ফুটন্ত কড়াইতে বাংলা সংস্কৃতি

বিশ্বজোড়া বয়লার-প্যানে টগবগ করে ফুটছে আমাদের সংস্কৃতি। আর সেই সঙ্গে ‘গেল’ ‘গেল’ রব উঠেছে দশ দিক থেকে—‘গেল, বাংলা সংস্কৃতি গেল!’ কিন্তু সত্যিই কি গেছে, বা যাচ্ছে?

একটা সময় ছিল যখন আমাদের দেশটা ছিল হাজার হাজার স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম নিয়ে গঠিত। একজন মানুষের জন্ম-মৃত্যু-বিয়ে হতো একই গ্রামে, তার কর্মজীবনের সীমানাও চিহ্নিত ছিল সেই ক্ষুদ্র পরিসরে। তখন এক গাঁয়ের সংস্কৃতি আরেক গাঁয়েও ঢুকতে পেত না। এমনকি একই গ্রামের তাবৎ বাসিন্দার সংস্কৃতিও এক ছিল না। এক রকমের খাবার খেত না তারা, রান্না হতো না এক রকম, কাপড়চোপড় পরত নানা রকমের, কেউ নিজের মতো করে শ্যামকে, কেউ শ্যামাকে, কেউবা শিবকে ডাকত; কেউবা আবার বিপদে পড়ে ডাকত পীর-ফকির আর খোদাকে।

তা হলে বাঙালিরা যে বলে ‘আমরা মিলেছি আজ মায়ের ডাকে’—সেই মিলটা কোথায়? একবার সেই মিলটার দিকে নজর দেওয়া যাক।

মিল ছিল এবং এখনো আছে—ভাতে আর ভাষায়। আমরা ‘বাঙাল’। আমরা কথা বলি বাংলায়; আর আমাদের অভিন্ন পরিচয় আমরা ‘ভেতো বাঙালি’।

কিন্তু এখন আর আমরা সেই পুরোনো গ্রামের চৌহদ্দিতে সীমাবদ্ধ নেই। গ্রাম থেকে শহরে, শহর থেকে দূর দেশে—বাঙালিরা ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের সর্বত্র—উত্তরে নরওয়ে থেকে দক্ষিণে নিউজিল্যান্ড, পুবে জাপান থেকে পশ্চিমে হাওয়াই পর্যন্ত। (মানুষ যখন মঙ্গল গ্রহে যাবে, তখন হয়তো দেখবে, সেখানেও আগে থেকেই বাঙালিরা একটি ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট খুলে বসে আছে!) এহেন পরিস্থিতিতে আমরা সবাই আমাদের বাঙালিয়ানা বজায় রাখি কীভাবে? আপনি হয়তো জাপানে বসে ‘সুশি’ (কাঁচা মাছ) খাচ্ছেন, আরেকজন হয়তো আমেরিকায় বসে ‘হটডগ’ খাচ্ছে অথবা ইন্দোনেশিয়ায় বসে ‘সাতে’ খাচ্ছে। ইতালিতে বসে পিৎজা তো সবাই খায়, এমনকি, কেউ কেউ হয়তো পিৎজা বানিয়ে বিক্রিও করে। আমাদের পুরোনো রসগোল্লা আর সন্দেশ তাদের খানদানি পরিচয় আর ধরে রাখতে পারছে না—কদিন আগেই একজন আমাদের ঢাকার বাসায় বেড়াতে এলেন একটা অপরিচিত খাবারের প্যাকেট হাতে। শুনলাম ওটা নাকি একটা টার্কিশ খাবার। টার্কিশ খাবার এখানে? উনি বললেন, হ্যাঁ, ওটার নাম বাক্লাভা, আমাদের ঢাকাতেই অভিজাত পাড়ার এক দোকানে তৈরি।

এভাবেই আমাদের ‘ভেতো বাঙালি’র পরিচয় ধীরে ধীরে লোপ পাচ্ছে। চীনা, থাই, কোরিয়ান, জাপানি রেস্টুরেন্টের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। ইতালিয়ান পিৎজা, মার্কিন হটডগ আর ইন্দোনেশিয়ান সাতেরও এন্তার ছড়াছড়ি।

তাই বলে আদপে ভাববেন না, বিশ্বায়নের ফলে কেবল বাঙালিরা দেশ-বিদেশের আজব আজব খাবার খাচ্ছে। উল্টোটাও হচ্ছে! অর্থাৎ? অর্থাৎ বিশ্বায়নের ফলে বিদেশিরাও বাঙালিদের খাবার খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলছে। (না, না, ঢেকুর তুলছে না। কারণ, ঢেকুর তোলাকে বিদেশিরা অশিষ্ট কাজ বলে বিবেচনা করে।) বিদেশিদের ওপর বাঙালিদের প্রভাবের একটা দৃষ্টান্ত দিই। বিদেশে বাঙালিদের প্রথম ডায়াসপোরা মানে জনগোষ্ঠী গড়ে ওঠে বিলেতের মাটিতে।

বিদেশ যাওয়ার ভীতি আর নিষেধ অমান্য করে কালাপানি পার হওয়া সেই বাঙালিরা সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল চালের বস্তা। সে চালের ভাত প্রথমে তারা নিজেরাই খেত। তারপর তারা খুলে বসল খাবারের দোকান অর্থাৎ রেস্টুরেন্ট। সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজরা অবশ্য সেই রেস্টুরেন্টে ভিড় জমাল না। কিন্তু একটি-দুটি করে খদ্দের এসে ক্রমশ জনপ্রিয় হলো বাঙালিদের রেস্টুরেন্ট। এখন বাঙালিদের ‘ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট’ খুঁজে পাবেন ব্রিটেনের আনাচকানাচে—সর্বত্র। সংখ্যা প্রায় নয় হাজার। একদিন ছিল যখন ‘রাইস’ নামক জিনিসটি কী, ইংরেজরা তা-ই জানত না; আর এখন ইংরেজদের ঘরে ঘরে রাইস আর হট কারি। (বোধ হয় মহারানির ডাইনিং টেবিলেও কখনো কখনো বাঙালিদের রাইস আর তন্দুরি চিকেন দেখা দেয়।) একসময় ইংরেজরা বাঙালিদের শাসন-শোষণ করেছে। আজ প্রায় পাঁচ লাখ বাঙালি মিলে ব্রিটেন ‘দখল’ করে ভাত আর ঝাল রান্না খাইয়ে ইংরেজদের চোখের জল ঝরাচ্ছে। একেই বলে ঝাল-ঝোলের প্রতিশোধ!

প্রবাসী বাঙালিদের সবচেয়ে বড় ঘাঁটি অবশ্য ব্রিটেনে অবস্থিত নয়। গোটা মধ্যপ্রাচ্য সয়লাব হয়েছে বাঙালিদের বন্যায়। এক সৌদি আরবেই তাদের সংখ্যা ২০ লাখ বা তার চেয়েও বেশি। এদের পনেরো আনাই অদক্ষ শ্রমিক। বাড়িতে, কলকারখানায় অথবা নির্মাণশিল্পে ঘাম ঝরানোর কাজ করে এরা, বেতনও নিতান্তই কম। সৌদি আরবের পরেই আছে আরব আমিরাত। কোনো কোনো হিসাব অনুসারে সে দেশে বাঙালিদের সংখ্যা লাখ দশেক। মধ্যপ্রাচ্য আর দূরপ্রাচ্যে যে বাঙালিরা বসতি স্থাপন করেছে, আর ব্রিটেন, আমেরিকা, ইতালি, অস্ট্রেলিয়া ইত্যাদি দেশে যে বাঙালিরা বসতি স্থাপন করেছে, তাদের মধ্যে অবশ্য একটা মৌলিক পার্থক্য আছে। মধ্যপ্রাচ্য অথবা দূরপ্রাচ্যে যারা বাস করছে, তারা প্রধানত অস্থায়ী শ্রমিক; আর ব্রিটেন ইত্যাদি দেশে যারা আছে, তারা প্রধানত স্থায়ী বসতি স্থাপনকারী।

প্রবাসী বাঙালিদের আস্তানাগুলো গড়ে উঠেছে অনেক সময়ই চেইন ইমিগ্রেশনের ফলে। একজন একটা দেশে গিয়ে বসতি স্থাপন করে তারপর তার আত্মীয়দের নিয়ে গেল। সেই আত্মীয়রা আবার তাদের আত্মীয়দের নিয়ে গেল। এভাবে একটা অঞ্চলের অথবা এক ভাষাভাষী লোকেদের বসতি গড়ে ওঠে। যেমন ব্রিটেনে গড়ে উঠেছে সিলেটিদের বসতি। পাঁচ লাখ বাঙালির শতকরা প্রায় নব্বই জনই সিলেটি। এ রকম অভিন্ন পরিচয়ের জনগোষ্ঠী এক জায়গায় বাসা বাঁধলে তারা আদি সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য অনেকাংশে বজায় রাখে। স্থানীয় সংস্কৃতি দিয়ে সহজে প্রভাবিত হয় না। অথবা নিজের দেশের অন্য অঞ্চলের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যও সহজে নিজের করে নেয় না।

এখানটাতেই ব্রিটেনের বাঙালি আর মার্কিন অথবা ইতালিয়ান বাঙালিদের পার্থক্য। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে গিয়ে যারা ইতালি এবং মার্কিন মুলুকে বসতি স্থাপন করেছে, তারা সবাই বাঙালি। এমনকি ভারতীয় বাঙালিরাও সেখানে বাঙালি বলে নিজেদের শনাক্ত করে। এই প্রসারিত বাঙালি পরিচয় প্রতিফলিত হয় তাদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে। অনেক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানই তারা আয়োজন করে সবাই মিলে।

কী ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করে তারা? প্রথমেই বলতে হয় ধর্মীয় অনুষ্ঠানের কথা। একদিকে ঈদ, অন্যদিকে পূজা। প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে বেশির ভাগই মুসলমান। তাই বাড়িতে বাড়িতে ঈদ হয় ঘটা করে। কিন্তু হিন্দুদের সংখ্যা কম। তাদের বাড়িতে হয়তো সরস্বতীপূজা, লক্ষ্মীপূজা হয়, কিন্তু সর্বজনীন পূজা কমই হয়। লন্ডনে অবশ্য একাধিক জায়গায় দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু ধর্মীয় পরিচয় ছাপিয়ে বিদেশে বসবাসকারী সব বাঙালির যে পরিচয় ফুটে ওঠে, সে হলো তাদের ভাষিক পরিচয়। জাতিধর্ম-নির্বিশেষে বাঙালিদের সবচেয়ে বড় মিল তাদের ভাষার নামে। আমরা সবাই বাঙালি। বাঙালিদের এই পরিচয় তাদের মুখ্য পরিচয় হয়ে উঠেছে গত সত্তর বছরে। এই সময়ে তারা তাদের ভাষাকে ভালোবাসতে শিখেছে, ভাষার নামে একটি স্বাধীন দেশ গড়ে তুলেছে।

সেই ভাষার নামে সুদূর প্রবাসেও দুই বাংলার বাঙালিরা একত্র হয়, একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস পালন করে। এমনকি সেই প্রবাসে তারা এই দিনের প্রতীক—শহীদ মিনার গড়ে তুলেছে। যেমন লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটসের একটি পার্কে। তীব্র শীত উপেক্ষা করে লন্ডনের বাঙালিরা অনেকেই সেই শহীদ মিনার চত্বরে মিলিত হয়ে রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারির ভাষাশহীদদের স্মরণ করে।

কিন্তু এখন বাঙালিয়ানা প্রকাশের এর থেকেও গুরুত্বপূর্ণ উপলক্ষ হলো পয়লা বৈশাখ—বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন। অস্ট্রেলিয়া, এশিয়া, ইউরোপ ও আমেরিকা মহাদেশে প্রবাসী বাঙালিরা দিনটি পালন করে উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে। কিন্তু ইংল্যান্ডের নানা জায়গায়, বিশেষ করে লন্ডনে, ইতালির রোমে, অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে, আমেরিকার নিউইয়র্কে দিনটি পালিত হয় নাচ-গান, দেশীয় খাবারসহ নানা রকম অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। এবং আমার ধারণা, একুশে ফেব্রুয়ারি আর নববর্ষের অনুষ্ঠান পালনে বাংলাদেশিরাই বেশি উদ্যোগ নেয়। সে যা-ই হোক, দুই বাংলার প্রবাসীরাই ব্যাপক বিশ্বায়নের যুগেও এসব অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বারবার ফিরে যায় দেশমাতার কাছে। কিন্তু বিশ্বায়নের যুগে নির্ভেজাল বঙ্গসংস্কৃতির কোলে ফেরা অসম্ভব।

গোলাম মুরশিদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক
[email protected]