ঋণ খেলাপের দায় আমানতকারীদের ঘাড়ে

গত কয়েক দশকে ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে সুদাসলের কিছু না দেওয়ার একটি সংস্কৃতি চালু হয়েছে। অনেকে ভুয়া কাগজপত্রের ভিত্তিতে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে পাড়ি দিয়েছেন বিদেশে। দু-একটি ক্ষেত্রে আটক হয়ে কারাবাস করছেন সীমিত কয়েকজন।

এ বিষয়ে অনেকটা বিচারহীনতার সংস্কৃতি চালু রয়েছে। আইনি জটিলতা টাকা আদায়ের পথে বড় বাধা হিসেবে সামনে দাঁড়ায়। কালক্রমে তারা একটি প্রভাবশালী শ্রেণি হিসেবে সমাজে বিলাসবহুল জীবনযাপন করছে। এ খেলাপি সংস্কৃতিটা শুরুর দিকে ছিল রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোতে। পরে প্রসারিত হয় গোটা ব্যাংকব্যবস্থায়। দায়ী করা হতে থাকে উচ্চ হারে ব্যাংকসুদে টাকা ধার করায় শিল্প-বাণিজ্য অলাভজনক হয়ে পড়েছে। ফলে খেলাপি হয়ে যাচ্ছে ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণ। সময়মতো সুদাসলের কিস্তি দিতে পারছেন না গ্রাহকেরা।

সব দেশে সব কালেই শিল্প-বাণিজ্যে লাভ-লোকসান থাকে। লোকসানে পড়ে ব্যাংকের টাকা খেলাপিও হন কেউ কেউ। কিন্তু বিভিন্ন তথ্যানুসারে বাংলাদেশের মতো বেশি সংখ্যায় ও বেশি হারে অন্য কোনো দেশে ঋণখেলাপি নেই বলে জানা যায়। আর আমাদের এখানে পরিস্থিতি এ পর্যায়ে যেতে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে ঋণখেলাপিদের প্রভাব। এটাও সবারই দেখা ও জানা। সমাজে প্রভাবশালী অংশ খেলাপিদের সহায়তা দেয়। ব্যাংকারসহ পরিচালনা বোর্ডের সহায়তায় বড় রকমের বেশ কিছু ঘটনা আমাদের সবার জানা।

খেলাপি ঋণের হার নিয়ে অনেক হিসাব-নিকাশ আছে। বিশেষ ব্যবস্থায় খেলাপিমুক্ত আগে থেকেই করা হয়েছে এবং হচ্ছে অনেককে। বেশ কিছু মন্দ ঋণকে হিসাব-নিকাশের বাইরে রাখতে রাইট অফ করে দেওয়া হয়েছে। তারপরও এটা বরাবর ১০ শতাংশের ওপরেই ছিল। অতিসম্প্রতি আরেকটি অভূতপূর্ব ব্যবস্থা নেওয়া হয়। খেলাপি ঋণ পুনঃ তফসিল করার আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসারে বাংলাদেশ ব্যাংকের যে নিয়মাবলি ছিল, তা ছুড়ে ফেলে দিয়ে চালু করা হয় নতুন নিয়ম। মোট খেলাপি ঋণের ২ শতাংশ দিয়েই ৫০ হাজার ১৮৬ কোটি টাকা খেলাপিমুক্ত করা হয়। নগদে আদায় হয় মোট ৪৭৯ কোটি টাকা। এতে ২০১৯-এর শেষে খেলাপি ঋণ শতকরা হারে ১০ দশমিক ৩০ থেকে ৯ দশমিক ৩২-এ নেমে যায়। কিন্তু টাকার অঙ্ক শূন্য দশমিক ৪২ শতাংশ বেশি হয়ে ৯৪ হাজার ৩১৩ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। এ-ও প্রকৃত অর্থে ঋণখেলাপিদের বড় অংশকে হিসাবের বাইরে রেখে। ঠিক এবারের মতো না হলেও কিছু বড় অঙ্কের ঋণখেলাপিকে কয়েক বছর আগে ঋণ পুনর্গঠনের নামে নামমাত্র ডাউন পেমেন্ট নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি কিস্তি করে দেওয়া হয়। নিয়মিত হয়ে যান তাঁরা। জানা যায়, সেসব কিস্তিও দু-একটি দিয়ে আবার সময় চাওয়া হয়। পেয়েও যান। তাই তাঁরা ঋণখেলাপি নন। ব্যাংকের সুদের টাকাটাও আসে না। অনেক ক্ষেত্রে মাফ করা হয় কিংবা রাখা হয় ব্লক হিসেবে। সেগুলো আদায় হবে কি না, হলেও কবে, এ নিয়ে সংশয়ে আছেন ব্যাংকাররা। অন্যদিকে বিউটি পারলার থেকে সেজে কদর্য রূপ সাময়িকভাবে ঢাকা যায়। পরিস্থিতির ঘটে না পরিত্রাণ। ফলে টাকার টান পড়ে ব্যাংকে। তারা ঋণ বিতরণে হয় রক্ষণশীল এবং সুদের হারও বাড়িয়ে ব্যাংকের মুনাফা অর্জনের চেষ্টা করে। আর টাকার জোগান দিতে অধিক সুদে নেয় আমানত।

কিছুদিন হলো সরকার এখানে হস্তক্ষেপ করছে। একপর্যায়ে সিদ্ধান্ত হয় আমানত ও ঋণের সুদহার যথাক্রমে ৬ ও ৯ শতাংশের অধিক হবে না। সরকারি ব্যাংকগুলোতে হুকুম দিলেই চলে। লাভ-লোকসানের ধার তারা ধারে না। তাদের মূলধন ঘাটতি মেটাতে সরকার বারবার জাতীয় রাজস্ব থেকে ভর্তুকি দেয়। আর সেটা জনগণের করের টাকা। অন্যদিকে বেসরকারি ব্যাংকগুলো দাবি জানাতে থাকে করপোরেট করহার কমানো, সরকারি আমানতের অর্ধেক তাদের কাছে রাখা, বিধিবদ্ধ রিজার্ভ কমানো, প্রভিশনিং শিথিল করার। এসব ক্ষেত্রে ঝুঁকির কথা খুব একটা বিবেচনায় না নিয়েই তা-ও করা হয়। তবে ৯-৬ সূত্র কার্যকর করতে ব্যাংকের আমানত বাড়াতে হবে। খেলাপি হয়ে যাওয়া টাকা শিগগির কিংবা আদৌ পুরো ফেরত আসবে না। নজর পড়ে সঞ্চয়পত্রের দিকে। সেখানে বড় ধরনের বাধা আসে সরকারি দলের নেতাদের মধ্য থেকেই। প্রকৃতপক্ষে সঞ্চয়পত্র একটি সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী হিসেবে কাজ করছে। এর সুফলভোগী অবসরজীবী, বিধবাসহ সমাজের প্রান্তজন। ২০১৩ সালে একবার এগুলোর সুদহার ২ শতাংশ কমানো হয়। তবে এ ব্যবস্থাটির সুযোগ নিচ্ছিল সমাজের ধনিক শ্রেণির একটি অংশও। সেটা ঠেকাতে অটোমেশনের আওতায় এনে কিছু কঠোর শর্ত আরোপ করা হয়। শর্তগুলো একেবারে অযৌক্তিক নয়। তবে টিআইএন নম্বর একটি অঙ্কের ওপর বাধ্যকরী করায় নিম্ন আয়ের লোকজন যাঁরা আয়কর দেন না বা দেওয়ার কথা নয়, তাঁরাও আটকে যান। বিষয়টি তলিয়ে দেখা দরকার। তবে সুদহার না কমালেও মুনাফার ওপর শতকরা ১০ শতাংশ আয়কর ধার্য করা হয়। এর ফলে আয় যায় কমে। সঞ্চয়পত্র বিক্রিও নেমে এসেছে গত বছরের ২৫ শতাংশে। এগুলো সবই ব্যাংকের টাকার জোগান বাড়াচ্ছে।

সবশেষে ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংকের মেয়াদি আমানতের সুদহার এক ঘোষণাতেই অর্ধেক করে ফেলা হলো। জারি হয় গেজেট বিজ্ঞপ্তি। এখানেও সাধারণত নিম্ন আয়ের লোকেরা এ ধরনের আমানত রাখতেন। ব্যাপারটি ব্যাপক সমালোচনার মুখে সরকার এটাকে পুনর্বিবেচনার আশ্বাস দেয়। তবে জারি করা আদেশটি করা হয়নি স্থগিত বা বাতিল। এ ক্ষেত্রে কখন কী পরিমাণে সুদের হার পুনর্নির্ধারণ হবে, তা অস্পষ্ট রয়ে গেল। বলবৎ রয়ে গেল জারি করা আদেশটি। সরকার ব্যাংকব্যবস্থা থেকে বেপরোয়া ধার করছে। বেসরকারি উদ্যোক্তারা অনধিক ৯ শতাংশ সুদে বিনিয়োগ কিংবা চলতি খরচের জন্য ১ এপ্রিল থেকে ঋণ পাওয়ার কথা। অথচ সব মহল বলছে, ঋণখেলাপি সংস্কৃতিটার টুঁটি চেপে ধরতে পারলে ব্যাংক আরও কম সুদে বিনিয়োগ করতে পারত। আমানতকারীদের সুদের হার নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ থেকে ৬ শতাংশ। এ থেকে বাদ যাবে আয়করসহ ব্যাংকের বিভিন্ন চার্জ। অথচ মুদ্রাস্ফীতি ৬ শতাংশের কাছাকাছি। বলা হয়, পৃথিবীর কোথাও এত অধিক মুনাফায় টাকা রাখার সুযোগ নেই। হতে পারে। তবে পৃথিবীর সব দেশেই কি আমাদের একই আর্থসামাজিক অবস্থা বিরাজ করছে? পুঁজিবাজার বিনিয়োগের একটি আদর্শ ক্ষেত্র বলে বিশ্বব্যাপী বিবেচনা করা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে বারবার এখানে বিনিয়োগকারীরা সর্বস্বান্ত হয়েছেন। এ অবস্থায় একটু নিরাপত্তার জন্য সঞ্চয়পত্র ও ব্যাংকে স্থায়ী আমানতে টাকা খাটানোই স্বাভাবিক। এখানে সুদের হার কমানোয় ক্ষতিগ্রস্ত হবেন আমানতকারীরা। শোচনীয়ভাবে কমে যাবে তাঁদের জীবনযাত্রার মান। আর ব্যাংকও সে আমানতের একটি অংশ ধরে রাখতে পারবে কি না, এ নিয়ে সংশয় রয়েছে। এখানে উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক যে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে ব্যয়বহুল দেশ বলে চিহ্নিত হয়েছে।

আমরা শিল্প-বাণিজ্যের বিকাশ চাই। প্রবৃদ্ধির হার আরও বাড়ুক, তা-ও চাই। আর চাই এ উচ্চ প্রবৃদ্ধির সুফল সমাজের সর্বস্তরে পড়ুক। পক্ষান্তরে উচ্চ প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি আমরা আয়বৈষম্যের চরম মাত্রায় বৃদ্ধি লক্ষ করছি। দেখতে পাচ্ছি প্রবৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়ছে না আমদানি, রপ্তানি, সরকারের রাজস্ব আর কর্মসংস্থান। ঋণখেলাপিদের সাম্প্রতিক কালে যে সুবিধাটা দেওয়া হয়েছে, এর খারাপ প্রভাব পড়তে পারে দেশের আর্থিক ব্যবস্থায়। দেওয়া ঋণের কিস্তি সুদাসলে ব্যাংকের ঘরে না এলে আমানতকারীদের সুদের হার কমিয়ে ব্যাংক কত কাল এক অঙ্কে ঋণ দিয়ে যেতে পারবে। সে লগ্নি কিন্তু বর্তমান সংস্কৃতিতে পুরো ফেরত আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ। এটা নিশ্চিত না করে খেলাপিদের অপকর্মের দায়ভার চেপে বসল আমানতকারীদের ওপর।

আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব
[email protected]