধরনের ব্যত্যয়ের জন্য নিয়োজিত কর্মকর্তারাই দায়ী থাকবেন। আসছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এটা পাইলট আকারে পরীক্ষা করা যেতে পারে।

ডিজিটাল গণনা ও একীভূত করার সময় গণনা এজেন্ট নিয়োগ করার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তাঁদের প্রধান দায়িত্ব হবে গণনা পর্যবেক্ষণ ও স্বপক্ষের কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফলের প্রিসাইডিং কর্মকর্তার স্বাক্ষরকৃত রেজাল্টপত্র বুঝে নেওয়া। তার মানে, দুই রকমের এজেন্ট তৈরি করা: বুথ এজেন্ট এবং কাউন্টিং এজেন্ট।

বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনের বয়স প্রায় ৫০ বছর হতে যাচ্ছে, কিন্তু মাঠপর্যায়ে ব্যবস্থাপনা আধুনিকীকরণ তেমনটা হয়নি। মাত্র এক যুগ আগে ডিজিটাল ভোটার তালিকা হয়েছে। এর সঙ্গে জাতীয় পরিচয়পত্র ও ইভিএমের ব্যবহার সংযোজন করা হয়েছে। কিন্তু এখনো ভোট গ্রহণের জন্য গোপন কক্ষের কোনো উপকরণে নির্বাচন কমিশন আধুনিকতা আনতে পারেনি। গোপন কক্ষ তৈরির দায়িত্ব প্রিসাইডিং কর্মকর্তাকে দেওয়া হয়। তাঁরা যে যাঁর মতো বিভিন্ন সাইজের কাপড় ব্যবহার করে তা তৈরি করেন। আমার মনে হয়, এই কক্ষ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, ভোটারের ভোট প্রদানের গোপনীয়তা রক্ষা করার জন্য। আন্তর্জাতিক মানের টেবিল এবং প্রাইভেসি স্ক্রিন ব্যবহারের ব্যবস্থা করা উচিত। প্রাইভেসি স্ক্রিনের উচ্চতা এমনভাবে নির্ধারণ করতে হবে, যাতে একজন ভোটারের কাঁধ থেকে ওপরে দৃশ্যমান থাকে এবং যাতে সিসিটিভি ব্যবহারে দৃশ্যমান হয়। নির্বাচন কমিশন পর্যায়ক্রমে সিসিটিভি ব্যবহার শুরু করতে পারে। অতীতে পাইলট হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল।

ভোট গ্রহণকে প্রভাবমুক্ত করতে এবং ইভিএমের সুফল পেতে হলে ভোটকেন্দ্র ও তার আশপাশে কোনো প্রকার প্রভাব বিস্তার করতে দেওয়া যাবে না। এখানে নির্বাচন কমিশনকে অনমনীয় হতেই হবে। অন্যথায় কোনো আধুনিক প্রযুক্তিতে ভোট গ্রহণ প্রভাবমুক্ত রাখা যাবে না। একই সঙ্গে ইভিএম চালনার ক্ষেত্রে প্রিসাইডিং কর্মকর্তা এবং অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রিসাইডিং কর্মকর্তার এক শতাংশ অপশনের অবসান করতে হবে। কারণ, ঢাকা সিটি করপোরেশনের অভিজ্ঞতা ভালো নয়। একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রিসাইডিং কর্মকর্তা একটি নির্দিষ্ট দলের প্রার্থীর পক্ষে প্রদান করা হয়, যার সংখ্যা ছিল ৩২টি ভোট। শুধু একজন নন, পরিচিত একাধিক কর্মকর্তা এমনটাই বলেছেন। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনকে অন্য উপায় খুঁজতে হবে।

একটি নির্বাচন সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য এবং প্রভাবমুক্তভাবে অনুষ্ঠিত করার সাংবিধানিক দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। এ দায়িত্বের অংশীদার আরও অনেক ব্যক্তি ও সংগঠন, রাজনৈতিক দল ও প্রার্থী। দল ও প্রার্থীদের সহযোগিতা ছাড়া নির্বাচন কমিশনের পক্ষে এ দায়িত্ব পালন সম্ভব নয়। নির্বাচন কমিশন বলতে শুধু কমিশনারই নন, মাঠপর্যায়ের সব সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারী। বিগত নির্বাচনগুলোতে দল, প্রার্থী এবং মাঠপর্যায়ের নিয়োজিত কর্মকর্তাদের সিংহভাগের আচরণ সুষ্ঠু নির্বাচন সহায়ক ছিল না। যত দিন পর্যন্ত এসব শরিক সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য এবং নিরপেক্ষ নির্বাচনে সহায়তা না করবেন এবং কমিশন শক্ত অবস্থানে না থাকতে পারবে, তত দিন বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাবে।

ড. এম সাখাওয়াত হোসেন: নির্বাচন বিশ্লেষক, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা এবং এসআইপিজির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো (এনএসইউ)
[email protected]