পানির মূল্যবৃদ্ধি

আওয়ামী লীগ সরকারের এক দশকের শাসনে তৃতীয়বারের মতো পানির দাম বাড়ানোর একটি উদ্বেগজনক উদ্যোগ নিয়েছে ঢাকা ওয়াসা। ২০০৯ সালে প্রতি ইউনিট (এক হাজার লিটার) পানির দাম ছিল মাত্র ২০ টাকা। ২০১৭ সালে আওয়ামী লীগ পানির দাম আবাসিক ও বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে যথাক্রমে ২২ ও ১৮ শতাংশ বৃদ্ধি করে। তিন বছর না যেতেই ওয়াসা আবাসিকে বর্তমানের ১১.৫৭ টাকার পরিবর্তে ২০ টাকা এবং বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে বর্তমানের ৩৭.০৪ টাকার পরিবর্তে ৬৫ টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে।

ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক দাবি করেছেন, সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য এ–সংক্রান্ত নথি বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে রয়েছে। পানির মতো একটি সংবেদনশীল সেবা খাতে যথেষ্ট দাম বাড়ানোর পদক্ষেপ কার্যকর করা হলে তাতে যে সাধারণ মানুষের কষ্টের বোঝা বাড়বে, সে বিষয়ে তো সন্দেহ নেই। আমরা আশা করব, শুধু পানি নয়, বিদ্যুৎ বা গ্যাস যেখানে সামান্য দাম বাড়ালেই বিত্তহীন বা স্বল্প আয়ের মানুষের ভোগান্তি বাড়ে, সেসবের দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে জনগণের সামর্থ্যের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেওয়া হবে।

তবে আমরা নিশ্চয় বাস্তবতা অস্বীকার করতে পারি না। কিন্তু ঢাকা ওয়াসার এমডি যেভাবে দাম বাড়ানোর পক্ষে যুক্তি দিয়েছেন, তা অবশ্যই পরীক্ষা-নিরীক্ষার দাবি রাখে। ওয়াসার আধুনিকায়নে বিরাট বিনিয়োগ এবং পরিচালনগত ব্যয় বৃদ্ধির কারণে পুনরায় পানির দাম বাড়ানোর যুক্তি সব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারেরা যন্ত্রের মতো উচ্চারণ করেন। তিনি বড় গলায় দাবি করেছেন যে, ‘আমরা সিস্টেম লস কমিয়েছি। সেবার আধুনিকায়ন করেছি। সুতরাং দাম অবশ্যই বাড়াতে হবে।’ প্রাপ্ত তথ্য ও বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে পরিষ্কার যে তঁার এই দাবির ভিত্তি যথেষ্ট দুর্বল এবং এমনকি কার্যত সত্যের অপলাপ।

 গত বছরেই ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের সমীক্ষায় দেখা যায়, প্রায় ৪৫ শতাংশ মানুষ ওয়াসার তরফে দরকারি পরিমাণ পানি পায় না। আবার খারাপ মানের পানি সরবরাহের বিষয়ে প্রায় ৩৫ ভাগের অভিযোগ ছিল। উপরন্তু ওয়াসার প্রতি মানুষের আস্থা এতটাই ঠুনকো যে তাঁরা ওয়াসার পানিকে সুপেয় ও নিরাপদ মনেই করেন না। তার অকাট্য প্রমাণ ৯১ শতাংশ গ্রাহক ওয়াসা থেকে কেনা পানি ফুটিয়ে পান করতে বাধ্য হন। এই রকম একটি বাস্তবতার মুখে দাঁড়িয়ে ওয়াসার এমডির সেবার মান উন্নত ও আধুনিকায়নের দাবি চূড়ান্ত বিচারে গ্রহণযোগ্য নয়। নগরীর কিছু অংশে ওয়াসা তার সেবার মান উন্নত করতে পারে, কিন্তু তাকে সার্বিক বিবেচনায় উল্লেখযোগ্য বলার সুযোগ কম।

এটা ইতিবাচক যে ওয়াসার দাম বাড়ানোর প্রস্তাবের প্রেক্ষাপটে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় দিল্লি, কলকাতা, কাঠমান্ডু, সিউলসহ কিছু শহরের পানির দামের তথ্য দিতে বলেছে। তুলনামূলক মূল্যায়নের এ দৃষ্টিভঙ্গিকে আমরা স্বাগত জানাই। কিন্তু পানির দাম বাড়ানোর চলমান একান্ত নির্বাহী প্রক্রিয়ার পরিবর্তে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম পুনর্মূল্যায়নের মতো গণশুনানিনির্ভর ব্যবস্থা চালু করার জন্য আমরা গুরুত্বারোপ করছি। ভোক্তা সংগঠন ক্যাবও কয়েক বছর ধরে এ দাবি জানিয়ে আসছে।

আমরা মনে করি, দাম যদি একান্ত বাড়াতেই হয়, তাহলে সেটা যেন জনগণের উন্মুক্ত অংশগ্রহণনির্ভর উপায়ে করার প্রথা চালু করা হয়। জবাবদিহি বাড়ানোর এমন উদ্যোগই প্রত্যাশিত।