নদী রক্ষা মহাপরিকল্পনা

নদী রক্ষা নিয়ে ঘোষিত মহাপরিকল্পনা আমাদের অত্যন্ত সতর্কভাবে আশাবাদী করছে। কারণ, ঠিকঠাক মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারার নজির এই দেশে যেমন কম, তেমনি সেটা যথাসময়ে ঠিকঠাক বাস্তবায়ন করার নজির আরও দুর্লভ। এর ওপরে বিষয়টি যখন নদী ও জলাশয় রক্ষা বা পুনরুদ্ধারের মতো বিষয় হয়, তখন তাতে আরও বেশি উদ্বেগ ও সংশয় দেখা দেয়। কারণ, সারা দেশে প্রায় ৫০টি নদীর অবৈধ দখলদার চিহ্নিতকরণে জেলা প্রশাসন যতটা সাফল্যের ছাপ রেখেছে, দখলদারদের উচ্ছেদে তার ছিটেফোঁটাও নেই।

নদীর অবৈধ দখলদারেরা স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী এবং তার সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যুক্ততা রয়েছে। সুতরাং নদী ও জলাশয়কে কার্যকরভাবে দখলদারমুক্ত করতে ও সেই অবস্থা বজায় রাখতে হলে শুরুতেই যে ঘাটতি দূর করা উচিত তা হচ্ছে রাজনৈতিক নির্দেশনা।
নদী বাঁচানোকে সরকারি দল আওয়ামী লীগের একটি অগ্রাধিকারভিত্তিক দলীয় কর্মসূচিতে পরিণত করতে হবে। এ বিষয়ে একটি কেন্দ্রীয় নির্দেশনা থাকতে হবে। এর সুফল দুটি। দলের সঙ্গে যুক্ত থাকা দখলদারেরা নিরুৎসাহিত হবেন এবং প্রশাসন ও বিভিন্ন বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা পরিষ্কার বার্তা পাবেন।

স্থানীয় সরকারমন্ত্রীর নেতৃত্বে ২৫ সদস্যের একটি আন্তমন্ত্রণালয় ও সংস্থার সমন্বয়ে গঠিত কমিটিকে নদী মহাপরিকল্পনার বাস্তবায়ন ও তদারকির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর এই পদক্ষেপে একটি রাজনৈতিক নির্দেশনার ছাপ মিলছে। বর্তমান সরকারের আমলে
নদী রক্ষা কমিশন প্রতিষ্ঠা এবং কমিশনের একটি সক্রিয় ভূমিকা কিছুটা স্বস্তিদায়ক। তবে দুর্ভাগ্যজনক বাস্তবতা হচ্ছে, এই কমিশনকে একটি শক্তিশালী ও কার্যকর তদারকি সংস্থা হিসেবে মেনে নেওয়ার সংস্কৃতি এখনো তৈরি করা যায়নি।

এ রকম পটভূমিতে নদীর সীমানা, বিশেষ করে ঢাকা ও চট্টগ্রামের নদীগুলোর সীমানা ২০২২ সালের মধ্যে এবং বর্জ্য নিঃসরণকারী কারখানাগুলোকে আরও ৪ বছর পরে অর্থাৎ ২০২৬ সাল থেকে স্থানান্তরের যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে তা কতটা বাস্তবায়নযোগ্য, সেই প্রশ্নটি চলে আসে। ব্যাপক সামাজিক আন্দোলন, গণমাধ্যমের সর্বাত্মক ভূমিকা, সেই সঙ্গে সর্বোচ্চ আদালতের ধারাবাহিক কড়া নির্দেশনা সত্ত্বেও হাজারীবাগের ট্যানারি স্থানান্তরের দীর্ঘসূত্রতার বিষয়টি আমরা দেখেছি। ট্যানারি সাভারে স্থানান্তরের পর কর্তৃপক্ষের অদক্ষতা, দায়সারা কাজ ও অনিয়মের কারণে তা প্রকারান্তরে দ্বিতীয় বুড়িগঙ্গার জন্ম দিচ্ছে।

নদী বাঁচাও আন্দোলনে সরকারের নির্বাহী বিভাগের অব্যাহত ব্যর্থতার কারণেই সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হাইকোর্ট একাধিক জনস্বার্থ-সংশ্লিষ্ট মামলায় সময়সীমা নির্ধারণ করে আদেশ দিয়েছেন। নদীকে ‘আইনগত ব্যক্তি’ এবং ‘জীবন্ত সত্তা’ ঘোষণা এবং নদী দখলকারীদের নির্বাচনে অযোগ্য ও ঋণলাভে অযোগ্য ঘোষণা করেছেন। এ ধরনের আদেশ বাস্তবায়ন রাজনৈতিক নির্দেশনা ছাড়া অর্জন করা কঠিন হবে।

নদীর জমি উদ্ধারে অনেক ভালো আইন আছে। কিন্তু তার প্রয়োগে বিরাট ঘাটতি চলছে। এই মুহূর্তে সব থেকে জরুরি পাকাপাকিভাবে নদীর সীমানা চিহ্নিতকরণ এবং নদীর প্লাবন ভূমি নির্ধারণ করা। এই দুটি কাজের সঙ্গে দখলদার নির্ধারণ ও তাদের উচ্ছেদের বিষয় ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মহাপরিকল্পনায় আগামী বছরের মধ্যে সীমানা চিহ্নিতকরণ শেষ করার লক্ষ্য স্থির করা হয়েছে। অথচ পানি উন্নয়ন বোর্ড এখন পর্যন্ত ২০১৩ সালের পানি আইনের ২১ ধারা অনুযায়ী ‘প্লাবন ভূমি’ নির্ধারণের কাজই শুরু করেনি। এ ধরনের পরিস্থিতির অবসান জরুরি।