জুরাছড়িতে স্বেচ্ছাশ্রমে কলেজ

দেশের সরকার ও বৃহত্তর সমাজ পাহাড়ের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষকে ‘প্রকৃতিঘনিষ্ঠ, ‘সরলপ্রাণ’—ইত্যাকার বিচিত্র কাব্যিক অভিধায় অভিহিত করে দিন শেষে পর্যটকের ক্যামেরাকলুষিত চোখের ‘দর্শনীয় বস্তু’ বানিয়ে রাখতে ও বঞ্চনার শৃঙ্খলে আটকে রাখতে কার্যত বেশি আগ্রহী। কে না জানে শিক্ষাবঞ্চনার মতো বড় বঞ্চনা আর নেই? অথচ সেই বঞ্চনার জালে যুগের পর যুগ পাহাড়ি মানুষকে আটকে রাখা হয়েছে। তাদের জন্য পর্যাপ্ত স্কুল-কলেজের ব্যবস্থা করা হয়নি।

আশার কথা, পাহাড়ের লোকজন এখন শিক্ষার মূল্য এতটাই উপলব্ধি করতে পারছেন যে তাঁরা সরকারের অনুগ্রহ-অনুকম্পার আশায় বসে না থেকে নিজেরাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছেন। সর্বশেষ, রাঙামাটির জুরাছড়ি উপজেলায় এ রকম একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন সেখানকার স্থানীয় ব্যক্তিরা।

প্রথম আলোর একটি প্রতিবেদন বলছে, এই উপজেলায় কোনো কলেজ নেই। এখানকার কেউ এসএসসি পাস করার পর উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে পড়তে গেলে তাকে রাঙামাটি জেলা শহরে গিয়ে সেখানকার কলেজে ভর্তি হতে হবে। দিনে গিয়ে দিনেই ফিরে আসা সম্ভব নয় বলে রাঙামাটিতে তাকে থাকতেই হবে। এই উপজেলার বেশির ভাগ মানুষের, বিশেষত পাহাড়ি মানুষের পক্ষে সন্তানকে জেলা শহরে রেখে পড়াশোনা করানোর আর্থিক সংগতি নেই। ফলে এসএসসি পাস করেও আর কলেজে যেতে পারেননি এমন তরুণের সংখ্যা এখানে দিন দিনই বাড়ছে।

এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে উপজেলার কয়েকটি গ্রামের বাসিন্দারা স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে একটি কলেজ নির্মাণ করছেন। উপজেলার বনযোগীছড়া গ্রামে কলেজ বানানোর জন্য এলাকার একজন হেডম্যান ৮০ শতক জমি দান করেছেন। ওই জমিতে শিক্ষাদানের জন্য বাঁশের বেড়া ও টিনের ঘর নির্মাণের কাজ শুরু করেছেন গ্রামবাসী। উদ্যোগের সঙ্গে জড়িত হয়েছেন এলাকার শিক্ষানুরাগী সর্বস্তরের লোকজন। স্বেচ্ছাশ্রমে এ কাজে অংশ নিচ্ছেন তিন শতাধিক মানুষ। এ ছবির মধ্য দিয়ে পাহাড়ি মানুষের প্রত্যয় ও তাঁদের প্রতি সরকারের অবহেলার বিষয়টি যুগপৎভাবে উঠে এসেছে।

সরকার যেখানে শিক্ষাবিস্তারে নানা উদ্যোগ নিচ্ছে, সেখানে একটি উপজেলায় একটিও কলেজ থাকবে না এবং শুধু কলেজ না থাকার কারণে সেখানকার শত শত ছেলে মেয়ে উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হবে—এটি অন্তত এই সময়ে এসে মেনে নেওয়া কঠিন।

সরকারের মনে রাখা দরকার, ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোকে শিক্ষার আলো থেকে দূরে রেখে স্রেফ প্রদর্শনযোগ্য সমাজ বানিয়ে রাখা শিক্ষানুরাগের চেতনা প্রতিফলিত করে না। গোটা জাতিকে শিক্ষিত করে তুলতে হলে পাহাড়িদের উচ্চশিক্ষার বিষয়টিকে উপেক্ষা করলে চলবে না।