দলের বিচার ও ভোটের বিচার

‘কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিল সে মরে নাই’।

আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব ঢাকা দক্ষিণ ও চট্টগ্রাম সিটির গদিনশিন মেয়র যথাক্রমে সাঈদ খোকন এবং আ জ ম নাছিরকে মনোনয়ন না দিয়ে প্রমাণ করেছে, এই দুই বৃহৎ সিটির ‘দুই পিতা’ মুখে যত বাগাড়ম্বরই করুন না কেন, কাজের কাজ কিছু করেননি। বিরোধী দল থেকে নির্বাচিত মেয়রদের কাছ থেকে অভিন্ন অভিযোগ পাওয়া যেত যে সরকারের অসহযোগিতার কারণে তাঁরা কাজ করতে পারেননি বা পারছেন না। বিরোধী দলের একাধিক মেয়র অতীতে জেলও খেটেছেন। কিন্তু ঢাকার দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন ও চট্টগ্রামের আ জ ম নাছিরের সেই অভিযোগ করার সুযোগ ছিল না। তাঁরা সরকারের পূর্ণ সহযোগিতা সত্ত্বেও দৃশ্যমান কোনো কাজ দেখাতে পারেননি।

উত্তর সিটি করপোরেশনে আতিকুল ইসলাম দ্বিতীয়বারের মতো নির্বাচিত হয়েছেন। মেয়র আনিসুল হক মারা যাওয়ার পর অনেক দিন সিটি করপোরেশন অভিভাবকহীন ছিল। সরকার দলীয় কোনো নেতার প্রতি আস্থা রাখতে পারেনি বলে উপনির্বাচন পিছিয়ে দেওয়া হয়। পরে বছরখানেক আগে ব্যবসায়ী নেতা আতিকুল ইসলামকে দলীয় মনোনয়ন দিয়ে জিতিয়ে আনা হয়। উপনির্বাচনে বিএনপি অংশ না নেওয়ায় আওয়ামী লীগকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হয়নি।

২০১৫ সালে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচন একই দিন হলেও আইনি জটিলতার কারণে এবার ভিন্ন তারিখে নির্বাচন হচ্ছে। ঢাকার দুই সিটির নির্বাচন হয়ে গেল ১ ফেব্রুয়ারি। ২০১৫ সালে তিন সিটি করপোরেশনে আওয়ামী লীগ মনোনীত তিন প্রার্থী জয়ী হয়েছিলেন। ঢাকার উত্তরে আনিসুল হক, দক্ষিণে সাঈদ খোকন এবং চট্টগ্রামে আ জ ম নাছির। এর মধ্যে আনিসুল হক কাজের সময় পেয়েছিলেন মাত্র দুই বছর। অন্য দুজন পুরো মেয়াদে মেয়রের দায়িত্ব পালন করলেও তাঁরা নগরবাসীর সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ হয়েছেন। আনিসুল হক দুই বছরে যে কাজ করে দেখিয়েছেন, অপর দুই মেয়র পাঁচ বছরেও করতে পারেননি। ফলে দলীয় মনোনয়নও পাননি।

দলীয় সূত্রমতে, যে প্রত্যাশা নিয়ে সাঈদ খোকন এবং আ জ ম নাছিরকে মেয়র বানানো হয়েছিল, সেই প্রত্যাশা তাঁরা পূরণ করতে পারেননি। আওয়ামী লীগের দক্ষিণ নগর শাখার সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে সিটি মেয়রের সম্পর্কের টানাপোড়েন ও পাল্টাপাল্টি কর্মসূচির কথাও সবার জানা। ২০১৭ সালের ১৬ নভেম্বর আজিমপুরের পার্ল হারবার কমিউনিটি সেন্টারসংলগ্ন আওয়ামী লীগের কর্মী সমাবেশের পাশে পাল্টা কর্মসূচি দিয়েছিলেন সাঈদ খোকন। চট্টগ্রাম সিটির মেয়র নাছিরের সঙ্গে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের একাংশের বিরোধের কারণে অনেক অঘটন ঘটেছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগে মেয়র নাছিরের অনুসারীরা ৯টি ভাগে বিভক্ত, শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসানের অনুসারীরা দুই ভাগে।

ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, জনপ্রিয়, গ্রহণযোগ্য এবং ভোটারদের কাছে স্বচ্ছ ভাবমূর্তি রয়েছে, এমন ব্যক্তিদের মনোনয়ন দেওয়া হবে। এর সরল অর্থ হলো মেয়র খোকন বা নাছির দলের ও ভোটারদের কাছে স্বচ্ছ ভাবমূর্তি তুলে ধরতে পারেননি, সবার কাছে গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হননি।

দলের মনোনয়ন না পেয়ে সাঈদ খোকন বলেছিলেন, আলহামদুলিল্লাহ। তিনি নেত্রীর সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। আ জ ম নাছির বলেছেন, তিনি মিথ্যাচার, অপরাজনীতি, অপপ্রচার ও ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন। এ ষড়যন্ত্র কারা করেছেন, তাঁর বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়েছেন, সেটি খোলাসা করে বলা উচিত। তিনিও দলের সিদ্ধান্ত মেনে সিটি করপোরেশনে দলীয় প্রার্থী রেজাউল করিম চৌধুরীর পক্ষে কাজ করার কথা বলেছেন।

যেকোনো সরকারের জন্য উপনির্বাচন বা স্থানীয় সরকারের নির্বাচন একটি বড় পরীক্ষা। সেই পরীক্ষাটি যদি সুষ্ঠু হয় এবং ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী পাস করতে পারেন, তাহলে বুঝতে হবে সরকার জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে পেরেছে। আর যদি তাদের প্রার্থী ফেল করেন, বুঝতে হবে জনপ্রিয়তায় ধস নেমেছে। ১৯৪৭ সালে যখন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন সর্বত্রই ছিল মুসলিম লীগের জয়জয়কার। কিন্তু ১৯৪৯ সালের মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত টাঙ্গাইলের একটি আসনের উপনির্বাচনে মুসলিম লীগের প্রার্থী খুররম খানকে হারিয়ে তরুণ শামসুল হক (পরে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক) বিপুল ভোটে পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তখনো আওয়ামী লীগ গঠিত হয়নি। আওয়ামী লীগ গঠিত হয় ওই বছরের ২৩ জুন। ওই উপনির্বাচনের ফলাফল দেখে অনুমান করা কঠিন ছিল না যে মুসলিম লীগ সরকারের দিন শেষ হয়ে এসেছে। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবি ঘটে। তখনো নির্বাচন কমিশন ছিল না। ডেপুটি কমিশনাররা নির্বাচন পরিচালনা করতেন, তারপরও কোনো নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক হয়নি। কারচুপি বা ব্যালট চুরির অভিযোগ ওঠেনি। স্বাধীন বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন, উপনির্বাচন কিংবা স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচন—প্রতিটি নিয়ে জবরদস্তি ও কারচুপির অভিযোগ উঠেছে। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন প্রথম সরকারের আমলে মাগুরা উপনির্বাচনের অঘটন দেশকে মহাপ্রলয়ের দিকে নিয়ে গিয়েছিল। আমাদের রাজনীতিকেরা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেন না। ক্ষমতায় থেকে অন্যকে শিক্ষা দিতে পছন্দ করেন।

১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মাত্র ২৭ শতাংশ ভোটার ভোট দিয়েছেন। ভোট দেননি ৭৩ শতাংশ ভোটার। এর আগে চট্টগ্রামের একটি আসনে উপনির্বাচনে ভোট পড়েছিল ২৩ শতাংশের কম। তিনটি নির্বাচনই হয়েছে ইভিএম বা ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে। ইভিএম নিয়ে যতই বিতর্ক থাক, তা রাতের বা গায়েবি ভোট বন্ধ করতে পেরেছে। নির্বাচন কমিশন চাইলেও এখন ২৩ শতাংশকে ৭৩ শতাংশ দেখাতে পারবে না।

এই প্রেক্ষাপটে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন ও জাতীয় সংসদের ছয়টি আসনে উপনির্বাচন হতে যাচ্ছে আগামী মার্চ-এপ্রিল মাসে। তফসিল অনুযায়ী জাতীয় সংসদের ঢাকা-১০, গাইবান্ধা-৩ ও বাগেরহাট-৪ আসনের উপনির্বাচন হবে আগামী ২১ মার্চ। বগুড়া-১ ও যশোর-৬ আসনের উপনির্বাচনের তফসিল ঘোষণা না করলেও ছয়টি আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী চূড়ান্ত করেছে। ঢাকা-১০ আসনে শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন, যশোর-৬ আসনের শাহীন চাকলাদার, গাইবান্ধা-৩ আসনে উম্মে কুলসুম, বগুড়া-১ আসনে সাহাদারা মান্নান এবং বাগেরহাট-৪ আসনে আমিরুল ইসলাম দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন। অন্যদিকে বিএনপি ঢাকা-১০ আসনে শেখ রবিউল আলম, বাগেরহাট-৪ আসনে কাজী খায়রুজ্জামান ও গাইবান্ধা-৩ আসনে ডা. সৈয়দ মাইনুল হাসান সাদিককে প্রার্থী করেছে। চট্টগ্রাম সিটি ও অপর তিনটি আসনে দলটি এখনো প্রার্থী চূড়ান্ত করেনি। বিএনপি বলেছে, তারা আন্দোলনের অংশ হিসেবে নির্বাচনে যাচ্ছে।

আমরা মনে করি, সিটি করপোরেশনের মেয়র পদপ্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ মনোনয়ন বোর্ড সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছে। কিন্তু আমাদের এ–ও মনে রাখতে হবে, দলীয় মনোনয়নই তো নির্বাচন নয়। নির্বাচন হলো ভোটারদের অবাধে রায় দেওয়ার সুযোগ। বিগত নির্বাচনগুলোতে ভোটাররা সেই সুযোগ পাননি। সামনের নির্বাচনগুলোতে পাবেন, এমন নিশ্চয়তা নির্বাচন কমিশন কিংবা ক্ষমতাসীন দল থেকে পাওয়া যায়নি। তাঁরা ভোটারের সংখ্যা বেশি হলে উৎসবমুখর পরিবেশ আবিষ্কার করেন, আর কম হলে উন্নত দেশের উদাহরণ টানেন।

আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্য সঠিক ধরে নিলে যাঁরা বিতর্কের ঊর্ধ্বে এবং কোনো অপকর্মের রেকর্ড নেই, তাঁরাই সিটি নির্বাচনে মনোনয়ন পেয়েছেন। সব দল এ রকম ব্যক্তিদের মনোনয়ন দিলে আমরা ভালো জনপ্রতিনিধি পেতে পারি। কিন্তু সে জন্য যে পূর্বশর্তটি পূরণ করা প্রয়োজন সেটি হলো ভোটের সুষ্ঠু ও সুন্দর পরিবেশ নিশ্চিত করা, সব প্রার্থী ও দলকে সমান সুযোগ দেওয়া। যে নির্বাচনে কোনো দলের সমর্থকেরা কেন্দ্রের ভেতরে–বাইরের নিয়ন্ত্রণ নেবে না, আর কোনো দলের সমর্থকেরা পালিয়ে বেড়াবে না।

আওয়ামী লীগের নেতারা কথায় কথায় বলে থাকেন, বিএনপির নেতা-কর্মীরা কেন্দ্রে না এলে আমাদের কী করার আছে। তাঁদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, ২০০১ -২০০৬ মেয়াদে বিএনপির নেতারাও আওয়ামী লীগ সম্পর্কে একই কথা বলতেন। উপনির্বাচন বর্জন করলে আওয়ামী লীগের প্রার্থী দেওয়ার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন নিয়ে তুলতেন। সে সময় বিএনপির নেতাদের কথা না-হক হলে এখন আওয়ামী লীগের নেতারা যা বলছেন, তা হক হতে পারে না।

যে দেশের মানুষ ভোটকে উৎসব হিসেবে নেয়, সেই দেশে ২৩ বা ২৭ শতাংশ ভোটারের উপস্থিতি কোনোভাবে স্বাভাবিক নয়। নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করে দেখুন কত শতাংশ ভোটার কেন্দ্রে আসেন।

আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ড তিন প্রধান সিটি করপোরেশনের প্রার্থী বাছাইয়ে দুই গদিনশিনকে বাদ দিয়েছে। বহাল রেখেছে একজনকে। এটি তাদের সঠিক বিচার বলেই মনে করি। এখন ভোটারদের সঠিক রায়টি দিতে দিন।

সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]