যুক্তরাজ্য: 'উৎকৃষ্ট' অভিবাসীরা কোন দুঃখে আসবে?

রয়টার্স ফাইল ছবি
রয়টার্স ফাইল ছবি

টানা কয়েক বছর সীমাহীন যুক্তিতর্ক, আলোচনা-সমালোচনা এবং কয়েক মাস ধরে গবেষণা করার পর যুক্তরাজ্য সরকার অবশেষে তার ব্রেক্সিট-পরবর্তী অভিবাসন সংক্রান্ত কর্মপরিকল্পনা প্রকাশ করেছে। কনজারভেটিভ পার্টি তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে যেমনটি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সেই অনুযায়ী যুক্তরাজ্য শিগগিরই তাদের পয়েন্ট-ভিত্তিক অভিবাসন পদ্ধতি চালু করবে। মূলত ‘কম দক্ষ’ অভিবাসীদের যুক্তরাজ্যে ঢোকা বন্ধ করার লক্ষ্যেই এই পদ্ধতি অনুসরণ করতে যাচ্ছে সরকার। 

নতুন নিয়ম অনুযায়ী, যাঁরা অন্য দেশ থেকে যুক্তরাজ্যে যেতে চান, তাঁদের ৭০ পয়েন্ট থাকতে হবে। এই ৭০ পয়েন্ট পেতে তাঁর বাৎসরিক আয় থাকতে হবে কমপক্ষে ২৫,৬০০ পাউন্ড (এতে আসবে ২০ পয়েন্ট), তাঁকে ভালো ইংরেজি বলতে হবে (এতে আসবে ১০ পয়েন্ট), অনুমোদিত কোনো স্পন্সরের পক্ষ থেকে একটি চাকরির প্রস্তাব (জব অফার) থাকতে হবে—এই ধরনের আরও কিছু যোগ্যতা থাকতে হবে। 

২০১৬ সালে ব্রেক্সিটের পক্ষে যাঁরা গণভোট দিয়েছিলেন, তাঁরা এই নতুন পদ্ধতিকে হয়তো স্বাগত জানাচ্ছেন, কারণ তাঁরা চেয়েছিলেন যুক্তরাজ্যে অভিবাসীর আগমন যত দূর সম্ভব ঠেকানো হোক এবং যাঁরা ইতিমধ্যে যুক্তরাজ্যে এসে অবৈধভাবে অবস্থান করছেন, তাঁদের বিদায় করা হোক। কিন্তু এই পয়েন্ট পদ্ধতির কারণে এখন বিশেষ করে কম উপার্জনকারী লোকেরা দেশ ছাড়তে বাধ্য হওয়ার ঝুঁকিতে পড়েছেন। মনে রাখা দরকার, বহু সফল লোক যুক্তরাজ্যে এসেছেন কিন্তু এই ৭০ পয়েন্ট পূরণের মতো ক্যারিয়ার এখনো গড়ে তুলতে পারেননি। অভিবাসীরা প্রথমে এখানে আসেন এবং পরে আস্তে আস্তে ভাগ্য গড়ে তোলেন। 

কয়েক দিন আগে লন্ডনভিত্তিক সাংবাদিক হ্যারি ওয়ালোপ টুইটারে বলেছেন, তাঁর দাদার বাবা মাত্র ১৫ বছর বয়সে কপর্দকহীন অবস্থায় লিথুয়ানিয়া থেকে এখানে এসেছিলেন। তিনি মানুষের বাড়ি বাড়ি জুতোর লেস ফেরি করে বেড়াতেন। তিনি ইংরেজিও জানতেন না। পরবর্তী সময়ে তিনি ব্রিটেনের ষষ্ঠ বৃহত্তম কোম্পানি বার্টনস দ্য টেইলরে ক্যারিয়ার গড়েছিলেন। 

ওয়ালোপের দাদার বাবা একাই যে এভাবে উঠে এসেছেন, তা নয়। গ্লোবাল এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ মনিটরের ২০১৭ সালের প্রতিবেদন বলছে, যুক্তরাজ্যে একেবারে শুরু থেকে শুরু করা যত জন উদ্যোক্তা আছেন, তাঁদের মধ্যে যুক্তরাজ্যে জন্ম নেওয়া উদ্যোক্তাদের চেয়ে দেড় গুণ বেশি আছেন বাইরের দেশ থেকে আসা উদ্যোক্তারা। 

গবেষণা প্রতিষ্ঠান জিরার গবেষণায় দেখা গেছে, ব্রিটেনের প্রতি ১০টি কোম্পানির ৯টিরই মালিক অভিবাসী বংশোদ্ভূত। তাঁরা অভিবাসীদের প্রথম অথবা দ্বিতীয় প্রজন্ম। সরকারের জন্য যেটি অস্বস্তির খবর, সেটি হলো বাইরের দেশের মেধাবী ও প্রতিভাবানদের কাছে ব্রিটেন একটি তীর্থভূমির মতো। এখানে এসে তাঁরা তাঁদের প্রতিভার পূর্ণ বিকাশ ঘটাতে চান। তাঁদের মেধাদীপ্ত আইডিয়া এখানে বাস্তবায়নের চেষ্টা করেন। এটি যুক্তরাজ্যের জন্য অত্যন্ত গৌরবের বিষয়। 

কিন্তু নতুন এই পদ্ধতি অনুসরণ করলে দেখা যাবে, অনেক মেধাবী লোক আর্থিক কিংবা অন্য শর্ত পূরণ করতে না পারায় যুক্তরাজ্যে যেতে পারবেন না। সর্বগুণে গুণান্বিত হয়ে যদি কাউকে যুক্তরাজ্যে আসতে হয়, তাহলে তা অধিকাংশের পক্ষেই সম্ভব হয়ে উঠবে না। ব্রিটেনে যাঁরা এসেছিলেন, তাঁদের অনেকেই সফল হয়েছেন। কিন্তু অনেকে আছেন যাঁরা সবদিক থেকে সফল হতে পারেননি। অনেকে আছেন যাঁরা এখানে হাসপাতালে কাজ করেন, কফি শপে বা বেকারিতে কাজ করেন। তাঁরা আহামরি কোনো বেতনও পান না এবং সবার সঙ্গে ভাব বিনিময় করতে প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চশিক্ষারও দরকার হয় না বলে ‘ভালো ইংরেজি’ও জানেন না। 

সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, এই নতুন পদ্ধতিতে মানুষকে মানুষ হিসেবে না দেখে ‘মানবাকৃতির দক্ষতা সরবরাহকারী’ হিসেবে দেখা হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে সরকার এই বার্তা দিতে যাচ্ছে যে, তারা শুধু যুক্তরাজ্যের উপকারে আসবে—এমন বিদেশি লোককেই অভিবাসন দেবে, আর কাউকে নয়। যে পয়েন্ট একজন অভিবাসীর যোগ্যতা হিসেবে ধরা হয়েছে, সেই পয়েন্ট অর্জনকারী ব্যক্তি ঈপ্সিত গন্তব্য হিসেবে যে শুধুই যুক্তরাজ্যকে ধরে নেবেন, এমনটি মনে করার কোনো কারণ নেই। যেহেতু তিনি যোগ্য ও সব দিক থেকে দক্ষ, সেহেতু তাঁর সামনে আরও অনেক দেশই আছে। যুক্তরাজ্যের এত শর্ত পূরণে যে ব্যক্তি সক্ষম সে ব্যক্তি নিঃসন্দেহে মেধাবী ও মানসম্পন্ন দক্ষ। যে দেশ অভিবাসীর খুঁত ধরার জন্য সারাক্ষণ তাঁর নাকের ডগায় টোকা মারবে, সে দেশকে সে ব্যক্তি প্রতিভা বিকাশের একমাত্র পীঠস্থান মনে করবে কোন দুঃখে? 

দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত
মারি লো কোনতি লন্ডনভিত্তিক সাংবাদিক ও লেখক