বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্য যৌথভাবে কাজ করতে পারে

অস্ট্রেলিয়ার দাবানল থেকে মস্কোতে তুষারপাতের অনুপস্থিতি পর্যন্ত প্রতিদিনের সংবাদ শিরোনাম আমাদের জলবায়ু পরিবর্তনের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে বিজ্ঞানসম্মত প্রমাণ আজ আগের থেকেও বেশি শক্তিশালী। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ, এর প্রভাব ও সমাধানের ক্ষেত্রেও এই বিজ্ঞানসম্মত প্রমাণের ভিত্তি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। 

বাংলাদেশ তিনটি প্রধান নদীর বদ্বীপে অবস্থিত একটি দেশ, যার জনসংখ্যার ঘনত্ব অনেক। এই বিশেষ সমন্বয় বাংলাদেশকে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বিশ্বের অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ দেশে পরিণত করেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট বিপর্যয় ও চাপের অধিক ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশের হতদরিদ্র, নারী ও শিশুরা। উল্লেখ্য, এ দেশের জনসংখ্যার ৭০ শতাংশের বেশি ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে, যার অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতিও অনেক।

এসব ঝুঁকি নিয়েই বাংলাদেশ গত দশকে প্রাকৃতিক দুর্যোগের মোকাবিলার জন্য প্রস্তুতি এবং দুর্যোগের প্রভাব প্রশমনে দৃষ্টান্তমূলক অগ্রগতি দেখিয়েছে। তবে এখনো আরও অনেক করণীয় আছে। আমাদের কাছে জলবায়ু পরিবর্তনের অর্থ, ২০৫০ সালের মধ্যে বন্যা, খরা এবং ঘূর্ণিঝড়ের মতো দুর্যোগের পুনরাবৃত্তির হার ও তীব্রতার বৃদ্ধি। ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়া এবং সহনশীলতা গড়ে তোলার প্রয়াসে যুক্তরাজ্য বাংলাদেশকে সহায়তা করে আসছে। এখন সময় এসেছে সমান অংশীদারত্বের সঙ্গে এগিয়ে যাওয়ার, যেখানে যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় এবং পরিবেশ রক্ষা–সম্পর্কিত বিষয়ে যৌথভাবে কাজ করবে এবং জ্ঞান ও দক্ষতার আদান-প্রদান করবে। যুক্তরাজ্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। এর পাশাপাশি নবায়নযোগ্য শক্তি–সম্পর্কিত আমাদের নিজস্ব দক্ষতা বিনিময় করতে পারি। যুক্তরাজ্য আন্তর্জাতিক জলবায়ু অর্থ তহবিলে আরও সম্পূরক ভূমিকা পালন করতে পারে। নিজ দেশের জলবায়ু মোকাবিলায় সফল কার্যক্রম বিস্তারের জন্য বাংলাদেশ সেই তহবিল থেকে সহায়তা পেতে পারে। 

এই বছর জলবায়ু পরিবর্তন–সম্পর্কিত জাতিসংঘের ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশনের ২৬তম শীর্ষ সম্মেলন কপ–২৬–এ যুক্তরাজ্য সভাপতিত্ব করবে। ২০২০ সালের নভেম্বরে গ্লাসগো শহরে অনুষ্ঠিত কপ–২৬ যুক্তরাজ্য কর্তৃক আয়োজিত এই দশকের বৃহত্তম আন্তর্জাতিক শীর্ষ সম্মেলন, যেখানে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য রাষ্ট্রপ্রধান, জলবায়ু বিশেষজ্ঞ, প্রচারক, উদ্যোক্তাসহ প্রায় ৩০ হাজার মানুষ একত্র হবে। এই শীর্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিকভাবে একটি শীর্ষস্থানীয় কণ্ঠস্বর। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা করতে আমরা সবাই যে উচ্চাকাঙ্ক্ষী ফলাফল অর্জন করতে চাই, তা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সহায়ক অংশীদারের ভূমিকা পালন করতে পারে।

জলবায়ু সম্মেলন কপ–২৬ হচ্ছে প্যারিস অ্যাগ্রিমেন্ট স্বাক্ষরকারী দেশগুলোর জন্য তাদের নিজ দেশের গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন হ্রাস করার পরিকল্পনা হালনাগাদের সময়সীমা। গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন হ্রাসে বৈসাদৃশ্য কমাতে ও বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রির নিচে রাখার জন্য এই নতুন হালনাগাদ হতে হবে আগের চেয়ে বেশি উচ্চাভিলাষী। এর পাশাপাশি গত বছরের জলবায়ু সম্মেলনের কিছু অসম্পূর্ণ কাজ রয়েছে, যা অনেক দেশের প্রত্যাশা পূরণ করেনি। এ বছরের জলবায়ু সম্মেলনের সভাপতিত্বের কাজটি যুক্তরাজ্যের জন্য সহজ হবে না; তবে আমরা এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুত। 

কপ–২৬ সভাপতিত্বের প্রস্তুতি হিসেবে যুক্তরাজ্য ইতিমধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সবার অঙ্গীকার আরও দৃঢ় করতে বিশ্বনেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। বাংলাদেশ এ বছর ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরাম ও স্থানীয়ভাবে নেতৃত্বাধীন অ্যাডাপটেশন অ্যাকশন ট্রেক অব দ্য গ্লোবাল কমিশন অন অ্যাডাপটেশনে (জিসিএ) নেতৃত্ব দিচ্ছে। বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের অংশীদারত্ব জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার কাজে আরও অগ্রগতি আনবে। তাই সম্মিলিত প্রভাব বিস্তার করতে যতটা সম্ভব আমাদের একসঙ্গে কাজ করা প্রয়োজন। 

বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্য—উভয় দেশের এমন গবেষণা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যা জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক বিজ্ঞান সম্পর্কে বৈশ্বিক ধারণার বিকাশে অবদান রাখছে। গত মাসে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের গবেষণা সম্মেলন বাংলাদেশের জলবায়ু বিষয়ে বৈজ্ঞানিক দক্ষতার উৎকর্ষের উদাহরণ। এই সম্মেলন বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানীদের একসঙ্গে নিয়ে এসেছে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় আরও বেশি এগিয়ে যাওয়ার জন্য সরকার এবং বেসরকারি খাতের দ্বারা গৃহীত সিদ্ধান্তগুলোকে প্রভাবিত করতে, নতুন ধারণার পরীক্ষা ও প্রমাণ সংগ্রহ করতে আমাদের নিয়মতান্ত্রিকভাবে একসঙ্গে কাজ করতে হবে এবং এই কাজের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক জ্ঞানের কিছু অভাব পূরণ, নতুন ধারণা ও প্রযুক্তির উদ্ভাবন অন্তর্ভুক্ত। এসব কাজই আমাদের উভয় দেশকে উন্নয়নের সবুজ–শ্যামল পথ অবলম্বন করতে এবং পরিবর্তিত জলবায়ুর অনিবার্য প্রভাবগুলোর সঙ্গে আরও ভালোভাবে ও আরও দ্রুত মানিয়ে নিতে সহায়তা করবে। 

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশ উভয়েরই প্রগতিশীল এবং শক্তিশালী নীতিমালা রয়েছে। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে প্রথম দেশ, যারা জলবায়ু পরিবর্তন কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল। এর পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে ও স্বল্প কার্বন নিঃসরণ করে এমন উন্নয়নের পথ অবলম্বন করতে বাংলাদেশ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাও পরিবেশের অবক্ষয় মোকাবিলা, স্বল্প কার্বন নিঃসরণ করে এমন উন্নয়ন, জলবায়ু পরিবর্তনের আঘাত মোকাবিলায় সহনশীলতা বৃদ্ধি করায় বিশেষ জোর দেবে।

বিশ্বের স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ প্রথম জাতীয় জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড স্থাপন করে। জাতীয় জলবায়ু অর্থায়নের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের জন্য বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যান্য দেশের কাছে উদাহরণস্বরূপ। গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড থেকে তহবিল তুলতে সক্ষম বাংলাদেশের এমন দুটি জাতীয় সংস্থা রয়েছে। এই দুটি সংস্থা সফলভাবে ব্যাংক খাতকে বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য সহনশীলতা বৃদ্ধি কার্যক্রমে নিযুক্ত করেছে। ২০১০ সালে গ্রিন এনার্জি ও প্রবহমান ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টে বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের পুনঃ অর্থায়ন–সুবিধা চালু করে। এর ফলে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সবুজ অর্থায়নের আওতায় স্বল্প সুদে ঋণ দিচ্ছে। 

আমরা, যুক্তরাজ্য, আমাদের করণীয়টুকু করছি। যুক্তরাজ্য ২০৫০ সালের মধ্যে নেট জিরো গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের লক্ষ্যে আইন প্রণয়নকারী প্রথম বৃহৎ অর্থনীতি। বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোকে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় পদক্ষেপ নিতে সহায়তা করার লক্ষ্যে আমরা আমাদের আন্তর্জাতিক জলবায়ু অর্থায়ন দ্বিগুণ করছি (২০২১-২৫ সময়কালের জন্য ৫.৮ বিলিয়ন পাউন্ড থেকে ১১.৬ বিলিয়ন পাউন্ড)। মিসরে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের ক্লাইমেট অ্যাকশন শীর্ষ সম্মেলনে ‘কল টু অ্যাকশন’–এর অনুমোদনপ্রাপ্ত ১১০টির বেশি দেশ এবং ৭০টির বেশি সংস্থা নিয়ে আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা ও সহনশীলতা বৃদ্ধির জন্য বৈশ্বিক পদক্ষেপ এগিয়ে নিয়ে যাব। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ ও প্রভাব মোকাবিলায় প্রচেষ্টাস্বরূপ আমরা জীববৈচিত্র্য রক্ষায় জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণের ঘোষণা দিয়েছি। একটি নতুন আন্তর্জাতিক জীববৈচিত্র্য তহবিলে যুক্তরাজ্যের ২২০ মিলিয়ন পাউন্ড বিনিয়োগ এবং পুনরায় নবায়নের জন্য ৪০ মিলিয়ন পাউন্ড বিনিয়োগের অঙ্গীকারের অন্তর্ভুক্ত। স্বল্প কার্বন নিঃসরণ করে এমন প্রকল্পে বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য আমরা প্রথম গ্রিন ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক স্থাপন করেছি। ইংল্যান্ডের বিদায়ী গভর্নর মার্ক কার্নি শিগগিরই জাতিসংঘের জলবায়ু অর্থায়নবিষয়ক দূত হবেন। 

সুতরাং বলা যায়, যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশের একসঙ্গে কাজ করার অনেক সুযোগ রয়েছে। তবে উল্লেখ্য, যুক্তরাজ্য-বাংলাদেশের অংশীদারত্ব নতুন কিছু নয়। ২০০৮ সাল থেকে যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশ আবহাওয়া ও জলবায়ু নিয়ে সঠিক পূর্বাভাস–সম্পর্কিত তথ্য সরবরাহের জন্য ‘জলবায়ু মডেল’ আরও উন্নত করতে একত্রে কাজ করেছে। ফলে বাংলাদেশের ২ কোটি ৭০ লাখের বেশি মানুষ বন্যা এবং ঘূর্ণিঝড়ের প্রাথমিক সতর্কতামূলক ব্যবস্থায় আওতায় এসেছে এবং বিভিন্ন বিপর্যয় পরবর্তী সময়ে ৯ লাখ মানুষকে জরুরি সাহায্য ও পুনরুদ্ধারের সহায়তা প্রদান করা সম্ভব হয়েছে। 

যুক্তরাজ্য-বাংলাদেশের অংশীদারত্ব আরও গভীর হচ্ছে, বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তন–সম্পর্কিত বিজ্ঞান, নীতি ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রে। জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ রক্ষা যেন বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের সব উন্নয়ন সহযোগিতা কর্মসূচির কেন্দ্রে থাকে, আমরা তা নিশ্চিত করছি। যুক্তরাজ্য সরকারের দাতা সংস্থা (ডিএফআইডি) জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব প্রশমন, অভিযোজন এবং পরিবেশগত উন্নয়নের কথা মাথায় রেখে বড় আকারের নতুন কর্মসূচি গ্রহণের পরিকল্পনা করছে। আমরা আশা করি এই বছর কপ–২৬ সম্মেলনে এর যাত্রা শুরু হবে। 

বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাজ্য সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে আমরা এই যুক্তরাজ্য-বাংলাদেশ জলবায়ু অংশীদারত্বকে একটি গতিশীল শক্তি হিসেবে দেখি। এই যৌথ শক্তি একই সঙ্গে নিজ দেশে ও বিশ্বব্যাপী স্বচ্ছ প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সহনশীলতা সুদৃঢ় করতে কী করা যেতে পারে, তা প্রদর্শন করবে। যুক্তরাজ্য-বাংলাদেশ অংশীদারত্ব কেবল এই বছরের জলবায়ু সম্মেলনের জন্য নয়; এই অংশীদারত্ব দীর্ঘমেয়াদি। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, যুক্তরাজ্য-বাংলাদেশের সম্মিলিত দক্ষতা এবং যৌথ নেতৃত্ব আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটি পরিচ্ছন্ন, স্বাস্থ্যকর পৃথিবী রেখে যেতে বিশ্বব্যাপী মানুষকে সংহত করতে পারে। আমাদের সবার জন্য এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর কী হতে পারে? 

রবার্ট চ্যাটার্টন ডিকসন বাংলাদেশে নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার
জুডিথ হারবার্টসন যুক্তরাজ্যের দাতা সংস্থা ডিএফআইডির বাংলাদেশ কান্ট্রি রিপ্রেজেনটেটিভ