দুই পরীক্ষক ব্যবস্থা উঠিয়ে দেওয়া প্রয়োজন

৩৮তম বিসিএস পরীক্ষা থেকে শুরু হয়েছে লিখিত পরীক্ষার খাতা দুই পরীক্ষকের কাছে পাঠানো। গড় করে প্রাপ্ত নম্বর ঠিক করা হয়। তাঁদের প্রদত্ত নম্বরের পার্থক্য ২০ শতাংশের অধিক হলে যায় তৃতীয় পরীক্ষকের কাছে। আগে একজন পরীক্ষকই খাতা দেখতেন। তাঁর দেওয়া নম্বরই চূড়ান্ত বলে হতো বিবেচিত। নিশ্চয়ই সব পরীক্ষক একরূপ মনোযোগ দিয়ে খাতা দেখেন না। তাঁদের বিবেচনার মানদণ্ডও সমান হওয়ার কথা নয়। তাই সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি) হয়তোবা অধিকতর স্বচ্ছতার বিষয় বিবেচনাক্রমে দ্বৈত পরীক্ষক ব্যবস্থা চালু করেছে লিখিত পরীক্ষায়। তাদের বিবেচনাবোধ নজিরবিহীন এবং বিলম্বিত বিসিএস পরীক্ষাকে আরও বিলম্বিত করছে।

সিভিল সার্ভিসে নিয়োগের জন্য এ ধরনের পরীক্ষা গ্রহণের ব্যবস্থা চালু হয় ব্রিটিশ শাসনামলে। তখনো খাতা দেখতেন একজন পরীক্ষক। ভারত ও পাকিস্তানে এখনো এ ব্যবস্থাই চালু রয়েছে। এখানেও ছিল। কিন্তু ৩৮তম বিসিএস থেকে বদলে যায় নিয়ম। ফলে অতিরিক্ত সময় লাগছে। এমনিতেই জট লেগেছিল এখানে স্বাধীনতার কিছুদিন পর থেকেই। ক্ষেত্রবিশেষে চার বছরও লেগেছে। তবে দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টায় সেটা প্রায় সোয়া দুই বছরে নেমে এসেছিল। কিন্তু ৩৮তম বিসিএসে লেগে যাচ্ছে তিন বছরের মতো সময়। ২০১৮ সালের মার্চে লিখিত পরীক্ষায় অংশ নেন ১৬ হাজার ২৮৫ জন পরীক্ষার্থী। তাঁদের খাতা দেখে ৯ হাজার ৮৬২ জনকে ২০১৯ সালের ১ জুলাই লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ঘোষণা করা হয়। শুধু ১৫ মাস লাগল লিখিত পরীক্ষাতেই। মৌখিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে সবেমাত্র। এখনো চূড়ান্ত ফলাফল দেয়নি পিএসসি।

পরীক্ষাটির সূচনা পরিপত্র জারি হয় ২০১৭ সালের ১৪ মার্চ। সে বছরের ২৯ ডিসেম্বর ২ হাজার ২৪টি পদের বিপরীতে ৩ লাখ ৪৩ হাজার ৫৩২ জন প্রার্থী প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় অংশ নেন। প্রিলিমিনারির মূল্যায়ন হয় কম্পিউটারের মাধ্যমে। তাই এটা তেমন সময় নেয় না। সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা এক বছরেই শেষ করে চাকরিতে যোগ দেওয়া এ উপমহাদেশে ঐতিহ্য আমরা ধরে রাখতে পারিনি। আর কিছুটা কাছাকাছি হতে গিয়েও আবার বিপরীতমুখী হয়ে পড়ল। পিএসসির সুপারিশ পাওয়ার পরও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় নেবে আরও প্রায় এক বছর। আগে লাগত এক মাস। ২০১৭ সালের মার্চে যে বিসিএস পরীক্ষার্থী ৩০ বছরের কাছাকাছি ছিলেন, তিনি মনোনীত হলে নিয়োগ পাবেন ২০২১ সালের সূচনায়, ৩৪ বছর বয়সে। কাজ করবেন ২৫ বছর। এভাবে সময়ের অপচয় আমরা জাতীয় জীবনে বিভিন্নভাবে ঘটাচ্ছি।

দ্বিতীয় পরীক্ষক ব্যবস্থা বাস্তবসম্মত নয় বলে লক্ষণীয় হচ্ছে। আর এমনটা আমরা করছি কেন? দ্বিতীয় পরীক্ষকের ব্যবস্থা আছে অনার্স ও মাস্টার্স পরীক্ষায়, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। তবে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে কি না, জানা যায় না। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত অনেক কলেজে অনার্স ও এমএ কোর্স চালু রয়েছে। পরীক্ষা হয়। পরীক্ষক থাকেন একজনই। এখানে দ্বিতীয় পরীক্ষকের ধারণাই চালু করা হয়নি। তাঁদেরও অনেক ছেলেমেয়ে কর্মজীবনে সফল হচ্ছেন। আর দ্বিতীয় পরীক্ষক না হলে সব ভন্ডুল হয়ে যায়, এমনটা তো নয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে যত ছাত্রছাত্রী অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রি পান, তার চেয়ে বেশি ডিগ্রি পান জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলো থেকে। আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে আলোচনা নিষ্প্রয়োজন। পিএসসি তো কয়েক লাখ পরীক্ষার্থীর মধ্য থেকে প্রিলিমিনারি, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে বাছাই করে দুই হাজারের কিছু অধিক প্রার্থীকে চাকরিতে নিয়োগের সুপারিশ করবে। তাঁদের মেধা যাচাই এমনিতেই হয়ে যায়। বলতে গেলে প্রিলিমিনারিতেই ঝরে যায় তিন লাখের অধিক। এখানে সাধারণ ও বিশেষায়িত ক্যাডারের জন্য দুই ভাগে পরীক্ষাটা নিলে ব্যাপারটা অনেক সহজ হয়ে যেত। বিশেষ ব্যবস্থায় বিসিএসে ডাক্তার নেওয়া হয়েছে। প্রশাসন ক্যাডারেও নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। তাঁরা অভিন্ন হয়ে গেছেন ক্যাডারের মধ্যে। অন্য ক্যাডারের সঙ্গেও তাঁদের কোনো বৈষম্যে পড়তে হয়েছে, এমন নয়। বরং তাঁরা কম সময়ে চাকরিতে যোগ দিতে পেরেছেন। বেশ কিছু বিশেষায়িত ক্যাডারের প্রার্থী প্রিলিমিনারি তাড়াতে পারেন না অভিন্ন মানদণ্ড নির্ধারণের কারণে। অথচ ডাক্তার, প্রকৌশলী, কৃষিবিদ ও শিক্ষকদের পেশাগত জীবনের চাহিদা সাধারণ ক্যাডারের চাহিদা থেকে ভিন্ন। সেখানে নিয়োগে পেশাগত জ্ঞান যথাযথভাবে যাচাই করলেই হয়। সাধারণ ক্যাডারের মতো তাঁদের এখনই ধাঁচের পরীক্ষার কাঠামোয় ফেলা অনাবশ্যক ও সময়ের অপচয়। এটা সংস্কারের জন্য উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো বিষয়ে পরীক্ষকদের একজন থাকেন সে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। শিক্ষার্থীর সংখ্যা সীমিত। সে পরীক্ষকের জবাবদিহি আছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে। সময়মতো খাতা না দিলে সমালোচনা হয়। ইদানীং এ অভিযোগ তেমন একটা আসে না। আর দ্বিতীয় পরীক্ষক হন সাধারণত অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের একই বিভাগের কোনো শিক্ষক। তাঁরা পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। তাই ব্যাপারটি দুরূহ হয়ে পড়ে না। ফল প্রকাশ অতিবিলম্বিত হওয়ার অভিযোগ তেমন একটি নেই। অন্যদিকে পিএসসির আওতায় নেই পরীক্ষকদের একটি বহর। আর সম্ভবও নয় এটা। এখন প্রয়োজন পড়ছে দ্বিগুণ সংখ্যকের। ধার করা পরীক্ষক দিয়ে খাতা দেখালে এ ধরনের বিলম্ব হওয়াই স্বাভাবিক।

বিসিএস পরীক্ষা নেওয়া হয় প্রজাতন্ত্রের সিভিল সার্ভিসে নিয়োগদানের উদ্দেশ্যে। এতে পদের সংখ্যা বেশি থাকে না। তবে প্রার্থীর সংখ্যা থাকে অনেক। তাই সে বাছাইপর্বটি অনেকটাই কঠোর। দিনরাত দীর্ঘদিন পরিশ্রম করে অনেকে প্রিলিমিনারিতেই বাদ পড়ে যান। আর লিখিত ও মৌখিকে তো পড়েনই। তার পরবর্তী ধাপে স্বভাব চরিত্রগত প্রতিবেদনেও ইদানীং কিছু বাদ পড়ছেন। সে পর্ব আজ অনালোচিত থাকুক। পিএসসির হাতে ক্ষমতা মৌখিক পরীক্ষার পর ফলাফল ঘোষণা করে সরকারের কাছে সুপারিশ প্রেরণ করা পর্যন্ত। সাম্প্রতিক কালে তারা প্রশ্নপত্র ফাঁসের মতো একরূপ নিয়মিত ব্যাধি ঠেকাতে পেরেছে। এ সাফল্য কম নয়। তবে বাছাইপর্বের সময়সীমা যত কমবে, তত উপকৃত হবে পরীক্ষার্থী থেকে সরকার। যাঁরা বাদ পড়ে যাবেন, তাঁরা চেষ্টা চালাতে পারবেন অন্য কোনো কর্মসংস্থানের। বাছাইপর্বের বিলম্বে অনেকের সরকারি চাকরির বয়সসীমা চলে যায়। এটা ঠিক, প্রতিবছরই একটি বিসিএস পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হচ্ছে। সরকারের কাছে যাচ্ছে নিয়োগের সুপারিশ। তবে সে পরীক্ষাটি কখনকার, তা দেখলে হতাশ হতে হয়।

আলোচিত ৩৮তম বিসিএস নিয়োগের সুপারিশ হয়তোবা শিগগির যাবে। পরীক্ষাটি ২০১৭-এ বিজ্ঞাপিত। এমনিতেই ঐতিহ্যগতভাবে পিএসসি চাকরিপ্রার্থী বাছাইয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মতো দ্রুত প্রক্রিয়ায় যেতে পারছে না। সেখানে বিজ্ঞপ্তি থেকে নিয়োগ এক বছরই হয়। তবে সুদীর্ঘ বিলম্ব পিএসসি হালে কিছুটা কমিয়ে এনেছিল। কিন্তু আবার পিছু হটল ৩৮তম বিসিএসে। এর প্রধান কারণ লিখিত পরীক্ষার উত্তরপত্র মূল্যায়নে অতিরিক্ত সময় নেওয়া। আর এমনটা হয়েছে প্রধানত দ্বৈত পরীক্ষকের কারণে। ক্ষেত্রবিশেষে তৃতীয় পরীক্ষকও নিশ্চয়ই দরকার হয়েছে। এমনটা এখন অনার্স ও মাস্টার্সে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়েও করে না। পিএসসি পর্যায়েও কখনো হয়নি। তারা মূল্যায়নকে অধিকতর স্বচ্ছ করতে গিয়ে যে অতিরিক্ত সময় নিয়ে ফেলছে, এটা গ্রহণযোগ্য নয়। অতীতের ধারাবাহিকতায় থাকলে যথেষ্ট হয়। অধিকতর নিখুঁতভাবে করতে গিয়ে পরিস্থিতিকে আরও জটিল করা যথোচিত হয়নি। তাই আগের সব বিসিএসের ধারাবাহিকতায় এবং উপমহাদেশের সাধারণ ঐতিহ্য অনুসরণে দুই পরীক্ষক ব্যবস্থা উঠিয়ে দেওয়ার বিষয়টি পিএসসি বিশেষভাবে বিবেচনা করতে পারে।

আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব
[email protected]