বিদ্যুৎ খাতে লাভের গুড় কারা খাচ্ছে?

বিদ্যুৎ
বিদ্যুৎ

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ ১৮ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে জানিয়েছেন, ‘গত ১০ বছরে সরকার বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি দিয়েছে ৫২ হাজার ২৬০ কোটি টাকা।’ গত ৭ ডিসেম্বর ফাইন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের প্রতিবেদনে বলা হয়, কোনো বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেই বেসরকারি কোম্পানিগুলো গত ১০ বছরে উঠিয়ে নিয়েছে ৫১ হাজার ১৫৭ কোটি টাকা। অলস বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ২০১৮ সালে পিডিবি ক্যাপাসিটি চার্জ গুনেছে ৬ হাজার ২৪১ কোটি টাকা এবং ২০১৯ সালে ৮ হাজার ৯২৩ কোটি টাকা। ভর্তুকির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের টাকা এভাবে তুলে দেওয়া হচ্ছে কিছু কোম্পানির হাতে। দুই দফায় এর মাশুল দিচ্ছে সাধারণ মানুষ: একবার করের টাকা দিয়ে অপ্রয়োজনীয় ভর্তুকির মাধ্যমে, আরেকবার ক্রমবর্ধমান বিদ্যুতের মূল্য পরিশোধে বাধ্য হয়ে। ভর্তুকির এই অর্থ অন্য কোনো জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যয়িত হতে যে পারছে না, সেটাও আরেক ক্ষতি।

এই লাগাতার ভর্তুকি মেটাতে সরকার বারবার বিদ্যুতের দাম বাড়াচ্ছে। বছরে শুধু একবার নয়, বরং একাধিকবার বিদ্যুৎ-জ্বালানির দামে পরিবর্তনের বিধান রেখে সংশোধন করা হয়েছে এনার্জি রেগুলেটরি আইন। মন্ত্রী বলেছেন, ভর্তুকির ভার কমাতে দাম বাড়ানোর বিকল্প নেই। তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেছেন, দাম বাড়ানোর বহু বিকল্প আছে! আশঙ্কা হয়, যেহেতু শিল্পের মোট খরচের ১০ থেকে ১৫ শতাংশ ব্যয় বিদ্যুৎ ও জ্বালানিতে হয়, তাই নতুন করে মূল্যবৃদ্ধি মূল্যস্ফীতি বাড়িয়ে জনজীবন ও রপ্তানিমুখী শিল্পের উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে দেবে। ভোক্তা অধিকার সংস্থা ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা শামসুল আলম গত ডিসেম্বরে বলছেন, ‘উৎপাদনে ৮ হাজার কোটি টাকা, বিতরণে ২ হাজার কোটি টাকা মোট ১০ হাজার কোটি টাকা অযৌক্তিক ব্যয় আছে। সরকারের ঘাটতি আছে ৭ হাজার ২৫৩ কোটি টাকা। তাহলে কেন এই অযৌক্তিক ব্যয়ের কারণে বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হবে। সরকারকেই কেন ভর্তুকি দিতে হবে।’

অলস বিদ্যুতের বোঝা
দেশে বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতার বড় অংশই অলস থাকছে। ক্যাপটিভ, নবায়নযোগ্য উৎপাদনসহ বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মোট স্থাপিত সক্ষমতা ২২ হাজার ৭৮৭ মেগাওয়াট। কিন্তু ক্যাপটিভ বাদে ১৯ ফেব্রুয়ারি প্রকৃত উৎপাদন ছিল মাত্র ৯ হাজার ৩৬৩ মেগাওয়াট এবং এই দিনে সর্বোচ্চ উৎপাদন সক্ষমতা ছিল ১৪ হাজার ১৬৫ মেগাওয়াট। চাহিদা না থাকায় গ্রীষ্মকালে, ২০১৯ সালের ২৯ মে দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ড ছিল ১২ হাজার ৮৯৩ মেগাওয়াট। এই হিসাবে প্রায় ৪৪ শতাংশ স্থাপিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের সক্ষমতা অলস পড়ে থাকছে। নতুন কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র অপেক্ষমাণ বলে অলস পরিমাণ দ্রুতই ৫০ শতাংশ ছড়িয়ে যাবে; যদিও বিদ্যুৎ খাতের মাস্টারপ্ল্যানে মোট স্থাপিত সক্ষমতার ২০ থেকে ২৫ শতাংশের বেশি বিদ্যুৎকেন্দ্রকে অলস বসিয়ে না রাখার নির্দেশনা দেওয়া আছে।

চাহিদা বিবেচনা না করে প্রতিযোগিতাহীন দরপত্রে বহুবিধ অন্যায় সুবিধা ও দায়মুক্তি দিয়ে বেসরকারি খাতে বেশ কিছু তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের অনুমোদন দেওয়া হয়। এগুলো বসিয়ে রেখে গুনতে হচ্ছে মোটা অঙ্কের ক্যাপাসিটি চার্জ। আইপিপি নামক এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের বোঝা টানতে হবে ১৫ থেকে ২২ বছর। ২০২২ সাল পর্যন্ত আইপিপিগুলোর আয় করমুক্ত। অধিকাংশ ইউনিট অলস থাকায় এদের কারও কারও প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় পড়ছে ৭৫ (অ্যাগ্রিকো পাওয়ার সলিউশন) থেকে ৮১ টাকার (প্যারামাউন্ট বিট্রাক এনার্জি) মতো। অন্যদিকে, তেল আমদানিতেও নগদ প্রণোদনা পায় তারা। এদিকে দ্রুত বিদ্যুৎ–সংকটের সাময়িক সমাধান হিসাবে শুরু হলেও কুইক রেন্টাল কেন্দ্রগুলো চলছে ১০ বছর পরেও।

পিডিবির হিসাব বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত ছয় বছরে পিডিবিকে ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হয়েছে প্রায় ৩৫ হাজার ৪৮৪ কোটি টাকা, যা বেসরকারি খাত থেকে ক্রয়কৃত বিদ্যুতেরই প্রায় ৩৭ দশমিক ২২ শতাংশ।

একটি–দুটি নয় বহু, সভ্রেন গ্যারান্টি
সাধারণত বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীরা কিছুটা বেশি দামের নিশ্চয়তা এবং নিয়মিত বিদ্যুৎ কেনার বাধ্যবাধকতাকে শর্ত হিসেবে রেখে বিনিয়োগ করতে চায়। কিন্তু আমাদের বেসরকারি আইপিপিগুলোকে তৃতীয় পক্ষহীন চুক্তিতে তিন থেকে পাঁচ গুণ দামের নিশ্চয়তা দেওয়া আছে। আছে ক্যাপাসিটি চার্জ, ওভারহোলিং চার্জ, তেল আমদানি প্রণোদনা, কর অবকাশ সুবিধা, শুল্কমুক্ত সুবিধাসহ বহু সভ্রেন গ্যারান্টি। আছে সহজ শর্তের ঋণের সুবিধাও। তারা জমি ক্রয়ে রেজিস্ট্রি কর মওকুফ করার সুবিধা চায়। মোট বিনিয়োগের অন্তত ১০ শতাংশ মূল্যের খুচরা যন্ত্রপাতি প্রতিবছর করমুক্ত সুবিধায় আমদানি করতে চায়। বিপিসির আমদানি করা তেলের মান নিয়ে প্রশ্ন (যদিও তা পরীক্ষিত) তুলে সেখানেও নতুন প্রণোদনা চায়! এমনকি ২০০৬ শ্রম আইনের কর-পূর্ব মুনাফার ৫ শতাংশ শ্রমিককল্যাণ তহবিলে রাখার বিধানও সংশোধন চায়।

এ ধারণা অমূলক নয় যে ক্ষমতাবলয়ের দুর্নীতির চৌহদ্দিতে থাকা লোকেদের কুপ্রভাবে অকারণে রাষ্ট্রের বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। দলীয় ব্যবসায়ীদের দিয়ে রাষ্ট্রের তহবিল লুটের এমন বেসরকারিকরণ নজিরবিহীন। এই চুক্তিগুলোকে পরিমার্জন ও সংশোধন করে রাষ্ট্রীয় অপচয় থামানোর সুযোগ রয়েছে।

অপরীক্ষিত সক্ষমতা
নতুন কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র উচ্চ জ্বালানি দক্ষতায় (ইফিসিয়েন্সি) একটানা কয়েক মাস চালু থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম (প্ল্যান্ট ফ্যাক্টর) হলেই তার স্থাপিত সক্ষমতার প্রায় ৭৫ শতাংশকে (প্ল্যান্ট ক্যাপাসিটি) পরীক্ষিত সক্ষমতা হিসেবে ধরা হয়। বাংলাদেশের আইপিপিগুলোর ঘোষিত সক্ষমতা আন্তর্জাতিক মানে কারিগরিভাবে পরীক্ষিত নয়। ফলে এই সক্ষমতার হিসাবে বড় ধরনের গরমিল থাকার সম্ভাবনা থাকছে। সামিট পাওয়ারের ১১টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা ১ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট। কিন্তু এই কেন্দ্রগুলোকে কখনোই সক্ষমতার অর্ধেকেও ব্যবহার করা হয়নি। এই কথিত সক্ষমতা সুনামধারী তৃতীয় কোনো পক্ষের মাধ্যমে পরীক্ষিত হওয়া তো দূরের কথা, এই ১১টি কেন্দ্রের জন্য বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (পিডিবি) ২০১৮-১৯ অর্থাৎ মাত্র এক অর্থবছরেই ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হয়েছে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা। দুর্নীতির দলীয় প্রভাবে প্রতিযোগিতাহীন দরপত্রে বহুবিধ অন্যায় সুবিধা ও দায়মুক্তির মাধ্যমে পাওয়া এই কেন্দ্রগুলোর সক্ষমতাকে আন্তর্জাতিক কারিগরিভাবে নিরীক্ষা করে রাষ্ট্রের তহবিল সাশ্রয়ের সুযোগ অবশ্যই রয়েছে।

দুর্নীতি ও সিস্টেম লস কমিয়ে সাশ্রয়
বিদ্যুৎ একটি কারিগরি খাত। তাই এখানে বিদ্যুৎ পরিবাহী তারের সঞ্চালন লস ছাড়া কোনো ধরনের সিস্টেম লস ব্যাখ্যার অযোগ্য। বৃহৎ দেশগুলো, যেখানে অতি দীর্ঘ সঞ্চালন লাইনে বিদ্যুৎ নেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকে, সেখানে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ (যেমন ইউএসএ) সিস্টেম লস মেনে নেওয়া হয়। কিন্তু অতি ছোট দেশ হয়েও বাংলাদেশের বিদ্যুৎ বিতরণ ও সঞ্চালনে সিস্টেম লস ৯ দশমিক ৩৫ শতাংশ হবে—এটা গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা চাই সরকার বিদ্যুৎ চুরি বন্ধে দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিয়ে রাষ্ট্রের লোকসান কমিয়ে আনুক। এ ছাড়া নতুন সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র, সঞ্চালন ও বিতরণ প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়ন সক্ষমতা, মানসম্পন্ন কারিগরি নকশা তৈরি এবং বৈদেশিক ঋণের গ্রেস পিরিয়ড ব্যবহার ব্যবস্থাপনা উন্নত করে বিদ্যুৎ খাতে সাশ্রয়ী হওয়ার সুযোগ রয়েছে।

ফাইজ তাইয়েব আহমেদ: নেদারল্যান্ডসের ভোডাফোনে কর্মরত প্রকৌশলী এবং টেকসই উন্নয়নবিষয়ক লেখক।