আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস

বর্ষপঞ্জি ঘুরে প্রতিবছর ২১ ফেব্রুয়ারি আসে। আজও এসেছে। প্রতিবছরের মতো আজও আমরা ফোন, এসএমএস, ই-মেইল, ফেসবুক বা অন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ নিয়ে অনেক আবেগমথিত কথা বলব। সারা বছর বাংলা ভাষাকে আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি কি না, ইংরেজির মতো ভাষা শেখার তাড়নায় বাংলাকে অবহেলা করছি কি না, তা নিয়ে কেউ কেউ বিতর্ক তুলব। কেউ আবার সদর্পে বলব, বাঙালি তার ভাষার জন্য গর্ববোধ করতে জানে।

কিন্তু সব তর্কবিতর্কের ঊর্ধ্বের সত্যটি হলো নিজের ভাষা নিয়ে বাঙালির গর্ব যতই থাক, পরিস্থিতির চাপে সেই ভাষার সর্বাত্মক চর্চায় বাঙালি আজ ব্যর্থ। বাংলার প্রতি এই অবহেলা কেন? উপলব্ধির অন্তর্লোকে উঁকি দিলে দেখা যাবে এই অবহেলার মূল কারণ প্রতিযোগিতা আর পেশার তাড়না। যাঁর সামর্থ্য বা সুযোগ আছে, তাঁর মধ্যেই নিজের সন্তানকে বাংলা মাধ্যমের বদলে ইংরেজি মাধ্যমে লেখাপড়া শেখানোর প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এই অবস্থাটা যেমন সত্যি, তেমনি এটাও সত্যি যে দেশের বেশির ভাগ মানুষ প্রায় সব ক্ষেত্রেই বাংলানির্ভর। সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চার মাধ্যমও বাংলাই।

তাহলে বোঝা যাচ্ছে মাতৃভাষার প্রতি আমাদের মমত্ববোধের ঘাটতি নেই; কিন্তু এই ভাষাকে আমাদের পেশাগত বা প্রায়োগিক জীবনের ভাষা হিসেবে নবায়ন করে নিতে পারিনি। যে ভাষার জন্য ভাষাশহীদেরা জীবন দিয়েছেন, সেই বাংলাকে আমরা এখনো ‘কাজের ভাষা’ হিসেবে গড়ে তুলতে পারিনি। সাহিত্য-সংস্কৃতি বা শিল্পচর্চার বাইরে যে বৃহত্তর পেশাগত জীবন ও জগৎ, সেখানে বাংলা ভাষাকে আমরা ঠিকমতো কাজে লাগাতে পারছি না।

এটা অস্বীকার করা যাবে না যে বাংলাকে শিক্ষা ও পেশার প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যবহার্য করে তোলার প্রয়াস আমরা হারিয়ে ফেলেছি। ফলে কেউ চাইলেই বিজ্ঞান, চিকিৎসাবিদ্যা, কারিগরি বা প্রযুক্তিবিদ্যা, আইন বা অন্য কোনো বৃত্তিমূলক শিক্ষা বাংলায় চালানো সম্ভব নয়। ইংরেজির বাইরে রুশ, জার্মান, জাপানি, স্প্যানিশ, ফরাসি ইত্যাদি ভাষায় প্রায় সব ধরনের উচ্চশিক্ষার সুযোগ রয়েছে। নিজেদের মাতৃভাষাকে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রের ব্যবহার্য ভাষা করে তুলতে পেরেছেন তাঁরা। তাঁরা নিজ ভাষায় বিজ্ঞানের গবেষণাপত্র প্রকাশ করতে পারছেন। তাঁরা মাতৃভাষায় স্বচ্ছন্দে প্রকৌশলবিদ্যা পড়তে পারছেন। কারণ, ভাষাগুলো সেসবের উপযুক্ত হয়ে উঠেছে দিনে দিনে। আমরা মাতৃভাষাকে নিয়ে সেভাবে এগিয়ে যেতে পারিনি।

তবে এসব সমস্যার পরও নিজের মাতৃভাষা নিয়ে আমাদের গর্ব মোটেও কমেনি। প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি প্রমাণ করে দিয়ে যায় সে কথা। একুশে ফেব্রুয়ারি আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি পেয়েছে। কিন্তু আমাদের স্বকীয় চেতনা নিয়ে এগিয়ে যেতে হলে বাংলাকে স্বয়ংসম্পূর্ণতার পথে নিয়ে যেতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে উচ্চশিক্ষা বা পেশার ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা ব্যবহার করতে চাইলে তার উপযুক্ত পরিভাষাকাঠামো গড়ে তুলতে হবে। সেই শপথ নিয়ে যদি এগোনো যায়, তাহলেই বাংলা সর্বস্তরে ব্যবহারযোগ্য ভাষা হয়ে উঠতে পারবে। পাশাপাশি বাংলাদেশে সংখ্যায় খুব অল্প হলেও কিছু ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর লোকের নিজস্ব মাতৃভাষা আছে। সে ভাষাগুলোর চর্চা ও সংরক্ষণ নিশ্চিত করার দায়টি আমাদের ওপর এসে পড়ে।

যঁাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে ভাষা হিসেবে বাংলার এই প্রতিষ্ঠা ও স্বীকৃতি, যে আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় বাংলাভাষী জনগণ সেই ভাষার নামে একটি দেশ পেয়েছে; সেই সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউরসহ সব ভাষাশহীদকে জানাই আমাদের শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা। তবে সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন এবং এর জন্য একটি মহাপরিকল্পনা নেওয়া ও তা দ্রুততম সময়ে বাস্তবায়ন করা গেলে সেটিই হতে পারে ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের শ্রেষ্ঠ উপায়।