সুদের হার কে ঠিক করবে

সুদের হার নিয়ে নীতিনির্ধারক ও ব্যাংকারদের মধ্যে যে দড়ি–টানাটানি শুরু হয়েছে, তাতে মনে হয় যেন সপ্তদশ শতাব্দীতে বাস করছি। অর্থনীতির কোনো বিদ্যাই যেন অর্থকর্তারা তোয়াক্কা করছেন না। শোনা যায়, বৈশাখ থেকে ব্যাংকঋণের সুদের হার হবে শতকরা ৯ ভাগ, আর আমানতের ওপর তা হবে শতকরা ৬ ভাগ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও তা–ই চান এবং তাঁর এই চাওয়ার পেছনে একটা সরল সদিচ্ছা কাজ করছে। বিনিয়োগ বাড়ানো ও উচ্চ প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা। কিন্তু তাঁকে যাঁরা উপদেশ দিচ্ছেন, তাঁরা কি ভুলে যাচ্ছেন যে আদিষ্ট সুদের হার বাজার অর্থনীতির সঙ্গে কোনোভাবেই সংগতিপূর্ণ নয়? মুক্তবাজারে তো আরও সম্ভব নয়।

সুদের হার হচ্ছে জলে ভাসা পদ্ম—তহবিল চাহিদা বা বিনিয়োগের ক্ষুধা বাড়া–কমার সঙ্গে এটি ওঠানামা করে। এটি শাস্ত্রীয় অর্থনীতিবিদেরা ঋণযোগ্য তহবিল তত্ত্বে বলে গেছেন। অর্থনীতিবিদ কিনসের ভাবনায় কিছুটা অন্য সুর—মুদ্রার চাহিদা ও জোগান সুদের হার ঠিক করে। কিনস বা ক্ল্যাসিক্যাল—যেটিই অনুসরণ করি না কেন, আদিষ্ট সুদহারের গানে কোনো সুরই লাগছে না। ভোগ, বিনিয়োগ, সরকারি খরচ, প্রবৃদ্ধি, সুদহার, মূল্যস্ফীতি, বিনিময় হার—অর্থনীতির এই বিখ্যাত চলকগুলোর দুটি জাত আছে। স্বয়ম্ভূত বা অটোনোমাস বনাম প্রাপ্ত বা ডিরাইভ্‌ড। ভোগ বিনিয়োগের একটা অংশ ও সরকারি ব্যয় হলো স্বয়ম্ভূত। আর বাকিগুলো প্রাপ্ত বা অন্য চলকের ঠেলাঠেলির ফসল—জলে ভাসা পদ্মের উচ্চতার মতো। সুদহারও তা–ই।

অনেকে বলবেন, পৃথিবীর সব সচল অর্থনীতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কী করে সুদহার নির্ধারণ করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে সুদহার ঠিক করে, তার নাম নীতি সুদহার। এটি বাজারে সংকেত দেয় বাণিজ্যিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে। এটি বাড়ালে বুঝতে হবে অর্থনীতিকে একটু ‘টাইট’ দিতে হবে—কারণ, ব্যক্তি বিনিয়োগ অতিরিক্ত বেড়ে যাচ্ছে, হয়তো মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী—অর্থনীতি অতিতপ্ত হওয়ার ঝুঁকিতে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদহার কমালে বুঝতে হবে অর্থনীতিতে মন্দার বাতাস আসছে, তাকে রোধ করতে হবে। তবে এই ‘সংকেত’ তৈরি করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আগেই ভালো গবেষণা করে থাকে। মুদ্রাজোগান, চাহিদা, প্রবৃদ্ধি, মূলস্ফীতি—সবকিছু নিয়ে। আমাদের মতো হোটেলে বসে ব্যবসায়ীদের তাগাদামতো সুদহার আর কোথাও নির্ধারিত হয় না।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটা বিশাল অর্কেস্ট্রার সংগীত পরিচালকের মতো। তিনি সুর, লয়, ছন্দ ঠিক করেন। কিন্তু কণ্ঠ শিল্পীর নিজস্ব। অন্য ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংকেত বুঝে সুদহার কমায় কিংবা বাড়ায়। এ ক্ষেত্রে একটা বিস্তার বা রেঞ্জের স্বাধীনতা বাজার অর্থনীতিতে দিতে হয়। শুধু আদিষ্ট সংখ্যায় পেরেক ঢোকানো যায় না। তা হয়ে যায় উত্তর কোরিয়ার মতো।

বিপদ আমাদের আরও। আমাদের সংগীত পরিচালক দুজন—তা আবার একই গানের আসরে। একদিকে সরকার সঞ্চয়পত্রে উচ্চ সুদ বজায় রাখছে, যা ১১ ভাগের ওপর। অথচ এর সমতুল্য তথা আমানতের ওপর বাজারে সুদহার ৬ ভাগে নামাতে বলা হয়েছে। সঞ্চয়পত্রের উচ্চ সুদের খেসারত দিতে দিতে সরকারের উন্নয়ন বাজেটে ক্ষতি হচ্ছে। অন্যদিকে ব্যাংকগুলো ন্যায্য তহবিল পাচ্ছে না। অনেকে যুক্তি দেখান—ব্যাংকগুলোতে তহবিলের অত ঘাটতি নেই। তা থাকবে কী করে? আমরা যদি একই আসরে দুই শিল্পীর দুই রকম গান শুনি, তাহলে চড়া সুরই কানে আসবে। সরকার চড়া সুদ বজায় রাখছে। ক্রমান্বয়ে একটা অলস সঞ্চয়ী সমাজ তৈরি হচ্ছে। কার ঠেকা বিনিয়োগের ঝুঁকি নেওয়ার। ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি বড়ই নাজুক। শুধু সরকারের বিনিয়োগঘোড়া আর কত দিন এই রথ টানবে? সেটা উচিতও নয়। এতে ব্যক্তি–উদ্যোগ ঝিমিয়ে পড়ে। শেয়ারবাজারেও এর লক্ষণ স্পষ্ট।

সোজা কথা, সুদের হারের একক নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতেই থাকে। এটি উন্নত সভ্য দেশের নিয়ম—যারা অর্থনীতির নীতি ও প্রতিষ্ঠানকে শ্রদ্ধা করে, শক্তিশালী বানায়। জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের মতো সংস্থাগুলো যত দ্রুত লুপ্ত করা যায়, ততই মঙ্গল। এক বনে দুই বাঘ থাকে না। হইচই বাড়ে। এরপর আমানত সংগ্রহের সব দায়িত্ব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে দিতে হবে। এতে প্রতিযোগিতা বাড়বে ও সঠিক সুদহার বেরিয়ে আসবে। ব্যাংক শক্তিশালী হবে। আজকাল ব্যাংকগুলোকে একদিকে খেলাপিরা টানে তহবিল নিয়ে, আরেক দিকে সরকার টানে অসংগত আবগারীয় সুদহার চাপিয়ে দিয়ে। এরপরও ব্যাংকগুলো যে টিকে আছে, সে জন্য এদের মেডেল দেওয়া উচিত।

মোদ্দাকথা, বাজার অর্থনীতি ও প্রতিযোগিতায় বিশ্বাস করলে পুরো সুদের ব্যাপারটা ব্যাংকব্যবস্থার ওপর ছেড়ে দিতে হবে। পদ্মকে জলে ভাসতে দিন—ওটাকে কৃত্রিমভাবে উঁচুতে ঝুলিয়ে রাখলে মরে যাবে। আবার টেনে জলের নিচে বেঁধে রাখলে তা পচে যাবে। সুদহারের এই স্বাভাবিক তত্ত্বকে পাশ কাটিয়ে যা কিছু করব—সবই হবে ব্যর্থ কসরত। ঘোষণার চেয়ে সঠিক প্রণোদনা অনেক শক্তিশালী ও ফলপ্রদ।

বিরূপাক্ষ পাল: স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্ক অ্যাট কোর্টল্যান্ড-এ অর্থনীতির অধ্যাপক
[email protected]