বিমাশিল্পে সংস্কারের প্রত্যাশা

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

২০০৪ সালের এক পড়ন্ত বিকেল। বসা ছিলাম তখনকার অর্থমন্ত্রী প্রয়াত এম সাইফুর রহমানের সামনে। ফোনে তিনি কারও সঙ্গে বাংলাদেশের বিমা খাতের অবস্থা নিয়ে কথা বলছিলেন। তাঁর দেহ-ভাষা বুঝে আমার ধারণা হলো, তিনি দেশের বিমাশিল্প কোন দিকে যাত্রা করছে, সে সম্পর্কে নিশ্চিত নন। যখনই তাঁর ফোনের আলাপ শেষ হলো, তখনই তাঁকে এক অনাহূত পরামর্শ দিলাম। বললাম, আমাদের বিমা খাত থাকা উচিত অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে নয়। সাইফুর রহমানকে যাঁরা জানেন, তাঁরা অনাহূত কোনো পরামর্শের প্রতি তাঁর গুরুত্ব না দেওয়ার অভ্যাসটি সম্পর্কেও ওয়াকিবহাল। কিন্তু কোনো অজানা কারণে তিনি আমার কথা শোনার সিদ্ধান্ত নিলেন। আমি ভারতসহ পূর্ব এশিয়ার কিছু দেশের উদাহরণ টেনে বললাম, সেখানে সার্বিক আর্থিক খাত, বিশেষ করে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির পরিসর বাড়াতে বিমা খাত কীভাবে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বিমাব্যক্তিত্ব শামসুল আলমকে বিমা খাতের সার্বিক গতি-প্রকৃতি পর্যালোচনা করে ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা নির্ধারণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। ওই পর্যালোচনার নিরিখে গঠিত কমিটি সুনির্দিষ্ট কিছু সুপারিশও করেছিল। তাদের ওই সুপারিশ ও উন্নয়ন–সহযোগীদের পৃষ্ঠপোষকতায় বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) গঠন করা হয়, যা কার্যকর হয় বর্তমান সরকারের আমলে।

বিমা করপোরেশন আইন (ষষ্ঠ) অনুসরণে ১৯৭৩ সালের ১৪ মে সাধারণ বীমা ও জীবন বীমা নামে দুটি করপোরেশন প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৮৪ সালে সরকার প্রথমবারের মতো ব্যক্তি খাতকে বিমার সব ক্ষেত্রে ব্যবসার অনুমতি দেয়। এখন বিমাবাজার ৭৮টি কোম্পানির মধ্যে সীমাবদ্ধ। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত দুটি (সাধারণ বীমা ও জীবন বীমা করপোরেশন) আর ব্যক্তি খাতে ৪৬টি সাধারণ ও ৩২টি জীবনবিমা রয়েছে। ৪৭টি বিমা কোম্পানি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত এবং এর মধ্যে ১২টি জীবনবিমা কোম্পানিও রয়েছে। 

নিয়ন্ত্রক সংস্থার কিছু প্রাথমিক আপত্তি সত্ত্বেও সরকার ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত লাইফ ইনস্যুরেন্স করপোরেশনকে এখানে ব্যবসা করার লাইসেন্স দিয়েছে। জাপানের তাইও লাইফ ইনস্যুরেন্সকে লাইসেন্স দেওয়া হলেও তারা শেষ পর্যন্ত আসেনি। যুক্তরাজ্যের প্রুডেনশিয়াল লাইফ ইনস্যুরেন্স প্রাথমিকভাবে উৎসাহ দেখালেও পরবর্তী কালে অনুমোদন চায়নি। গ্রিন ডেল্টা জেনারেল ইনস্যুরেন্সের সম্পৃক্ততায় অর্থ মন্ত্রণালয় একটি সুনির্দিষ্ট জেলায় মানুষকে হেলথ কার্ডের আওতায় আনতে একটি পাইলট কর্মসূচি শুরু করেছে। মাইক্রো-ইনস্যুরেন্স বিষয়েও আলোচনা সরব আছে। কিন্তু আলোচ্য বিষয়টি এখনো তেমন একটা এগোয়নি।

জীবন ও সাধারণ বিমা মিলিয়ে এখনো বাংলাদেশের বিমাবাজারের পরিসর তেমন বড় নয়, সর্বসাকল্যে প্রিমিয়াম আয় ১২ হাজার ৯৩৬ কোটি টাকা। বিশ্বে বিমাশিল্পে আমাদের অবস্থান ৬৬তম। বলতে গেলে, বৈশ্বিক বিমাশিল্পের তুলনায় বাংলাদেশের বিমাশিল্প খুবই নগণ্য—দশমিক শূন্য তিন (০.০৩) শতাংশ মাত্র। এখানে মাথাপিছু বিমা ব্যয় কেবল ২ দশমিক ৬ মার্কিন ডলার। জিডিপি অনুপাতে বিমা প্রিমিয়াম রয়ে গেছে মাত্র দশমিক ৯ শতাংশে। এর মধ্যে দশমিক ৭ শতাংশ জীবনবিমা এবং বাকি দশমিক ২ শতাংশ সাধারণ বিমা। গত কয়েক বছরে সাধারণ বিমার গড় প্রবৃদ্ধি ছিল ১২ শতাংশ। আর জীবনবিমার গড় প্রবৃদ্ধি ছিল ২৬ শতাংশ। 

সাধারণ বিমার ৩৬ শতাংশই শীর্ষ চার কোম্পানি বা করপোরেশনের দখলে। জীবনবিমার ২৯ দশমিক ৬৪ শতাংশই বিদেশি কোম্পানি মেটলাইফের দখলে। দেশে ৫৯টি বাণিজ্যিক ব্যাংক থাকলেও তাদের এখনো ব্যাংকাস্যুরেন্স (ব্যাংক ও বিমা কোম্পানি অংশীদারত্বের মাধ্যমে কোনো বিমা প্রোডাক্ট বিক্রি) বিক্রির অনুমতি দেওয়া হয়নি। সম্প্রতি বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের গবেষণা শাখা ব্যাংকাস্যুরেন্সের একটি খসড়া গাইডলাইন প্রকাশ করে। ব্যাংকাস্যুরেন্সের বিভিন্ন দিক এবং দায়বদ্ধতা খসড়া আকারে এতে প্রকাশ করা হয়। ইনস্যুরেন্স কোম্পানি একাধিক ব্যাংককে এজেন্ট হিসেবে নিয়োগ দিতে পারলেও একটি ব্যাংক কেবল একটি ইনস্যুরেন্স কোম্পানির এজেন্ট হতে পারবে। ব্যাংকাস্যুরেন্সের কার্যকারিতা বা সুফল পাওয়ার জন্য একটি ব্যাংকের একাধিক ইনস্যুরেন্স কোম্পানির এজেন্ট হওয়ার সুযোগ থাকা প্রয়োজন। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সতর্কতার সঙ্গে ব্যাংকাস্যুরেন্স চালুর পরিকল্পনা করছে, যাতে ব্যাংকগুলো অতিরিক্ত ঝুঁকির মুখে না পড়ে। প্রথম পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত ব্যাংক এবং ইনস্যুরেন্স কোম্পানির মাধ্যমে চালুর চিন্তাভাবনাও রয়েছে।

বৈশ্বিক বিমাবাজারে মন্দাবস্থা দেখা দিলেও বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে এর দৃশ্যমান প্রবৃদ্ধি লক্ষ করা গেছে। শিল্পায়িত দেশে জীবনবিমায় ৩ দশমিক ৫ ও সাধারণ বিমায় ৬ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ছিল। অবশ্য বাংলাদেশে জীবনবিমায় ৭ দশমিক ৯ এবং সাধারণ বিমায় প্রবৃদ্ধি ছিল ১২ দশমিক ৮ শতাংশ।

গেল বছরগুলোয় ব্যক্তি খাতের জীবনবিমায় প্রিমিয়াম আয় বৃদ্ধি ও নবায়ন সম্ভব হয়েছে দেশে সুজন, গৃহ সঞ্চয়, গণ, গ্রামীণ, লোক, জন, পল্লি, ইসলামি, ক্ষুদ্র, গ্রুপ ও ওয়েজ আর্নার্স গ্রুপ বিমার মতো ক্ষুদ্র বিমা প্রবর্তনে জীবনবিমা ব্যবসা বৃদ্ধির মাধ্যমে। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানির মোট সম্পদের পরিমাণ ছিল ২৬ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানির মোট সম্পদের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩৮ হাজার ৭১০ কোটি টাকা। একই সময়ের নন–লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানির মোট সম্পদের পরিমাণ দাঁড়ায় ১১ হাজার ২৯৩ কোটি টাকা।

২০১৪ সালে লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানির মোট বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ১৮ হাজার ৪১১ কোটি টাকা। ২০১৮ সালে এটি দাঁড়ায় ৩১ হাজার ৮১ কোটি টাকা। একই সময়ে নন-লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানির মোট বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়ায় ৫ হাজার ৯৮৯ কোটি টাকা। ২০১৮ সালের লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানির মোট প্রিমিয়াম আয় দাঁড়ায় ৮ হাজার ৯৯২ কোটি টাকা। একই সময়ে নন-লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানির মোট প্রিমিয়াম আয় দাঁড়ায় ৩ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা।

যদিও গত কয়েক বছরে বিমা কোম্পানির সংখ্যা বেড়েছে, তবে অধিকাংশ কোম্পানিই এখনো টিকে থাকার লড়াই করছে। কিছু জীবনবিমা কোম্পানি পল্লি বা মফস্বল এলাকায় নিজেদের অনেক শাখা বন্ধ করে দিয়েছে এবং নতুন প্রতিষ্ঠিত অধিকাংশ শাখা এখন প্রায় নিবু নিবু। এটা নিশ্চিত যে ভবিষ্যতে বৈশ্বিকভাবে প্রতিষ্ঠিত বিমা কোম্পানির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে অধিকাংশ ছোট ও অসংগঠিত কোম্পানির পরিচালনা ক্রমেই কঠিন হবে। বহির্বিশ্ব বিশেষ করে প্রতিবেশী দেশ কিংবা অন্য একই ধরনের দেশে যা ঘটছে, তা বিবেচনায় নিলে আমাদের বিমা খাতের আরও দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে। 

প্রিমিয়াম সংগ্রহ, পুনর্বিমা, দাবি নিষ্পত্তিসহ কিছু বিষয়ে বড় দুর্নীতির অভিযোগ আছে। অনেক মালিকই মিথ্যা দাবি সাজিয়ে পূর্বতন তারিখে কাভার নোট ইস্যু এবং অন্য অন্যায্য প্রভাবের মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট বিমা গ্রাহকের অর্থ আত্মসাৎ করছে। সেখানে অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য, পরিচালক কর্তৃক ম্যানিপুলেশন এবং নিয়ন্ত্রণহীনতার অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে। বিমাশিল্পে জনশক্তির মান খুবই দুর্বল এবং তাদের উন্নয়নে তেমন বিনিয়োগ কিংবা সংশ্লিষ্ট মহলের নজর দৃশ্যমান নয়। এমনকি কিছু কোম্পানির কর্তারা তাঁদের ইচ্ছানুযায়ী কাজ না করায় রাজনৈতিক মহলের যোগসাজশে নিয়ন্ত্রকদের হয়রানি বা বিব্রত করারও চেষ্টা করেছেন। গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী জীবনবিমা ও সাধারণ বিমা কোম্পানির পরিচালনায় ব্যাপক অনিয়ম পাওয়া গেছে। প্রবাসী শ্রমিক-রেমিট্যান্স প্রেরণকারী থেকে কৃষিজীবীসহ বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠী এখনো বিমার আওতার বাইরে রয়ে গেছে।

আশার কথা হচ্ছে, বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় বাংলাদেশ বিমা খাত উন্নয়ন শীর্ষক একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের পথে। এর আওতায়
বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞের সহায়তায় বিমাশিল্পের আধুনিকায়নসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড হাতে নিয়েছে।
ওই প্রকল্প যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশের বিমা খাতে অনেক পরিবর্তনের সূচনা আশা করা যায়।

মামুন রশীদ অর্থনীতি বিশ্লেষক