বাতির দাম আড়াই লাখ টাকা

শীত গেছে। বসন্ত এসেছে। তবে দুর্নীতির ঋতু অপরিবর্তিত আছে। রাষ্ট্রের উন্নয়ন প্রকল্পগুলো যাঁরা বাস্তবায়ন করেন, তাঁরা এত দিন সমাজকে বুঝিয়ে এসেছেন, ‘উন্নয়ন ও দুর্নীতি মাসতুতো ভাই’; এই ‘দুজন’ হাত ধরাধরি করে এগোয়। এতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু সেই প্রাথমিক পাঠ এখন মাধ্যমিক হয়ে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে এসে ঠেকেছে। ‘হোক উন্নয়ন, হোক দুর্নীতি’—অনুচ্চারিত এ স্লোগান এখন ‘উন্নয়নের নামে শুধুই দুর্নীতি’ স্লোগানে রূপ নিচ্ছে। এ কারণে ‘বালিশ–কাণ্ড’, ‘পর্দাকাণ্ড’—ইত্যাকার ‘লঙ্কাকাণ্ড’ একের পর এক ঘটছে।

এ ধরনের সর্বশেষ কাণ্ড দেখা যাচ্ছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) ‘নর্থ-সাউথ সড়ক নির্মাণ’ প্রকল্পে। উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবের (ডিপিপি) তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম মহানগরীর জাকির হোসেন সড়কের ওয়্যারলেস মোড় থেকে নির্মাণাধীন বায়েজিদ বোস্তামী-ফৌজদারহাট সড়ক পর্যন্ত নতুন সড়ক নির্মাণ করা হবে। এতে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৭৪৪ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। মাত্র আড়াই কিলোমিটারের এ সড়ক বানানোর জন্য আমেরিকা, কানাডা ও ইউরোপে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিতে যেতে চাইছেন ১৩ কর্মকর্তা ও প্রকৌশলী। তাঁদের সাতজনের প্রকল্প বাস্তবায়নে মাঠপর্যায়ে কোনো সংশ্লিষ্টতাই নেই। সড়কটি আলোকিত করতে এলইডি বাতি কিনতে খরচ ধরা হয়েছে সোয়া আট কোটি টাকা। একেকটি বাতির দাম প্রস্তাব করা হয়েছে ২ লাখ ৩৫ হাজার টাকা। যদিও একই সংস্থার আরেকটি প্রকল্পে সড়কবাতি কেনা হচ্ছে সাড়ে ১১ হাজার টাকা করে। গত বছরের এপ্রিলে হাতে নেওয়া প্রকল্পটি অনুমোদনের জন্য এখন পরিকল্পনা কমিশনে রয়েছে। সেখানেও প্রশিক্ষণের নামে কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর ও সড়কবাতির দাম নিয়ে আপত্তি উঠেছে।

একটি এলইডি বাতির দাম যে ২ লাখ ৩৫ হাজার টাকা হতে পারে না, মাত্র আড়াই কিলোমিটার সড়ক বানানোর জন্য জনপ্রতি ১৫ লাখ টাকা খরচ করে ১৩ জন কর্মকর্তাকে আমেরিকা, কানাডা ও ইউরোপে ‘প্রশিক্ষণ’ নিতে যাওয়ার যে দরকার নেই, তা বুঝতে বিশদ জ্ঞানী হতে হয় না। এগুলো যে সংকীর্ণ পচনশীল স্বার্থপরতায় আকীর্ণ কিছু লোকের স্রেফ লুটপাট ও জনগণের টাকায় বিদেশে পিকনিক করতে যাওয়ার নির্লজ্জ ও কদর্য অভিলাষ, তা সবাই বুঝতে পারে।

এ ধরনের ডিপিপি যাঁরা প্রস্তুত করেছেন, ধরে নেওয়া যায়, এর লাভের গুড়ের বড় ভাগ তাঁরাই ভোগ করতে চেয়েছেন। ‘উন্নয়নের নামে শুধুই দুর্নীতি’ নীতিতে বিশ্বাসী এসব কর্মকর্তা যখন কাগজে-কলমে কোটি কোটি টাকা ব্যয় দেখিয়ে প্রকল্পগুলো থেকে অর্থ লুটপাট করেন, সেই মুহূর্তে বকেয়া বেতনের দাবিতে অনশন করতে করতে পাটকলশ্রমিকদের মৃত্যুর খবর পত্রিকার পাতায় দেখা যায়। এ ধরনের সব ডিপিপি বাতিল করে এর ‘রচয়িতাদের’ বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা না নিলে সব উন্নয়ন মাঠে মারা যাবে।