পালিত শিশুরা কি সন্তানের অধিকার পায়?

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

সম্প্রতি একজন জেলা প্রশাসক আপাত–পরিত্যক্ত এক মেয়েশিশুর লালনপালনের দায়িত্ব নিয়েছেন। নিঃসন্দেহ তিনি মহৎ হৃদয়ের অধিকারী। তাঁর নিজের একটি মেয়েসন্তান আছে। আশা করা যায়, তাঁর পরিবারে অন্তর্ভুক্ত শিশুটি ভালো থাকবে এবং বিকাশের সুযোগ পাবে। জেলা প্রশাসককে ধন্যবাদ জানিয়ে পত্রপত্রিকায় শুভেচ্ছা জানিয়েছেন অনেকে। তিনি নিশ্চয় শুভেচ্ছার যোগ্য কাজ করেছেন। বেশির ভাগ কাগজে অনলাইনে লেখা হয়েছে জেলা প্রশাসক দত্তক নিয়েছেন। সেটাই প্রচারিত হয়েছে সর্বত্র। প্রকৃত পক্ষে জেলা প্রশাসকের আনুষ্ঠানিক আরজির পরিপ্রেক্ষিতে জেলাটির সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তাঁকে শিশুটির অভিভাবকত্ব প্রদান করেছেন। অভিভাবকত্ব আর দত্তক এক বিষয় নয়। শিশু দত্তক নেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের আইনে কোনো বিধান না থাকায় ১৯৮৫ সালের পারিবারিক আইনের মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি একটি শিশুর দায়ভার নিতে পারেন একজন অভিভাবক হিসেবে। তবে বর্তমানে বাংলাদেশের উচ্চ আদালতের একটি নির্দেশের পর শুধু হিন্দু আইনে হিন্দু পুত্রসন্তানের ক্ষেত্রে দত্তকের বিষয়টি আইনসিদ্ধ। আর বাংলাদেশের খ্রিষ্টধর্মের অনুসারীরাও শুধু অভিভাবকত্ব নিতে পারেন।

আদালতের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিভাবকত্ব দেওয়া–নেওয়া হয়। একাধিক ব্যক্তি অভিভাবকত্বের আবেদন করলে আদালত শিশুর সর্বোচ্চ স্বার্থ ও কল্যাণের কথা বিবেচনা করে যাকে উপযুক্ত মনে করবেন, তাঁকেই অভিভাবকত্ব দেবেন। আলোচ্য ক্ষেত্রে অভিভাবকত্বের আরজি আরও অনেকেই জানিয়েছিলেন, তবে আদালত যাঁকে উপযুক্ত মনে করেছেন, তাঁর আরজি আমলে নিয়েছেন। একটি জেলা শহরে জেলা প্রশাসকের চেয়ে উপযুক্ত আবেদনকারী আর কে হতে পারেন? সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। দত্তক ব্যবস্থা রহিত করে অভিভাবকত্বের আইন চালু রেখে আদতে শিশুরা আরও বেশি বিপন্নতার শিকার হচ্ছে কি না, তা–ও দেখা প্রয়োজন।

দত্তক, অভিভাবক প্রভৃতি যে নামেই আমরা বিষয়টি উপস্থাপন করি না কেন, আসলে আমরা একটি মানবশিশুকে প্রতিপালনের জন্য নিই। পালক মা–বাবা হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। গবাদি প্রাণীর ক্ষেত্রেও পালতে নেওয়ার বিষয়টি গ্রামবাংলার কৃষি উৎপাদন ও সমাজব্যবস্থার একটা অংশ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই ব্যবস্থাকে বর্গা দেওয়া বর্গা নেওয়া বলা হয়। গবাদি প্রাণী যিনি পালতে দেন, তিনি শর্ত ঠিক করেন, পালতে নেওয়া মানুষটি আর্থিকভাবে একটু কমজোর থাকেন। মানবশিশুর ক্ষেত্রে ব্যাপারটা (বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া) উল্টো। যিনি পালতে নেন তিনি সবকিছু ঠিক করেন। ঠিক করেন শিশুর ভূত–ভবিষ্যৎ। পালতে নেওয়া মা–বাবা প্রথমেই শিশুর অতীতটা মুছে ফেলতে চান। নবজাতক শিশুর অতীত মানে তার জন্মদাতাদের কমপক্ষে জন্মদাত্রী মায়ের পরিচয়। এটা জানা শিশুর অধিকার। শিশুর কাছে তার ‘বায়োলজিক্যাল প্যারেন্ট’–এর তথ্য গোপন রাখা যাবে না। বড় হয়ে সে জানতে চাইলে তাকে সঠিক তথ্য জানাতে হবে। দাবিদারবিহীন কোনো শিশু পাওয়া গেলে তাকে সুরক্ষার জন্য সমাজকল্যাণ দপ্তরের সুনির্দিষ্ট কিছু দায়দায়িত্ব আছে। শিশুটিকে যে ফেলে গেছে বা শিশুটির মা–বাবা অথবা আত্মীয়স্বজনকে খুঁজে বের করা প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট শাখার (পুলিশ) দায়িত্ব। আলোচ্য শিশুটির ক্ষেত্রে সে রকম কোনো জোরদার খোঁজ–তল্লাশির খবর কেউ শোনেনি।

আইনি সুরক্ষা থাক বা না থাক, দিন দিন সন্তান পালতে নেওয়ার চাহিদা বেড়েই চলেছে। বছর কয়েক আগে এর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক এ আই মাহবুব উদ্দিন আহমেদ বলেছিলেন, আধুনিক সমাজে সন্তান দত্তক নেওয়ার কারণ মনস্তাত্ত্বিক ও আবেগের। ত্রিশ থেকে চল্লিশ বছরের দিকে গিয়ে সন্তান ধারণের সম্ভাবনা না থাকলে নিঃসঙ্গতা কাটাতে সন্তান দত্তক নেওয়ার কথা ভাবছে মানুষ। তাঁর মতে, ‘শিল্পভিত্তিক সমাজে যেসব সমস্যা তার প্রত্যক্ষ প্রভাবে নানা শারীরিক জটিলতায় আক্রান্ত হয়ে অনেক নারী গর্ভধারণ করতে পারছেন না। দীর্ঘদিন ধরে জন্মবিরতিকরণ বড়ির প্রভাব, রাসায়নিক মিশ্রিত খাবার, জরায়ুর ক্যানসারসহ বিভিন্ন কারণে বন্ধ্যত্ব বাড়ছে। ফলে এ কারণেও বাংলাদেশে দত্তক নেওয়ার বিষয়টি দিন দিন বাড়ছে।‌’

তার মানে, মানবশিশু পালতে নেওয়া পালতে দেওয়ার একটা বিকাশমান বাজার আছে। সেই বাজারের চাহিদা মেটাতে অভিভাবকত্বের আইনি ছায়ায় ‘দত্তক’ চলছে। শুধু শিশু হারিয়েছে তার অধিকার। কারণ, আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অভিভাবকত্বের একটা রফা হলেও শিশু উত্তরাধিকার সূত্রে পালক মা–বাবার কোনো সম্পত্তি পায় না। আইন সেটা তাকে দাবিও করতে দেয় না। বঙ্গবন্ধু এই সমস্যার একটা সমাধান দিয়ে গিয়েছিলেন দেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন সব শিশুরই একটা পরিবার, একটা গৃহ পাওয়ার অধিকার আছে।

একাত্তরে স্বাধীনতাযুদ্ধে আর পাকিস্তানের দখলদার বাহিনীর নির্বিচার গণহত্যায় লাখ লাখ মানুষের অকাল মৃত্যু হয়। ফলে অনাথ শিশুর সংখ্যা দাঁড়ায় অনেক। এসব শিশু আর যুদ্ধশিশুদের রক্ষার বিষয়টি বঙ্গবন্ধু আমলে নিয়েছিলেন। পাকিস্তানের কারাগার থেকে দেশে ফিরে আসার পর ১৯৭২ সালে একটি বিশেষ আইন প্রণয়নের ব্যবস্থা করেছিলেন। সেই আইনে এতিম আর পরিত্যক্ত শিশুদের দত্তক নেওয়াকে আইনসিদ্ধ করা হয়েছিল। এই বিশেষ আইনের সুবাদে অনেক ভাগ্যহীন শিশু প্রকৃত সন্তানের অধিকারসহ বাঁচার ও বিকশিত হওয়ার পরিবেশ ও পরিবার পায়। দুর্ভাগ্যের বিষয়, জেনারেল এরশাদ ১৯৮২ সালে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করার পর আইনটি রদ করে এক ফরমান জারি করেন। তাঁর অজুহাত ছিল শিশু পাচার বা ধর্মান্তর বন্ধ করা। এরশাদের সেই ফরমান আজও জারি আছে। ১৯৮২ সালে দত্তক নেওয়ার আইন বাতিল হওয়ার আগ পর্যন্ত বহু পরিত্যক্ত শিশুকে এই আইনের আওতায় দত্তক দেওয়া হয়েছিল। এখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই দত্তক মানেই আনুষ্ঠানিকভাবে প্রাকৃতিক সন্তানের মতো উত্তরাধিকার পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন।

এরশাদের ফরমানের ফলে বাংলাদেশে আইনত শিশু দত্তক যেমন নেওয়া যায় না, তেমনি কোনো বিদেশি নাগরিকও বাংলাদেশের কোনো শিশুর অভিভাবক হতে পারে না। তা ছাড়া, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক শিশু অধিকার সনদের স্বাক্ষরকারী দেশ হলেও শিশু দত্তক–সংক্রান্ত ধারাটিতে অনুস্বাক্ষর করেনি। ফলে পালক মা–বাবার মৃত্যুর পর পালক সন্তানদের এক কাপড়ে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার ঘটনা ঘটছে অনেক।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শাহনাজ হুদা অনেক দিন থেকে এ বিষয়ে কাজ করছেন। তাঁর মতে, ‘এটা একটি বিরাট সমস্যা।’ পালক মা–বাবার মৃত্যুর পর তাঁদের আত্মীয়রা এসে যদি সম্পত্তি থেকে ওই সন্তানকে বঞ্চিত করেন, তাহলে আইনত তার কিছুই করার থাকে না। তিনি গবেষণা করে দেখেছেন মূলত সম্পত্তির অধিকার প্রশ্নেই সমস্যা শুরু হয়। দান কিংবা অসিয়ত করা গেলেও এই উত্তরাধিকারের প্রশ্নেই সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে অনেক পরিবারে। ১৯৭২ সালের বিশেষ আইন শিশুদের পক্ষে ছিল। আশা করি মুজিব শতবর্ষে এসব শিশুর অধিকার রক্ষায় নতুন কিছু হবে।

সম্ভবত ২০১৩ সালে আইন কমিশন পৃথক একটি দত্তক আইন প্রণয়নের জন্য সুপারিশ করেছিল। জানা গিয়েছিল, সরকারও এ বিষয়ে একটি বিধি প্রণয়নের কথা ভাবছিল। সে সময় সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব ছিলেন নাছিমা বেগম, (বর্তমানে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান)। তখন তিনি বলেছিলেন, বর্তমানে শিশু আইনের আওতায় বিকল্প যত্ন বা পরিচর্যার নীতির আলোকে তাঁরা এই বিধি করতে যাচ্ছেন। বলেছিলেন, ‘আমরা মনে করি, শিশু নিবাসের চাইতে একটি পরিবারে মা–বাবার আদরে একটি শিশু বড় হলে তা ভালো হবে। তাই আমরা বিষয়গুলো সহজ করার কথা ভাবছি।’

তারপর কি কিছু করা হয়েছে? পালিত শিশুরা সন্তানের মর্যাদা ও অধিকার পাবে—এমন আইনি ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। 

পুনশ্চ: যাঁরা শিশু পালতে নেন, শিশুটির কল্যাণের স্বার্থে তাঁদের উচিত এ বিষয়ে গোপনীয়তা রক্ষা করা। ফেসবুকে বা অন্যান্য মাধ্যমে শিশুটির ছবি প্রকাশ করা, তার সঙ্গে সেলফি তোলা ইত্যাদি তার ভবিষ্যতের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।

গওহার নঈম ওয়ারা: লেখক ও গবেষক
[email protected]