গরিবের পকেটে হাত কেন?

প্রধানমন্ত্রী ও জাতীয় সংসদের নেতা শেখ হাসিনা গত মঙ্গলবার সংসদের সমাপনী ভাষণে বলেছেন, ব্যাংকে টাকার কোনো সমস্যা নেই। টাকা আছে বলেই সেবা খাত, সামাজিক নিরাপত্তা, অবকাঠামো খাতে ব্যাপক উন্নয়নের কাজ চলছে। সেই সঙ্গে অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ এখন সিঙ্গাপুরের চেয়েও শক্তিশালী বলে মন্তব্য করেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রীর এই কথায় সবার খুশি হওয়ার কথা। কিন্তু একই সঙ্গে যখন দেখি সরকার টাকা সংগ্রহের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে এবং ডাকঘর সঞ্চয় প্রকল্পে জমা রাখা টাকার সুদ অর্ধেকে নামিয়ে এনেছে, তখন সেই খুশি বিষাদে পরিণত হয়। সরকার ঋণখেলাপিদের কাছ থেকে টাকা আদায় করতে না পেরে গ্রামাঞ্চলের গরিব মানুষগুলোর পকেটে হাত দিয়েছে। ফলে সরকার যত আশ্বাসই দিক না কেন, অন্যান্য সঞ্চয় প্রকল্পের জামানতকারীরাও দুশ্চিন্তায় আছেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ব্যাংকে টাকার অভাব নেই। কিন্তু সেটি গরিব, নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য নয়। ব্যাংকে টাকার অভাব নেই বড় বড় ঋণখেলাপিদের জন্য। তাঁরা এক ব্যাংকের ঋণ শোধ না করেই হরেক রকম কৌশলে আরেক ব্যাংক থেকে বড় অঙ্কের ঋণ নেন। অনেকে ব্যাংকের টাকা ঋণ নিয়ে বিদেশে পাচার করে দিয়েছেন বলে গণমাধ্যমে খবর এসেছে। আবার অনেকে ব্যাংকই খোলেন টাকা হাতিয়ে নেওয়ার জন্য। এসব খেলাপিদের সঙ্গে না পেরে গরিব সঞ্চয়কারীদের পকেটে হাত দেওয়া কতটা যৌক্তিক হয়েছে সেটি একবার অর্থমন্ত্রী ভেবে দেখবেন কি?

গত সপ্তাহের শেষ কার্যদিবস অর্থাৎ বৃহস্পতিবার অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের নির্দেশনায় জানানো হয়েছিল, ‘তিন বছর মেয়াদি ডাকঘর সঞ্চয় স্কিমের সুদের হার হবে ৬ শতাংশ, যা এত দিন ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ ছিল। সাধারণ হিসাবের ক্ষেত্রে সুদের হার সাড়ে ৭ শতাংশ থেকে কমিয়ে করা হয় ৫ শতাংশ। সর্বশেষ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মেয়াদ পূর্তির আগে ভাঙানোর ক্ষেত্রে এক বছরের জন্য সুদ মিলবে ৫ শতাংশ, আগে যা ছিল ১০ দশমিক ২০ শতাংশ। দুই বছরের ক্ষেত্রে তা সাড়ে ৫ শতাংশ, আগে যা ছিল ১০ দশমিক ৭০ শতাংশ।’

প্রথম আলোতে প্রথম এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশের পরই চারদিকে হইচই শুরু হয়ে যায়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিরা শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতো যুক্তি দেখান এটি জাতীয় সঞ্চয় প্রকল্পের অংশ নয়। জাতীয় সঞ্চয়ের কোনো প্রকল্পের সুদের হার কমানো হয়নি।

অর্থ মন্ত্রণালয় এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ হয়েছে খোদ জাতীয় সংসদেই। জাতীয় পার্টির সাংসদ পীর ফজলুর রহমান প্রশ্ন রেখেছেন সরকার মধ্যবিত্তের সঞ্চয়ে কেন হাত দিচ্ছে? অর্থমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, ‘বিদেশে প্রতিবছর ৭৫ হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে। ঋণখেলাপিরা টাকা পাচার করছেন, সেটা ঠেকানো যাচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ চুরির টাকা আনতে পারছে না। কিন্তু মধ্যবিত্তের সঞ্চয়ে সুদের হার কমানো হয়েছে। খুদে সঞ্চয়কারীদের জমানতের সুদের হার না কমিয়ে ব্যাংক ডাকাতি, টাকা আত্মসাৎ, বিদেশে টাকা পাচার বন্ধ করুন।’ ডাকঘর সঞ্চয়ে সুদের হার আগের মতো করার দাবি জানান এই সাংসদ।

প্রথম আলোয় শওকত হোসেন তাঁর মতামত প্রতিবেদনে লিখেছেন, ‘নয় ছয়-এর প্রথম ধাক্কায় সুদ কমল ডাকঘর সঞ্চয়ের।’

এই সিদ্ধান্ত খুদে সঞ্চয়কারীদের ওপর কী প্রভাব পড়বে তা সরকার চিন্তাভাবনা করেছে বলে মনে হয় না। সঞ্চয়পত্র সরকারের একটি জনকল্যাণমুখী প্রকল্প। এর মাধ্যমে যেমন সম্পদ গড়ে ওঠে তেমনি সরকার সেই সম্পদ দেশের উন্নয়নকাজে লাগাতে পারে। সঞ্চয় না হলে সম্পদ বাড়ে না। আর সম্পদ না বাড়লে দেশেরও উন্নয়ন হয় না। আমাদের সংবিধানে ধনী ও গরিবের মধ্যে বৈষম্য কমানোর কথা বলা আছে। কিন্তু সরকার সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমিয়ে ধনী ও গরিবের বৈষম্য আরও বাড়িয়ে দিল।

সঞ্চয়ের বিকল্প ছিল শেয়ারবাজার। কিন্তু লুটেরাদের খপ্পরে পড়ে সেই শেয়ারবাজার এখন সাধারণ মানুষের কাছে আতঙ্কে পরিণত হয়েছে। অন্যদিকে ব্যাংকগুলো খুদে বিনিয়োগকারীদের উৎসাহিত করে না। কথিত সার্ভিস চার্জেই সুদের একাংশ চলে যায়। এ কারণে খুদে সঞ্চয়কারীরা জাতীয় সঞ্চয়পত্রের দিকে ঝুঁকেছেন। সরকারও এত দিন উৎসাহিত করে এসেছিল।

দেশের অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলার জন্য খুদে বিনিয়োগকারীরা দায়ী নয়। দায়ী হলো লুটেরারা। এই লুটেরারা জাতীয় সঞ্চয়েও হাত দিয়েছে। তারা বেনামে বিপুল অঙ্কের অর্থ সঞ্চয়পত্র কিনেছে। এ ক্ষেত্রে সরকার কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করলেও তা কাজে লাগেনি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ইব্রাহিম খালেদ সরকারের এই পদক্ষেপকে সংবিধানবিরোধী বলে অভিহিত করেছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে দেশে মূল্যস্ফীতি হচ্ছে ৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ। সঞ্চয়পত্রে মুনাফা ৬ শতাংশ হলে মূল্যস্ফীতি ও ট্যাক্স বাদ দিলে তো কোনো লাভই পাবে না বিনিয়োগকরী। এ অবস্থায় সঞ্চয়পত্রে সুদহার ৬ শতাংশ কতটুকু যৌক্তিক তা ভাবার বিষয়।

সরকার সব ক্ষেত্রেই যে একযাত্রায় ভিন্ন ভিন্ন ফলের নীতি অনুসরণ করে চলেছে, ডাকঘর সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানো তার বড় উদাহরণ। ব্যাংক থেকে যারা হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করছে, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে না পেরে খুদে সঞ্চয়কারীদের পকেটে হাত দিয়েছে।

সর্বশেষ খবর হলো, প্রতিবাদ ও আপত্তির মুখে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল গত বুধবার বলেছেন, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সমস্যার কথা মাথায় রেখে ডাকঘর সঞ্চয় স্কিমে সুদের হার পুনর্বিবেচনা করা হবে। মন্ত্রী পুনর্বিবেচনার আশ্বাস দিলেও তাঁর মন্ত্রণালয় থেকে কোনো পরিপত্র জারি না হওয়া পর্যন্ত ডাকঘরের সঞ্চয়কারীদের আমানতের সুদের হার ৬ শতাংশই থেকে যাচ্ছে। পুনর্বিবেচনার পর হারটি কী দাঁড়াবে সেটাই এখন দেখার বিষয়।

সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]